মযহারুল ইসলাম বাবলা
প্রকাশ : ১৬ ডিসেম্বর ২০২২ ০০:০৯ এএম
মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর বিজয়ের যে সূর্য উদিত হয়েছিল আমাদের জাতীয় জীবনের আকাশে এর পেছনের উপাখ্যান নতুন করে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের প্রয়োজন রাখে না। তবে প্রশ্ন দাঁড়ায়, যে অঙ্গীকার-প্রত্যয় জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে মুক্তিযুদ্ধের মতো মহান অধ্যায়ের সৃষ্টি করেছিল সুনির্দিষ্ট কিছু লক্ষ্যের ভিত্তিতে, আমরা কি পূর্ণাঙ্গভাবে সেই লক্ষ্য অর্জন করতে পেরেছি? অনস্বীকার্য, স্বাধীনতা অর্জনের পঞ্চাশ বছরেরও অধিক সময়ে আমরা অনেক ক্ষেত্রেই এগিয়েছি বটে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিশ্ব দরবারে দৃষ্টান্তযোগ্যও হয়ে উঠেছি, কিন্তু আমরা কি বৈষম্যের ছায়া সরিয়ে সাম্যের আলো ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছি? যেকোনো রাষ্ট্রের জন্য রাজনীতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। রাজনীতিবিহীন সমাজ বদ্ধ জলাশয়ের মতো। আমাদের রাজনৈতিক অর্জন কম নয়। সেই ভাষা আন্দোলন থেকেও যদি শুরু করি এবং মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীনতা পর্যন্ত যদি একটানা অধ্যায়গুলো বিশ্লেষণ করি তাহলে যে রাজনৈতিক আলোর স্পর্শে আমরা স্পর্শিত হই এর ধারাবাহিকতা কি রক্ষা করা সম্ভব হয়েছে?
স্বাধীন দেশেও আমাদের রাজনৈতিক অর্জন কম নয়। একই সঙ্গে এও সত্য, এই অর্জনের নানা ক্ষেত্রে বিসর্জনও ঘটেছে মূলত কারও কারও রাজনৈতিক হীনস্বার্থ চরিতার্থকরণের অপচেষ্টার কারণে এবং এ জন্য সৃষ্টি হয়েছে অনেক ক্ষতের। রাজনৈতিক উচ্চারণসর্বস্ব অঙ্গীকারের যে কোনোই মূল্য নেই এর অনেক নজির আমাদের সামনে রয়েছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবাসহ মৌলিক অধিকার তো বটেই, আরও অনেক ক্ষেত্রেই আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আলোকে অধিকারের মাঠ সমতল করতে পারিনি এটিই সত্য। এই ব্যর্থতার দায় রাজনীতিকরা এড়াতে পারেন না। প্রগতিশীল ধারার সুস্থ রাজনৈতিক চর্চা বারবার হোঁচট খেয়েছে এবং এর বিরূপ প্রভাব রাষ্ট্র ও নাগরিক জীবনে কখনও কখনও প্রকটভাবে দৃশ্যমান হয়েছে। কাঙ্ক্ষিত বাংলাদেশের প্রথমেই ছিল একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সমাজের প্রত্যাশা, অর্থাৎ যেখানে মানুষের সঙ্গে মানুষের শ্রেণিগত, ধর্মগত, লৈঙ্গিক বা বর্ণগত কোনো বৈষম্য থাকবে না। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের এই প্রত্যাশাগুলো এখনও পূরণ হয়নি।
বাংলাদেশের মানুষ যেমন অপেক্ষা করেছিল সামাজিক ক্ষেত্রের মৌলিক পরিবর্তনের। এখনও সেই অপেক্ষা রয়ে গেছে। বামপন্থিদের কাছে যে প্রত্যাশা ছিল তাও তারা পূরণ করতে পারেননি। ৭২-এর সংবিধান, যে সংবিধানটি ছিল মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে প্রাপ্ত অনন্য একটি দলিল, সেই সংবিধানের মূল চার নীতির ওপর আঘাত করলেন তৎকালীন শাসকরা তাদের রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের লক্ষ্যে। আইনের শাসন, ন্যায়বিচার, মানবাধিকার ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে প্রশ্ন আছে এখনও। গণতন্ত্রের জন্য আইনের শাসন অবশ্যই জরুরি, একই সঙ্গে জরুরি মানুষের অধিকারের সব পথ সুগম করা। আমরা অনেকেই জানি, সুশাসনের পথে এখনও বড় অন্তরায় হয়ে আছে অনিয়ম-দুর্নীতি। দুর্নীতিবাজদের লম্ফজম্ফ এখনও পরিলক্ষিত হয় দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের ‘শূন্য সহিষ্ণুতা’র অঙ্গীকার সত্ত্বেও। দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না এমনটি বলা ঠিক হবে না, কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই দুর্নীতিবাজরা যে নানা কৌশলে পার পেয়ে যাচ্ছে তাও তো অসত্য নয়। যাদের শ্রমে-ঘামে আমাদের খাদ্যপণ্য উৎপাদিত হয় এবং এজন্য বিদেশনির্ভরতা যারা বহুলাংশে কমিয়েছেন, সেই কৃষকের হাড়ভাঙা শ্রমের মর্যাদা কি আমরা দিতে পারছি? নারীশিক্ষা, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ইত্যাদি অনেক কিছুই দৃশ্যমান হলেও এর সুফল কি দেশের সব মানুষ সমানভাবে ভোগ করতে পারছেন? নিশ্চয়ই উত্তর প্রীতিকর নয়।
স্বাধীনতা অর্জনের পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময় পরও ধর্মান্ধরা বিষবাষ্প ছড়ায়। অনেকেরই অভিযোগ-ধর্মনিরপেক্ষতা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য থেকে আমরা সরে গেছি বলেই তাদের এই বাড়বাড়ন্ত। প্রকৃত গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি যদি গড়ে তোলা না যায় একইসঙ্গে মতপ্রকাশের স্বাধীনতাসহ পরমতসহিষ্ণুতা নিশ্চিত করাসহ গণতন্ত্রের অন্যতম অনুষঙ্গ নির্বাচন ব্যবস্থা কিংবা প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা না যায় তাহলে ক্রমান্বয়ে অকল্যাণের পথটাই প্রশস্ত হবে। একাত্তরে আমরা যে বিজয়ের আলোয় আলোকিত হয়েছিলাম সেই আলো কখনও কখনও অনেকটাই ম্লান হয়েছে কী কারণে তাও সচেতন মানুষের অজানা নয়। পরিবর্তন প্রয়োজন এবং পরিবর্তন সম্ভব। এজন্য প্রয়োজন জ্ঞানের বিকাশ, রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ও জাতীয় ইস্যুতে রাজনীতিকদের ঐক্যবদ্ধ হওয়া। শিক্ষিত হৃদয়, শাণিত বুদ্ধি এই দুইই খুব প্রয়োজন। প্রয়োজন মেহনতিদের সঙ্গে রাখা। কারণ, তাদের সংখ্যা সর্বাধিক এবং তাদের শ্রমের ওপর আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজ নির্ভরশীল। আমরা যদি লক্ষ করি, তাহলে স্পষ্টত দেখতে পাই প্রতিটি গণতান্ত্রিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলন-সংগ্রামে তাদের রয়েছে অপরিসীম ভূমিকা। রাষ্ট্রের সব নাগরিক সমান, এ কথা শুধু উচ্চারণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখলেই চলবে না। বিজয়ের আলো যদি আরও ব্যাপকভাবে সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে হয়, তাহলে মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার-প্রত্যাশা বাস্তবায়ন করতেই হবে। মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় অবস্থান হতে হবে নির্মোহ। মানবাধিকার সুরক্ষার বিষয়েও অবশ্যই নির্মোহ অবস্থান জরুরি।
আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম বাংলাদেশের সব মানুষের অধিকারের সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে। কিন্তু আমরা এখনও সেই লক্ষ্য নিশ্চিত করতে পারিনি। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, কাঠামোগত উন্নয়ন ইত্যাদি দিয়েই সফলতার চূড়ান্ত ছক আঁকা যায় না। জনজীবনে সবার অধিকার নিশ্চিত করার দায় অবশ্যই রাষ্ট্রশক্তির। মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার অনুযায়ী এবং বিজয়ের আলোর পথ ধরে মানবিক বাংলাদেশ গঠনে আমরা কতটুকু এগোতে পেরেছি এই প্রশ্ন এখনও দাঁড়ায়। অধিকারহীনতা এবং প্রতিকার না পাওয়া মানুষ অনেক কিছু সহজভাবে মেনে নিয়েছে। অনেকেরই এখনও মন-মনন, ধ্যান-ধারণা প্রগতিবিরোধী। এর জন্য প্রয়োজন ব্যাপক সাংস্কৃতিক জাগরণ। রাজনীতি, সমাজনীতি, সংস্কৃতি সব ক্ষেত্রে বৈরী মনোভাবের অপছায়া যাতে না পড়ে এ ব্যাপারে দায়িত্বশীল সব রাজনীতিককে সজাগ থাকা প্রয়োজন। আমরা জানি, রাজনীতির মূল লক্ষ্য মানুষের কল্যাণ। এক্ষেত্রে আমাদের অনেক রাজনীতিকের কিংবা রাজনৈতিক নীতিনির্ধারকের যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে-এই অভিযোগও নতুন নয়। এই ঘাটতি রেখে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা দুরূহ। সার্বিকভাবে সমাজের গণতন্ত্রায়ন ঘটানো অত্যন্ত জরুরি। একই সঙ্গে মানবাধিকারের শর্ত মেনে চলার পরিবেশ তৈরি করাও সমভাবে গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের সংবিধানে মৌলিক অধিকারের যেসব নির্দেশনা আছে এবং টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের যেসব সনদে আমরা স্বাক্ষর করেছি তা অবশ্যই আন্তরিকতার সঙ্গে পালন করাও জরুরি। বিজয়ের আলো ব্যাপকভাবে সর্বব্যাপী করা অবশ্যই দুরূহ কোনো বিষয় নয়, যদি দেশপ্রেমিক সবাই যূথবদ্ধভাবে প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখেন। বাংলাদেশের মানুষ অত্যন্ত কর্মঠ এবং যেকোনো সংকট মোকাবিলায় শক্তি ধারণ করে দৃঢ়ভাবে দাঁড়াতে পারে এই নজির আমাদের সামনে রয়েছে। কাজেই আমাদের লক্ষ্য অনার্জিত থাকার কোনো কারণ নেই।
আমাদের মূল শক্তি মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ ও চেতনা। এই মূল্যবোধ ও চেতনাই আমাদের অনার্জিত বিষয়গুলো অর্জনের পথটি মসৃণ করে দিতে পারে। ৭১-এ স্বাধীনতা যদি বাংলাদেশের প্রথম মৌলিক অর্জন হয়, তাহলে আমাদের দ্বিতীয় মৌলিক অর্জন হচ্ছে ১৯৯০ সালের অভ্যুত্থান, যার মাধ্যমে আমরা অগণতান্ত্রিক শাসনের অবসান ঘটিয়ে আশার আলো দেখিয়েছিলাম। ডান এবং বাম ধারার রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃত্ব যূথবদ্ধভাবে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপদানের লক্ষ্যে, অগণতান্ত্রিক শাসনের অবসান ঘটাতে যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে দেশ-জাতিকে আলোর দিশা দেখিয়েছিল, সেরকম প্রত্যয় যদি দেশ গড়ার ক্ষেত্রে সবার থাকে তাহলে নিশ্চয়ই আমাদের প্রত্যাশা অপূর্ণ থাকবে না।
একটি জাতির জীবনে ৫০ বছর খুব কম সময় নয়। যেসব স্বপ্ন-আকাঙ্ক্ষা দেশবাসীকে মুক্তিযুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করেছিল, ৩০ লাখ শহীদের আত্মত্যাগের পেছনে যেসব স্বপ্ন ছিল, তার কতটা আমরা পূরণ করতে পেরেছি কিংবা কতটা পারিনি, না পারলে তা কেন পারিনি —এই আত্মজিজ্ঞাসা প্রয়োজন। প্রয়োজন এর উত্তর খুঁজে পাওয়া। একটি প্রকৃত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার অসম্পূর্ণ কাজ সম্পূর্ণ করার লক্ষ্যে সব প্রগতিশীল শক্তির ঐক্যবোধ হওয়া যেমন প্রয়োজন তেমনি জনগণই সব ক্ষমতার উৎস তাও আমলে রাখা জরুরি। বিজয়ের আলোয় আমরা আলোকিত থাকতে চাই। আমাদের সামনে অনেক দৃষ্টান্ত রয়েছে। এই ইতিবাচক দৃষ্টান্তগুলো আমাদের চলার ক্ষেত্রে বড় শক্তি জোগাতে পারে। ৫০ বছরেরও বেশি এই বাংলাদেশে হতাশা যেমন আছে তেমনি আশাও কম নয়। আশার ঘরেই হোক আমাদের বসবাস।
লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, নতুন দিগন্ত