× ই-পেপার প্রচ্ছদ সর্বশেষ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি শিক্ষা ধর্ম ফিচার ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

স্বাস্থ্য

ডেঙ্গুর নিরাময় নিয়ে ভাবতে হবে

ড. মিহির কুমার রায়

প্রকাশ : ০৩ জুলাই ২০২৫ ১৬:৩৭ পিএম

ড. মিহির কুমার রায়

ড. মিহির কুমার রায়

এখন বর্ষাকাল। প্রতিদিনই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে রোগীরা। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সংক্রমণ ও মৃত্যু কিছুটা কমে এলেও ডেঙ্গু বাংলাদেশের জন্য নতুন বড় ধরনের জনস্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। এক দিনে বা এক বছরে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে না। কয়েক বছরের চেষ্টায় আমরা হয়তো ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আনতে পারব। তবে এখনই দেশব্যাপী সমন্বিত কার্যক্রম শুরু করতে হবে। তা না হলে পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যেতে পারে।

গত শতাব্দীর ষাটের দশকে এদেশে ডেঙ্গু শনাক্ত হয়। এরপর ২০০০ সালে প্রথম বড় আকারে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। ডেঙ্গু ছিল মূলত ঢাকা শহরকেন্দ্রিক। এরপর প্রতিবছর কমবেশি ডেঙ্গুর সংক্রমণ দেখা দিতে থাকে। তবে ডেঙ্গু বড় বড় শহরেই সীমাবদ্ধ ছিল। ২০১৯ সালে বড় বড় শহরের পাশাপাশি কয়েকটি গ্রামেও ডেঙ্গু শনাক্ত হয়। এর অর্থ, সারা দেশে ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশা আছে। মশা নিয়ন্ত্রণ কর্মকাণ্ড সাধারণত বড় বড় শহরে চোখে পড়ে। গ্রামে সেই কর্মকাণ্ড নেই। গ্রামের মানুষের করণীয় সম্পর্কে সরকারের পক্ষ থেকে স্পষ্ট কোনো বার্তা নেই। গ্রামে তাই ডেঙ্গুর ঝুঁকি থেকেই যাবে বলে মনে করেন জনস্বাস্থ্যবিদরা। একটি দেশে বা অঞ্চলে একবার ডেঙ্গু দেখা দিলে তা আর যায় না, ফিরে ফিরে আসে। তবে প্রতিরোধের ব্যবস্থা নিলে, বিশেষ করে মশকনিধন কর্মকাণ্ড হাতে নিলে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করা যায়Ñ এমন বহু নজির আছে। 

জনস্বাস্থ্যবিদরা বলছেন, বাংলাদেশ থেকে ডেঙ্গু একেবারে নির্মূল হবে না। তবে ঠিক সময়ে সঠিক ব্যবস্থা নিলে এ বছর ডেঙ্গু এতটা ছড়াত না। কীটতত্ত্ববিদরা বলছেন, মশার লার্ভা বা শূককীট থেকে সাত দিনের মধ্যেই কামড় দেওয়ার শক্তিসম্পন্ন মশার জন্ম হয়। আর লার্ভার হিসাবই বলে দেয়, এডিস মশার বিস্তার কতটা হবে। এ চিত্র দেখতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখা বছরে তিনবার রাজধানীতে মশা জরিপ করে। এসব জরিপের ফলাফল তারা সিটি করপোরেশনকেও দিয়ে দেয়। প্রাক্-বর্ষা, বর্ষা এবং বর্ষা-পরবর্তী সময়ে এ জরিপ হয়। উল্লেখ্য, ডেঙ্গু রোগের বাহক এডিস মশা।

২০২৩ সালের আগস্ট মাসের শেষ সপ্তাহে ঢাকার দুই সিটিতে হয়েছে বর্ষাকালীন জরিপ। উত্তর সিটির ৪০টি ওয়ার্ডের ১ হাজার ৩৩৫টি বাড়ি এবং দক্ষিণের ৫৯টি ওয়ার্ডের ১ হাজার ৮১৫টি বাড়িতে এ জরিপ হয়। এতে দেখা যায়, উত্তর সিটির ২৩ ভাগ এবং দক্ষিণ সিটির ১৯ ভাগ বাড়িতেই এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেছে। এর আগে জুন মাসে প্রাক্-বর্ষা জরিপ হয়। সেখানে উত্তরের ২০ শতাংশ এবং দক্ষিণের ১৫ শতাংশ বাড়িতে লার্ভার অস্তিত্ব পাওয়া গিয়েছিল। সেই তুলনায় এবার বর্ষা জরিপে মশার লার্ভা বেশি পাওয়া গেছে। তবে ভরা বর্ষায় মশার লার্ভা একটু বেশি পাওয়া যায়।

পাবলিক হেলথ বিভাগের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দুই সিটির মশার জরিপ বলে দিচ্ছে, এসব স্থানে মশা সৃষ্টি হওয়ার উৎস বাড়ছে, প্রজননক্ষেত্র বাড়ছে, আবার এর জন্য যে পরিবেশ দরকার, সেটাও অনুকূলে। কিন্তু মশা নিয়ন্ত্রণে যেসব উদ্যোগ দুই সিটি নিচ্ছে, তা কার্যকর হচ্ছে না। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গত বছরের বর্ষা জরিপের তুলনায় এ বছরের জরিপে উত্তর সিটিতে ১০ শতাংশ এবং দক্ষিণ সিটিতে ৭ শতাংশ বেশি বাড়িতে লার্ভা পাওয়া গেছে।

এডিস মশার লার্ভার ঘনত্ব পরিমাপের স্বীকৃত পদ্ধতি হলো ‘ব্রটা ইনডেক্স (বিআই)’। এই মানদণ্ডে লার্ভার ঘনত্ব ২০ শতাংশের বেশি হওয়া মানে সেখানে ডেঙ্গু রোগের প্রাদুর্ভাব নিশ্চিতভাবে বাড়বে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বর্ষা জরিপে দেখা গেছে, উত্তর সিটির ৭৫ শতাংশ এলাকায় এডিস মশার লার্ভার ঘনত্ব ২০ শতাংশের বেশি। সবচেয়ে বেশি ৬০ শতাংশ ঘনত্ব পাওয়া গেছে ২৪ নম্বর ওয়ার্ডে (তেজগাঁও শিল্প এলাকা-বেগুনবাড়ী-কুনিপাড়া)। ৪৯ শতাংশ ঘনত্ব পাওয়া গেছে ৬ নম্বর ওয়ার্ডে (পল্লবী ও মিরপুরের কিছু অংশ)। দক্ষিণ সিটির ১৯ ভাগ এলাকায় বিআইয়ের পরিমাণ ২০-এর বেশি। সর্বোচ্চ বিআই ১৯ নম্বর ওয়ার্ডে (কাকরাইল-সিদ্ধেশ্বরী-পশ্চিম মালিবাগ) ৭৩ শতাংশ। ২০ নম্বর ওয়ার্ডে (সেগুনবাগিচা-গুলিস্তান-প্রেস ক্লাব-ঢাকা মেডিকেল এলাকা) ৭০ শতাংশ।

জরিপের তথ্য অনুযায়ী, দক্ষিণের চেয়ে উত্তর সিটিতে লার্ভা পাওয়া বাড়ি এবং ওয়ার্ডের হারও বেশি। উত্তর সিটিতে এবার লার্ভা নিয়ন্ত্রণে প্রথমবারের মতো ‘বাসিলাস থুরিনজেনসিস ইসরায়েলেনসিস (বিটিআই)’ নামে একধরনের ব্যাকটেরিয়ার প্রয়োগ করা শুরু হয়েছে। বিটিআই আনতে মার্শাল অ্যাগ্রোভেট কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডকে কাজ দেয় ঢাকা উত্তর সিটি। এ প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধনই ছিল না। প্রতিষ্ঠানটি সিঙ্গাপুরের বেস্ট কেমিক্যাল লিমিটেড থেকে বিটিআই আনার কথা বলে আনে চীন থেকে। তবে সেই বিটিআই কার্যকর বলে পরে জানা যায়।

দক্ষিণের চেয়ে উত্তরে লার্ভা বেশি পাওয়ার কারণ সেখানে অনেক এলাকায় বসতবাড়িগুলো বেশ ঘন। একটি বাড়ির সঙ্গে আরেক বাড়ির মধ্যে ফাঁকা জায়গা কম। তাই সেখানে পানি জমতে পারে কম। কিন্তু উত্তরের বাড়িগুলো তুলনামূলকভাবে ফাঁকা। তবে দুই সিটিতে মশা নিয়ন্ত্রণের কাজ যে কার্যকরভাবে হচ্ছে না, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। যে উত্তর সিটিতে মশার লার্ভার উপস্থিতি বেশি, সেখানেই গত পাঁচ বছরে মশা নিধনে বেশি ব্যয় হয়েছে, যার পরিমাণ ২৮৫ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। আর দক্ষিণ সিটিতে গত পাঁচ বছরে ব্যয় হয়েছে ১৩৬ কোটি টাকা। তবে দক্ষিণ সিটির মশকনিধনকর্মীদের বেতন এই হিসাবে যুক্ত করা হয়নি।

২০১৯ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর টিআইবি থেকে ‘ঢাকা শহরে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এই প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে প্রণীত ১৫ দফা সুপারিশ ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনসহ সংশ্লিষ্ট সব অংশীজনের কাছে পুনরায় পাঠিয়ে টিআইবি বর্তমান পরিস্থিতিকে জনস্বাস্থ্য সংকট ঘোষণা করে জরুরি ভিত্তিতে সমন্বিত রোডম্যাপ প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের আহ্বান জানায়। টিআইবির ১৫ দফা সুপারিশগুলো হলো জাতীয় পর্যায়ে এডিস মশাসহ অন্যান্য মশা নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবস্থাপনা কৌশল ও কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করা, সংশ্লিষ্ট অংশীজনকে মশা নিধনে নিজস্ব পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা, বছরব্যাপী মশা নিয়ন্ত্রণে সব ধরনের পদ্ধতির ব্যবহার নিশ্চিত করা, সব সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল ও রোগনির্ণয় কেন্দ্রকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালনায় একটি কেন্দ্রীয় ডেটাবেজের অধীনে নিয়ে আসা, আইইডিসিআরসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরের সহযোগিতায় প্রতিবছর ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাবের শুরুতেই (মে-আগস্ট) সব হটস্পট চিহ্নিত করা, সব যোগাযোগমাধ্যমে (প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম) এডিস মশা ও এর লার্ভা, ডেঙ্গু রোগ নিয়ন্ত্রণ ও দ্রুত চিকিৎসার বিষয়ে সচেতনতা ও সতর্কতামূলক বার্তার কার্যকর প্রচার বাড়ানো; প্রয়োজনে এলাকাভিত্তিক মাইকিং, ধর্মীয় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে প্রচার চালানো। পাশাপাশি এডিস মশার জরিপ কার্যক্রম ঢাকার বাইরে সম্প্রসারিত করা, র‌্যাপিড অ্যাকশন টিম গঠন করে চিহ্নিত ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় নির্মাণাধীন ভবন ও প্রকল্পগুলোতে নিয়মিত নজরদারি এবং উৎস নির্মূলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া, মাঠপর্যায়ের জনবল আউটসোর্সিং করা, পর্যাপ্ত ও সুষম বাজেট বরাদ্দ দেওয়া, জনপ্রতিনিধির সমন্বয়ে এলাকাভিত্তিক স্বেচ্ছাসেবক দল গঠন করা, বিশেষজ্ঞ কারিগরি কমিটি গঠন করা, কীটনাশক ক্রয় প্রক্রিয়ায় জাতীয় ক্রয় আইন ও বিধিমালা অনুসরণ করা, মশা নিধন কার্যক্রমসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের অনিয়ম, দুর্নীতি ও দায়িত্বে অবহেলার বিষয়গুলো তদন্ত করে সংশ্লিষ্টদের শাস্তির আওতায় আনা, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে কীটনাশক পরিবর্তন, একেক এলাকায় ভিন্ন ভিন্ন কীটনাশক ব্যবহার ইত্যাদি নিশ্চিত করা।

উত্তর সিটিতে পাঁচ বছরে মশা মারার ওষুধ কেনা, মশকনিধনকর্মীদের বেতনসহ (ঠিকাদারের মাধ্যমে নিয়োজিত মশকনিধনকর্মী) বিভিন্ন খাতে ব্যয় হয়েছে ২৩১ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। আর মশা নিধনের ওষুধ ছিটানোর যন্ত্র (ফগার ও স্প্রে মেশিন) কিনতে ব্যয় হয়েছে ৪৬ কোটি ৫ লাখ টাকা। এছাড়া ডেঙ্গু মোকাবিলা, পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম ও প্রচারণা বাবদ খরচ করা হয়েছে আরও ৭ কোটি ৩৪ লাখ টাকা।

মশকনিধনে এত ব্যয়ের পরও পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে না কেন, এর উত্তরে আসে আগের যে জরিপগুলো হয়েছে, সেখানে যেসব জায়গায় মশার লার্ভা পাওয়া গিয়েছিল, নতুন জরিপে ওই জায়গা পরিবর্তন হচ্ছে। ওষুধে যদি কাজ না হয়, তাহলে তো আগের জায়গাগুলোতেই মশার লার্ভা বেশি পাওয়ার কথা। কিন্তু মশা নিজে বাঁচার তাগিদে প্রজননের জায়গা পরিবর্তন করছে। এমন এমন জায়গায় মশার লার্ভা পাওয়া যাচ্ছে, যেখানে সিটি করপোরেশনের কর্মীরা কাজ করতে পারেন না। এসব জায়গায় নগরবাসীর অনেক বেশি সচেতন হওয়া ছাড়া বিকল্প নেই। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার বক্তব্য হলো, ঢাকায় মশার এত বেশি পরিমাণে লার্ভা পাওয়ার অর্থ হলো, এবার ডেঙ্গু মৌসুম দীর্ঘ হতে যাচ্ছে। সামনের দিনগুলো ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। মশকনিধনের কাজে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে সিটি করপোরেশনকে। ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আত্মতুষ্টিতে ভুগলে বিপদ আরও বাড়াবে।

  • গবেষক ও অর্থনীতিবিদ
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : মোরছালীন বাবলা

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা