পরিবেশ
শেলী সেনগুপ্তা
প্রকাশ : ৩০ জুন ২০২৫ ১৫:৩৯ পিএম
শেলী সেনগুপ্তা
খাদ্য চাহিদা পূরণ করতে কৃষকরা সকল প্রকার প্রাকৃতিক দুর্যোগ মাথায় নিয়ে জমিতে ফসল ফলান। দিনরাত মাথার ঘাম পায়ে ফেলে অন্যদের খাদ্য চাহিদা পূরণ করেন। সবার সামনে যারা খাবার পরিবেশন করেন, প্রশ্ন জাগে তারা কি ভালো আছেন? বিষয়টি অবশ্যই বিবেচনায় আনতে হবে। না, তারা ভালো নেই। কারণ, ভুল পদ্ধতিতে চাষাবাদ ও কীটনাশক ব্যবহারের ফলে তাদের জীবন রয়েছে মারাত্মক ঝুঁকিতে। এটি মৃত্যু পর্যন্ত ঘটাতে পারে। অথচ তা তারা জানেনই না।
অনাকাঙ্ক্ষিত হলেও সত্যি, দেশের কৃষি ক্ষেত্রে আজকাল প্রচুর পরিমাণে রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহার করা হয়। এই সব কীটনাশকের অতিরিক্ত ব্যবহারে মাটি, পানি ও বাতাস চরমভাবে দূষিত হয়। আমাদের কৃষিকার্যে কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণে যেসব কীটনাশক ব্যবহার করা হয় তার বেশিরভাগই পরিবেশের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। এ ক্ষেত্রে পরিবেশ বলতে আমরা মানুষ, গাছপালা, নদ-নদী ইত্যাদি বুঝে থাকি। যখন বিশ্বজুড়ে পরিবেশের যত্নের কথা বলা হচ্ছে, এমনকি আমরাও তা মেনে চলার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছি, তখন দেশে দেদারছে চলছে ক্ষতিকর রাসায়নিক কীটনাশকের ব্যবহার। যা থেকে এখনই বের হয়ে আসা দরকার।
দেশে অল্প কিছু কীটনাশক আছে, যা পরিবেশবান্ধব। এই সব পরিবেশবান্ধব কীটনাশককে নিরাপদ কীটনাশক বলা হয়। আসলেই তা নিরাপদ। এসব নিরাপদ কীটনাশক ব্যবহারে মাটি, বায়ু, জল এবং কৃষিজ ফসলের দূষণ ঘটে না। এর ব্যবহারে মানুষের ক্ষতিও হয় না। দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, আমাদের দেশে নিরাপদ কীটনাশক খুব কমই ব্যবহার করা হয়। তুলনামূলকভাবে বেশি ব্যবহার করা হয় ক্ষতিকর কীটনাশক, যা মানবদেহের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে। মানবদেহে ক্ষতিকর প্রভাব বিস্তার করে। ক্যানসারসহ নানা ধরনের রোগ সৃষ্টি করে। ক্ষতিকর কীটনাশকের কুফল হিসেবে পুরুষের প্রজনন সমস্যাসহ আরও অনেক ধরনের অসুবিধা দেখা দিতে পারে। দেখা দিতে পারে চর্মরোগ, এমনকি চোখের সমস্যাও হতে পারে। কীটনাশকের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে নারীরাও মুক্ত নন। নারীদের প্রজনন সমস্যাসহ গর্ভধারণ ও গর্ভপাতের মতো মারাত্মক ক্ষতির ঝুঁকি রয়ে যায়। ভূমিষ্ঠ সন্তানের জন্মগত সমস্যা দেখা দিতে পারে। শিশুর আচরণগত নানা সমস্যা দেখা দেয়। বোধশক্তি কম হয়, জন্ম থেকেই নানা ধরনের সমস্যা হতে পারে।
শুধু মানুষ নয়, কীটনাশকের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারে বিষিয়ে উঠেছে সুন্দরবনের পরিবেশও। হুমকির মুখে পড়েছে সুন্দরবন উপকূলের প্রাণবৈচিত্র্য। কীটনাশকের যথেচ্ছ ব্যবহারের ফলে সুন্দরবনের পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে, ক্ষতি হচ্ছে উপকারী পোকামাকড়েরও। সুন্দরবনের মাছ মারা যাচ্ছে কীটনাশকের ভুল ব্যবহারে। মৌমাছির প্রজনন সমস্যার ফলে বংশবৃদ্ধি হার কমে যাচ্ছে। আমাদের দেশে অনেক ধরনের কীটনাশক ব্যবহার করা হয়। এর মধ্যে কিছু কীট, পোকামাকড়, ইঁদুর, আগাছা, ছত্রাক ইত্যাদি বিনাশ করে। কীটনাশক ব্যবহারে মাটি, জল ও বায়ূ দূষিত হয়। একই সঙ্গে কীটনাশক উপকারী পোকামাকড় যেমন মৌমাছি ও অন্যান্য প্রাণির ক্ষতি করে। তা ছাড়া কীটনাশকের ভুল ব্যবহারে মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর বিরূপ প্রভাব বিস্তার করে। কীটনাশকের দীর্ঘ ব্যবহারের ফলে কীটপতঙ্গের প্রতিরোধ ক্ষমতা ক্রমশ বৃদ্ধি পায়।
কৃষি ক্ষেত্রে পোকামাকড়ের আক্রমণ থেকে ফসলের ক্ষতি রোধ করার জন্য কীটনাশক ব্যবহার অপরিহার্য। তবে কীটনাশকের অপরিমিত ও অযৌক্তিক ব্যবহার মানুষ ও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। তাছাড়াও এর ব্যবহার পদ্ধতিও সঠিক নয়। অজ্ঞতাহেতু কৃষকরা ভুল পদ্ধতিতে এবং ভুল পরিমাণে কীটনাশক প্রয়োগ করে থাকেন। ফলে নিজেরও ক্ষতি করে ফেলেন। অনেক কৃষকই জানেন না মুখে মাস্ক ও হাতে গ্লাভস ব্যবহার না করে কীটনাশক স্প্রে করলে নিজেই বিষক্রিয়াতে আক্রান্ত হতে পারেন। এর ফলে মাথাব্যথা, মাথা ঘোরা, বমি ভাব, চর্মরোগ, চোখ ও শরীরের অ্যালার্জি, শ্বাসকষ্ট এমনকি ফুসফুস আক্রান্ত হতে পারেন। থাকতে পারে লিভার সিরোসিস, স্টোক প্যারালাইড ও কিডনির মতো জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা। এজন্য দরকার সঠিক পরামর্শ ও প্রশিক্ষণ। যদিও আমাদের দেশে এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই। তাই নিজেদের নিরাপত্তার কথা মনে রেখে সচেতনভাবে কীটনাশক ব্যবহারে সতর্ক হতে হবে। সচেতনভাবে কীটনাশক ব্যবহারের আগে লেবেলে লেখা নির্দেশাবলি অবশ্যই পড়তে হবে। কীটনাশক প্রয়োগের সময় সঠিক সুরক্ষা সরঞ্জাম ব্যবহার করা দরকার। কীটনাশকের অতিরিক্ত ব্যবহার এড়িয়ে চলতে হবে। সম্ভব হলে বিকল্প কীটনাশক ব্যবহার করার চেষ্টা করতে হবে, যা পরিবেশের জন্য হানিকর নয়। তা ছাড়া কৃষকদের পরামর্শ দিতে হবে যেন তারা জমিতে অধিক পরিমাণে কীটনাশক ব্যবহার না করেন। কীটনাশকের অধিক ব্যবহারে জমির উর্বরতা শক্তি কমে যায়, জীববৈচিত্র্য বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রতিদিন এর ব্যবহারে কীটপতঙ্গেরও প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। এটি কৃষি ক্ষেত্রে নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করে। এজন্য বিজ্ঞানীরা বিকল্প হিসেবে নিয়মিত জৈব সার এবং জৈব কীটনাশক ব্যবহার করার কথা বলছেন। এর ব্যবহার পরিবেশ ও জমির জন্য অত্যন্ত মঙ্গলজনক, এতে মাটির গুণাগুণ ঠিক থাকে। জৈব সার ও জৈব কীটনাশক পরিবেশের জন্য কম ক্ষতিকর। তাছাড়া ফসল ঘূর্ণায়মান ব্যবস্থার মাধ্যমে কীটপতঙ্গের আক্রমন কমাতে পারা যায়। তবে এজন্য সবার আগে দরকার সচেতনতা।
দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আমাদের দেশে কীটনাশকের যথেচ্ছ ব্যবহার হয়ে থাকে এবং তা-ও হয় নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে। এভাবেই আমাদের দেশ এবং কৃষিজমি ধীরে ধীরে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আমাদের সচেতন হওয়ার সময় এসেছে। তা ছাড়া এর ক্ষতিকর দিকটি সম্পর্কে কৃষকদের বুঝিয়ে দিতে হবে। এ কথাও ঠিক কীটনাশক বা রাসায়নিক পদার্থকে অনেকেই না বুঝে অভিশাপ মনে করেন। তারা ভুলে যান যে, বাতাসের যে অক্সিজেন আমাদের প্রাণ রক্ষা করে সেটাও কিন্তু রাসায়নিক পদার্থ। যে পানি আমাদের তৃষ্ণা মেটায় তাও, সেটাও রাসায়নিক পদার্থ। আমাদের নিত্যদিনের খাবার, নিত্যব্যবহার্য প্রসাধনী সামগ্রী, যানবাহনের জ্বালানি, পরিধেয় পোশাক আমাদের প্রতিদিনের নিত্যপ্রয়োজনীয় আসবাব, সবই তো রাসায়নিক পদার্থ বা রাসায়নিক যৌগ। এর বাইরে যাওয়া কোনোভাবেই সম্ভব নয়। আমাদের জীবন কাটাতে হবে রাসায়নিক পদার্থের মধ্যে। তবে এজন্য দরকার ভারসাম্য। যেখানে ভারসাম্য থাকে না, সেখানে পৃথিবীর জীববৈচিত্র্য হুমকির মধ্যে পড়ে। যেমন বাতাসের মধ্যে বিরাজমান অক্সিজেন আমাদের বাঁচিয়ে রাখে। এর পরিমাণ কম বা বেশি হলেই সমস্যার সৃষ্টি হয়। জীববৈচিত্র্য বিপদের মুখোমুখি হতে পারে। মূল কথা হলো প্রকৃতি ভারসাম্য পছন্দ করে। যেখানে ভারসাম্য থাকে না সেখানেই সমস্যার সৃষ্টি হয়। তাই কীটনাশকের ক্ষেত্রেও ভারসাম্য রক্ষা করে ব্যবহার করতে হবে।
কীটনাশক আমাদের জন্য অভিশাপ নয়, আশীর্বাদ হয়ে উঠতে পারে যদি এটিকে সুন্দরভাবে এবং নিয়মতান্ত্রিকভাবে ব্যবহার করা যায়। এর নিয়ন্ত্রিত প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। কীটনাশকের ভারসাম্যহীন ব্যবহার পৃথিবীর জন্য বিপদ ডেকে আনে। সব দিক বিবেচনা করে সবার জন্য একটু বাসযোগ্য ও নিরাপদ পৃথিবী গড়ে তোলার কাজে সবাইকে সচেতন হতে হবে। এ বিষয়ে শুধু নিজে সচেতন হলে চলবে না। নিজের সঙ্গে সঙ্গে অন্যদেরও সচেতন করে তুলতে হবে। এই সচেতনতাকে সঙ্গে নিয়ে আমরা দৃঢ় কণ্ঠে বলতে পারব ‘এ বিশ্বকে শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি/ নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।/ অবশেষে সব কাজ সেরে / আমার দেহের রক্তে নতুন শিশুকে/ করে যাব আশীর্বাদ,/ তারপর হব ইতিহাস।’