ট্যানারি শিল্প
ড. জাহাঙ্গীর আলম
প্রকাশ : ৩০ জুন ২০২৫ ১৫:৩৭ পিএম
ড. জাহাঙ্গীর আলম
এবারও কোরবানির চামড়ার মূল্যে ধস নামার চিত্র আমরা প্রত্যক্ষ করলাম। সরকার নির্ধারিত মূল্যের অর্ধেকও না পাওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন কোরবানির চামড়া থেকে প্রাপ্ত অর্থের ভাগীদার হতদরিদ্র মানুষ, এতিম ও মিসকিন। প্রতিবছরই কাঁচা চামড়ার সরবরাহ বাড়ে কোরবানির ঈদের সময়। তখন এর দাম কমে যায়। চামড়া পচনশীল বিধায় তা ধরে রাখা যায় না। এ সময় খুব তৎপর থাকেন অসাধু অনেক ব্যবসায়ী, আড়তদার ও ট্যানারির মালিকদের সিন্ডিকেট এবং তাদের এজেন্ট মৌসুমি ব্যবসায়ীরা। বিভিন্ন অজুহাতে তারা চামড়ার দাম কমান। এ সময় চামড়া উৎপাদনকারীদের দরকষাকষির তেমন সুযোগ থাকে না। যেটুকু মূল্য পায় তাতেই বিক্রি করে দিতে বাধ্য হন কাচা চামড়া। অথচ এর বিক্রয়লব্ধ অর্থের মালিক দরিদ্রজন, এতিম ও মিসকিন। চামড়ার দরপতনে সমূহ ক্ষতি হয় তাদেরই। আর্থিকভাবে বঞ্চিত হন তারা। তাতে বিঘ্নিত হয় দারিদ্র্যবিমোচন ও সামাজিক বৈষম্য হ্রাসের লক্ষ্য অর্জন।
জাতীয় অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ খাত চামড়া শিল্প। এ শিল্পের অধীনে দেশে ২২০টি ট্যানারি আছে। আরও আছে অসংখ্য জুতা, ব্যাগ, বেল্ট ও সুদর্শন সরঞ্জামাদি তৈরির কারখানা। তাতে সরাসরিভাবে নিয়োজিত রয়েছেন প্রায় ১ লাখ ৮০ হাজার শ্রমিক-কর্মচারী। স্থূল দেশজ আয়ে (জিডিপিতে) চামড়া শিল্পের শরিকানা প্রায় দশমিক ৪০ শতাংশ। মোট রপ্তানি আয়ে এ খাতের অবদান প্রায় ২ শতাংশ। তৈরি পোশাক শিল্পের পর রপ্তানি আয় অর্জনের ক্ষেত্রে এ খাতের স্থান কখনও দ্বিতীয়, কখনও তৃতীয়। বছরের পর বছর এ খাতের রপ্তানি আয় বাড়ছে। কিন্তু চামড়া উৎপাদনকারী কৃষক, প্রান্তজন, এতিম ও মিসকিন বাড়তি রপ্তানি আয়ের ন্যায়সংগত হিস্যা পাচ্ছেন না।
বাংলাদেশ রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য অনুসারে ২০১২-১৩ সালে দেশের চামড়া রপ্তানির আয় ছিল ৬৯২ দশমিক ৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০২২-২৩ সালে তা ১ হাজার ২২০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে বৃদ্ধি পায়। এ ১০ বছর চামড়াজাত পণ্য ও পাদুকা রপ্তানির আয় বেড়েছে। চামড়াশিল্পে বহুমাত্রিকতা ও বৈচিত্র্য এসেছে। বিদেশে সম্প্রসারিত হয়েছে আমাদের চামড়ার বাজার। অবশ্য গত চার বছর চামড়ার আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে কিছুটা ধীরগতি লক্ষ করা গেছে। করোনা ও সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক মন্দা এর প্রধান কারণ। তবে বাংলাদেশি চামড়ার রপ্তানি আয় গড়পড়তা বেড়েছে। কিন্তু কাঁচা চামড়ার উৎপাদনকারীরা এবং এর বিক্রয়লব্ধ অর্থের অংশীদাররা ঠকেছেন। তাদের চামড়ার ইউনিট মূল্য মাঠ পর্যায়ে কমেছে। ১০ বছর ধরে ক্রমাগতভাবে কমছে কাঁচা চামড়ার সংগ্রহমূল্য। ২০১৩ সালে ঢাকায় প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়ার দাম ছিল ৮৫-৯০ ও খাসি ৫০-৫৫ টাকা। ২০১৫ সালে এর ইউনিট মূল্য কমে প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়া ৫০-৫৫ এবং খাসি ২০-২২ টাকায় এসে দাঁড়ায়। ২০২০ সালে তা আরও কমে গরুর চামড়া প্রতি বর্গফুট ৩৫-৪০ এবং খাসি ১৩-১৫ টাকায় নেমে আসে। ২০২২ সালে তা কিছুটা বাড়িয়ে প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়া ঢাকায় ৪৭-৫২ এবং খাসি ১৮-২০ টাকায় নির্ধারণ করা হয়। ২০২৪ সালে তা আরও কিছুটা বাড়িয়ে ঢাকায় গরুর চামড়া ৫৫-৬০ টাকা, ঢাকার বাইরে ৫০-৫৫ এবং খাসি ২০-২৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়। এবার প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত গরুর চামড়ার দাম ঢাকায় ৬০-৬৫ এবং ঢাকার বাইরে ৫৫-৬০ টাকা নির্ধারণ করা হয়। খাসির চামড়ার ক্রয়মূল্য প্রতি বর্গফুট ২২-২৭ এবং বকরি ২০-২২ টাকা নির্ধারণ করা হয়। ঢাকায় প্রতি পিস গরুর চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয় সর্বনিম্ন ১ হাজার ৩৫০ টাকা। আর ঢাকার বাইরে সর্বনিম্ন দাম নির্ধারণ করা হয় ১ হাজার ১৫০ টাকা। এ মূল্যবৃদ্ধি সাম্প্রতিক মূল্যস্ফীতির হারের চেয়ে বেশি নয়। কিন্তু এবার কোরবানির দিন ও তার পরে তৃণমূল পর্যায়ের চামড়া উৎপাদনকারীরা নির্ধারিত দামের অর্ধেকও পাননি। বর্গফুটের পরিমাপে চামড়া বিক্রি হয়নি কোথাও। প্রতি পিস হিসেবে গরুর চামড়া বিক্রি হয়েছে ঢাকার বাইরে ২০০-৪০০ এবং ঢাকায় ৫০০-৭০০ টাকায়। খাসির চামড়া বিক্রি হয়েছে ২৫-৩০ টাকায়। অনেকে চামড়ার উপযুক্ত দাম না পেয়ে রাস্তার পাশে ছুড়ে ফেলেছেন অথবা পুঁতে ফেলেছেন মাটির নিচে। কোথাও কোথাও গরুর চামড়ার সঙ্গে খাসির চামড়া ফ্রি দেওয়া হয়েছে।
দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রাপ্ত তথ্যের বরাত দিয়ে গত ৭ ও ৮ জুন প্রকাশিত জাতীয় দৈনিক পত্রিকাগুলোর অনলাইন ভার্সনে চামড়ার দরপতনের যে চিত্র তুলে ধরা হয় তা ছিল খুবই হতাশাব্যঞ্জক। গ্রাম বা মফস্বলে কোরবানিদাতারা পানির দরে বিক্রি করেছেন চামড়া। কোনো কোনো এলাকায় ১০০-২০০ টাকা দরেও গরুর চামড়া বিক্রি হয়েছে। অনেক এলাকায় মৌসুমি ব্যবসায়ীদের তেমন দেখা না পেয়ে বিনামূল্যে চামড়া দিয়ে দিয়েছেন গ্রাম ও নগরবাসী। ট্যানারি ও আড়ত মালিকদের কারসাজিতে সরকারের বেঁধে দেওয়া কোরবানির পশুর চামড়ার দাম কোথাও কার্যকর হয়নি।
বাংলাদেশে যে পরিমাণ চামড়া উৎপাদন হয় তার প্রায় অর্ধেক পাওয়া যায় কোরবানির ঈদে। এর মোট আকার প্রায় ২৫ কোটি বর্গফুট। এতে গরুর চামড়া রয়েছে ৬৪ দশমিক ৮ শতাংশ, ছাগলের চামড়া ৩১ দশমিক ৮ শতাংশ, মহিষের চামড়া ২ দশমিক ২ শতাংশ, ভেড়ার চামড়া ১ দশমিক ২ শতাংশ। বর্তমান বাজার দরে এর ক্রয়মূল্য হবে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা। মোট উৎপাদিত চামড়ার ক্রয়মূল্য এবং তার প্রক্রিয়াকরণ খরচ মিলে দাঁড়াবে প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা। আন্তর্জাতিক বাজারে তা রপ্তানি করে বিক্রয়লব্ধ আয় হচ্ছে প্রায় ১২-১৬ হাজার কোটি টাকা। এ ক্ষেত্রে ক্রয়মূল্য এবং রপ্তানি ও প্রক্রিয়াজাতকরণ খরচ বাদ দিলেও প্রচুর লাভ হওয়ার কথা চামড়া ব্যবসায়ীদের। তার ওপর শতকরা ১০ ভাগ হারে রপ্তানি সহায়তা দিচ্ছে সরকার। এমতাবস্থায় চামড়া ক্রয়ে ট্যানারি মালিকদের অনীহা ও কাঁচা চামড়ার ক্রয়মূল্যে লাগাতার ধস নামার কারণ ভালোভাবে খতিয়ে দেখা দরকার।
এক সমীক্ষা থেকে দেখা যায়, প্রতি বর্গফুট চামড়া প্রক্রিয়াজাত করার পর ট্যানারির মালিকরা ২৫-৩০ টাকা লাভ করে থাকেন। বিদেশে ফিনিশড লেদার বিক্রি এবং চামড়াজাত পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে এ লাভের মাত্রা আরও বেশি হতে পারে। এমতাবস্থায় নিরপেক্ষ সমীক্ষার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক বাজার পর্যন্ত চামড়ার ভ্যালু চেন বিশ্লেষণ করা দরকার।
মূল্যস্ফীতি ও আর্থিক স্থবিরতায় মানুষের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পাওয়ায় এবার কোরবানির পশুর চাহিদা স্বাভাবিক অবস্থার চেয়ে কম ছিল। পরিসংখ্যান বলছে, এবার ৯১ লাখ ৩৬ হাজার ৭৩৪টি পশু কোরবানি হয়েছে। গত বছরের তুলনায় সংখ্যাটি প্রায় ১৩ লাখ কম। এবার কোরবানিকৃত পশুর মধ্যে গরু-মহিষ ছিল ৪৭ লাখ ৫ হাজার ১০৬টি, ছাগল-ভেড়া ছিল ৪৪ লাখ ৩০ হাজার ৬৬৮টি এবং অন্যান্য পশু ৯৬০টি। তার বিপরীতে এবার পশুর জোগান ছিল ১ কোটি ২৪ লাখ ৪৭ হাজার ৩৩৭টি। এর মধ্যে ছিল ৫৬ লাখ ২ হাজার ৯০৫টি গরু-মহিষ, ৬৮ লাখ ৩৮ হাজার ৯২০টি ছাগল-ভেড়া এবং ৫ হাজার ৫১২টি অন্যান্য প্রাণী। ফলে এবার কোরবানিযোগ্য পশুর সরবরাহে উদ্বৃত্ত ছিল বড় অঙ্কের। অবিক্রীত মোট পশুর সংখ্যা ছিল ৩৩ লাখ ১০ হাজার ৬০৩টি। তবু মূল্য কিছুটা বেড়েছে কোরবানির পশুর। পশুখাদ্য ও ওষুধের মূল্যবৃদ্ধি এর প্রধান কারণ। রাজনৈতিক পটপরিবর্তন, অস্থির সামাজিক অবস্থা, উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও আর্থিক স্থবিরতার কারণে এবার কোরবানির পশুর কার্যকর চাহিদা ছিল কম। প্রথমে ধারণা করা হয়েছিল যে মোট ৮০-৯০ লাখ চামড়া এবার সংগ্রহ করা যাবে। এখন জানা যাচ্ছে, সংগৃহীত চামড়ার সংখ্যা দাঁড়াবে ৭০ লাখ।
সম্প্রতি দেশে গরুর দাম বাড়ছে। চমড়ার দাম মাঠ পর্যায়ে কমছে। বিশেষ করে কোরবানির পশুর চামড়া বিক্রি করা এবং তার উপযুক্ত দাম পাওয়া একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কয়েক বছর ধরে চামড়ার মূল্যে বড় ধরনের ধস আমরা লক্ষ করছি। সে ক্ষেত্রে ব্যবস্থাপনার ব্যর্থতা বড় কারণ। এর প্রতিকার দরকার। আন্তর্জাতিক দামের সঙ্গে সংগতি রেখে দেশের চামড়ার মূল্য নির্ধারণ করা উচিত। নির্ধারিত মূল্যে যাতে কৃষকদের কাছ থেকে চামড়া ক্রয় করা হয়, তাও নিশ্চিত করতে হবে। কোরবানির চামড়ার বিক্রয়লব্ধ অর্থের মালিক দরিদ্রজন, এতিম ও মিসকিন। ফলে প্রান্তিক পর্যায়ে চামড়ার ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা সবারই দায়িত্ব। এ ক্ষেত্রে সরকারের দায় বেশি। সরকার নির্ধারিত মূল্যে চামড়া বিক্রি হওয়ার কথা বলা হলেও বাস্তবের সঙ্গে তার মিল নেই। ১১ জুন প্রকাশিত একটি জাতীয় দৈনিকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, রাজধানীর পোস্তগোলায় ছোট ও মাঝারি আকারের গরুর চামড়া বিক্রি হয়েছে ২০০-৪০০ টাকায়। আর বড় গরুর চামড়া বিক্রি হয়েছে ৪০০-৭০০ টাকায়। সরকার বলেছে, এবার ৩০ হাজার টন লবণ বিনামূল্যে মাদ্রাসা ও এতিমখানায় দেওয়া হয়েছে চামড়া সংরক্ষণের জন্য। পর্যাপ্ত গাইডলাইনও দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে তার কার্যকারিতা কম। প্রয়োজনীয় হিমাগার ও সংরক্ষণ ব্যবস্থা না থাকলে এবং ব্যবসায়ীদের অসাধু আঁতাত ভাঙতে না পারলে প্রান্তিক পর্যায়ে কাঁচা চামড়ার উপযুক্ত মূল্য পাওয়া সম্ভব হবে না।
বাংলাদেশের চামড়া রপ্তানি হয় প্রধানত চীন দেশে, অপেক্ষাকৃত কম দামে। ইউরোপে বাংলাদেশের চামড়ার উপযুক্ত বাজার না পাওয়ার একটা বড় কারণ এলডব্লিউজি (লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপ) সনদ না থাকা। এ ক্ষেত্রে সাভার চামড়া শিল্পের কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগার বা সেন্ট্রাল ইফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্লান্ট (সিইটিপি) পুনর্নির্মাণ করা প্রয়োজন। তাতে খরচ হতে পারে ৫০০-৬০০ কোটি টাকা। চামড়া শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা এবং সরকার যৌথভাবে এ ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করতে পারেন। বাংলাদেশে মাত্র ৮টি কোম্পানি এখন এলডব্লিউজি সনদপ্রাপ্ত। তার বিপরীতে ভারতে এলডব্লিউজি সনদপ্রাপ্ত কোম্পানির সংখ্যা ২৪৮টি, পাকিস্তানে ৪১টি এবং থাইল্যান্ডে ২২টি। বাংলাদেশে শতাধিক কোম্পানি ওই সনদ নিতে পারে। সম্প্রতি ওয়েট ব্লু চামড়া রপ্তানির কথা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে বলা হচ্ছে। কিন্তু তা কার্যকর হচ্ছে না। অভিযোগ রয়েছে তাতে একটি সিন্ডিকেট চাপ দিয়ে যাচ্ছে। কারণ কাঁচা চামড়া রপ্তানি হলে দেশে চামড়ার দাম বেড়ে যাবে। প্রান্তিক পর্যায় থেকে পানির দামে কোরবানির চামড়া কেনা সম্ভব হবে না। চামড়া শিল্পের কথিত এ সিন্ডিকেট অকার্যকর করার জন্য সংশ্লিষ্ট সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। বর্তমানে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের আন্তর্জাতিক বাজারের আকার ৪৩৫ দশমিক ৯৬ বিলিয়ন ডলার। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের শরিকানা মাত্র দশমিক ২৩ শতাংশ। এ হিস্যা ন্যূনপক্ষে ১ শতাংশে উন্নীত করতে হলে চামড়ার উৎপাদন ও মূল্য স্থিতিশীল করা উচিত।