সামাজিক ব্যবসা
সম্পাদকীয়
প্রকাশ : ২৯ জুন ২০২৫ ১৮:৩৮ পিএম
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, সামাজিক ব্যবসা শুধু বাংলাদেশ নয়, বরং পুরো বিশ্বকে বদলে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। এটি নতুন সভ্যতাও গড়তে পারে। এই ব্যবসার মাধ্যমে একটি সুন্দর ও উন্নত বিশ্ব গড়ে তোলা সম্ভব, যা বর্তমান হতাশার মুক্তি দিতে পারে। তিনি সামাজিক ব্যবসার রূপান্তর সক্ষম শক্তি এবং এর মাধ্যমে ইতিবাচক টেকসই পরিবর্তন আনার শক্তিশালী উপায়ের ওপর গুরুত্ব বোঝাতে গিয়ে উল্লিখিত উক্তি করেছেন। শুক্রবার সাভারের জিরাব সামাজিক কনভেনশন সেন্টারে, দু’দিনের ‘সোশ্যাল বিজনেস ডে’-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ‘সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণে সর্বোত্তম পথ হলো সামাজিক ব্যবসা’ শীর্ষক আলোচনায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। উল্লেখ্য, ইউনূস সেন্টার ও গ্রামীণ গ্রুপ যৌথভাবে এই দিবসের আয়োজন করে।
অনুষ্ঠানে তরুণদেরকে বৈশ্বিক পরিবর্তন আনার আহ্বান জানিয়ে ড. ইউনূস বলেন, উদ্যোক্তা হিসেবে ছোট থেকে শুরু করতে হবে, বড় স্বপ্ন দেখতে হবে এবং একসঙ্গে কাজ করে এমন একটি বিশ্ব গড়ে তুলতে হবে, যার ভিত্তি হবে ‘থ্রি জিরো’ ‘জিরো দারিদ্র্য, জিরো বেকারত্ব এবং জিরো গড় কার্বননিঃসরণ’। চাকরি প্রার্থী নয়, উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেকে প্রস্তুত করার মতো শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার ওপর তিনি গুরুত্বারোপ করেন। বিশ্লেষকদের মতে, ‘সামাজিক’ শব্দটি সাধারণত মানুষের কল্যাণ, মানবতা ও সেবার প্রতীক। আর ‘ব্যবসা’ মানেই মুনাফা, ব্যক্তিগত স্বার্থ এবং বাজারকেন্দ্রিক চিন্তাভাবনা। একদিকে নিঃস্বার্থ সেবা, অন্যদিকে লাভের হিসাব। এর বাস্তবতা হলো, এই শব্দ দুটি যখন এক হয় তখন তারা বিপরীত ধারার সংযোগস্থলে দাঁড়িয়ে নতুন সম্ভাবনার সৃষ্টি করে। যার মূল লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায় সামাজিক সমস্যার সমাধান।
২৮ জুন প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এ ‘সামাজিক ব্যবসা বদলে দিতে পারে পুরো বিশ্বকে’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এই বিষয়টি উঠে এসেছে। এ কথা স্বীকার করতেই হবে, ‘সামাজিক ব্যবসা’ বিশ্ব অর্থনীতিতে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে। এই মূলনীতির প্রবক্তা, গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা এবং ‘ক্ষুদ্রঋণ’ ধারণার পথপ্রদর্শক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তার মতে, দারিদ্র্য সমাজ দ্বারা সৃষ্ট। তাই এটি সমাজ থেকেই দূর করতে হবে। সেই বিশ্বাস থেকে তার ক্ষুদ্রঋণভিত্তিক ‘গ্রামীণ ব্যাংক’ মডেল এরই মধ্যে বিশ্বব্যাপী দারিদ্র্য নিরসনের এক স্বীকৃত ফর্মুলা। আর এই ‘ভিত্তি’র ওপর দাঁড়িয়েই তিনি এবং তার গ্রামীণ ব্যাংক ২০০৬ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার লাভ করে। সামাজিক ব্যবসার ধারণাটিও তার সেই আত্মবিশ্বাসের স্বপ্ন। যার মূল লক্ষ্য হলো অর্জিত মুনাফাকে ব্যক্তিগত স্বার্থের চেয়ে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটানো। পাশাপাশি এমন পণ্য ও পরিষেবা উত্পাদনে যুক্ত করা, যা বিশ্বকে আরও সহায়তায় ভূমিকা রাখতে সক্ষম। তার মতে, এর বার্তা হলো পৃথিবীকে বদলে দেওয়ার এবং এর জন্য প্রয়োজন প্রতিটি জাতির অংশগ্রহণ। তার আশাবাদ এর মাধ্যমে বাংলাদেশ শুধু নিজের ইতিহাস নয়, বরং পুরো বিশ্বের জন্য একটি ইতিহাস হয়ে উঠবে।
আসলে প্রচলিত ব্যবসায়, প্রতিষ্ঠানের মূল লক্ষ্য মুনাফা অর্জন। যে প্রতিষ্ঠান বেশি মুনাফা করে, তার প্রতি সবার আকর্ষণ থাকে। তাদের প্রতিষ্ঠানকে ‘সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জনকারী প্রতিষ্ঠান’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। এদের মধ্যে মুনাফা বৃদ্ধির প্রতিযোগিতা হয়ে থাকে। অন্যদিকে সামাজিক ব্যবসার কোম্পানিগুলো নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা করবে, কোন ব্যবসায়ী কত দক্ষতার সঙ্গে সমাজের সমস্যা সমাধান দিতে পারে, তার ওপর নির্ভর করবে প্রতিযোগিতার সাফল্য। আর একটা বিষয়, সামাজিক ব্যবসায়ে বিনিয়োগকারীরা শুধু টাকাই বিনিয়োগ করবেন না, তাদের সৃষ্টিশীলতা, যোগাযোগের দক্ষতা, প্রযুক্তিগত মেধা, অভিজ্ঞতাসহ অনেক কিছুই বিনিয়োগ করে বিশ্বটা পাল্টে দিতে পারেন। সহজ করে বললে, সামাজিক ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে মূলনীতি দারিদ্র্যবিমোচনসহ শিক্ষা, স্বাস্থ্য, প্রযুক্তি ও পরিবেশগত খাতে বিরাজমান সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিগত মুনাফাহীন কল্যাণকর ব্যবসা। সবার সক্ষমতা অর্জন করাই এ ব্যবসায়ের লক্ষ্য।
এ কথা সত্য যে, এ ধরনের ব্যবসা সামাজিক উপকারের ক্ষেত্র তৈরি করে সাধারণ গরিব মানুষকে সচ্ছল বানিয়ে দেয়। প্রসঙ্গক্রমে বলা যায়, যেমন গ্রামীণ ব্যাংক গরিবদের স্বল্প সুদে ক্ষুদ্রাকারের ঋণ দেয়, যাতে তারা ছোটখাটো ব্যবসা করে নিজেদের দারিদ্র্যের হাত থেকে মুক্ত করতে পারে। আর প্রথাগতভাবে যদি ধনীরা এই ব্যাংকের মালিক হতো, তাহলে গ্রামীণ ব্যাংক রীতিমতো একটা সর্বোচ্চ মুনাফাকারী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হতো। গ্রামীণ ব্যাংকের মালিক ঋণগ্রহীতারা ৭৫ শতাংশ। মালিকরা লভ্যাংশের ভাগ পায়। এরাই ব্যাংকের নীতিনির্ধারক। এদের মালিক করার কারণেই ব্যাংকিং কার্যক্রমে স্বচ্ছতা সর্বক্ষেত্রে পরিলক্ষিত হয়।
আমরা মনে করি, আগামীর নতুন বাংলাদেশ গড়তে সরকার, উন্নয়নকর্মী, উদ্যোক্তা, শিক্ষাবিদ এবং তরুণ সমাজÑ সবাই মিলে যদি এই দর্শনকে আত্মস্থ করি, তাহলে সামাজিক ব্যবসা আমাদের দেশের বেকারত্বের ‘অভিশাপ’সহ দরিদ্রতার সকল অচলায়তন ভেঙে দিতে পারে। আমরা দরিদ্র জনগোষ্ঠীর স্বার্থে, বঞ্চিত মানুষের স্বার্থে, শান্তিময় বিশ্ব গড়তে, বিশ্বের অসংখ্য বেকারের সোনালি ভবিষ্যতের স্বার্থে সামাজিক উদ্যোক্তা ও সামাজিক ব্যবসার সাফল্য কামনা করছি। আমরা চাই, সামাজিক ব্যবসা হয়ে উঠুক বিশ্বের দারিদ্র্যবিমোচনের হাতিয়ার।