অপরিকল্পিত নগরায়ণ
সম্পাদকীয়
প্রকাশ : ২৪ জুন ২০২৫ ১৭:১৬ পিএম
দেশে অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে ভূমি ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের পরিবর্তন দেখা দিয়েছে। জানা গেছে, ২০১৫ থেকে ২০২৩Ñ এই আট বছরে কৃষি ও বনভূমি কমে যাওয়ার বিপরীতে নগরায়িত এলাকায় জলাশয়ের পরিমাণ বেড়েছে। একই সময় দেশের কৃত্রিম বনায়ন বাড়লেও ঘন জঙ্গল কমে গেছে উল্লেখযোগ্য হারে। সেই হারে বাড়ছে নগরায়ন। এভাবে কৃষিজমি ও বনভূমির ওপর এই ক্রমাগত পরিস্থিতি পরিবেশ, খাদ্য নিরাপত্তা ও জলবায়ু অভিযোজন ব্যবস্থার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। বিশ্লেষকরা বলছেন, আমাদের কৃষিজমির পরিমাণ কমছে, কারণ আমরা এসব জমি ধ্বংস করে ঘরবাড়ি বানাচ্ছি। একই কারণে বন কমে যাচ্ছে, ফলে বন্য প্রাণী চলাচলের জায়গা কমে যাচ্ছে। যা জীববৈচিত্র্যের জন্য হুমকিস্বরূপ। রবিবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ের পরিসংখ্যান ভবনে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) প্রকাশিত ‘পরিবেশ, জলবায়ু পরিবর্তন ও দুর্যোগ পরিসংখ্যান ২০২৪’-শীর্ষক প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে।
বিবিএসের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ২৩ জুন প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এ প্রকাশিত ‘কৃষিজমি ও বন কমে বাড়ছে নগরায়ণ’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৫-২৩ সালের মধ্যে দেশের কৃষিজমির পরিমাণ ৭৪ হাজার ৩৮৬.৬৩ বর্গকিমি থেকে কমে দাঁড়িয়েছে ৭২ হাজার ৯১৫.৭৪ বর্গকিমিতে। যা মোট ভূমির ৫০.৪১ শতাংশ থেকে নেমে এসেছে ৪৯.৪১ শতাংশে। এ সময়কালে কৃষিজমি কমেছে ১.৯৮ শতাংশ। শহরায়ণ ও শিল্পায়নের চাপ এ হ্রাসের পেছনে মূল কারণ হিসেবে বলা হয়েছে। একই সময়ের মধ্যে দেশের বনভূমিও সংকুচিত হয়েছে। ২০১৫ সালে দেশের বনভূমির পরিমাণ ছিল ১৮ হাজার ৪৯৯.০৮ বর্গকিমি, যা ২০২৩ সালে কমে দাঁড়িয়েছে ১৭ হাজার ৪৯৮.১৮ বর্গকিমিতে। ফলে কমেছে ৫.৪১ শতাংশ। এর মধ্যে ‘অন্যান্য বনভূমি’ শ্রেণিতে হ্রাসের হার সবচেয়ে বেশিÑ ১৯.৮৬ শতাংশ। অন্যদিকে, নগরায়ণ এবং শিল্পোন্নয়নের ফলে আর্টিফিশিয়াল সারফেস বা বিল্টআপ এরিয়া বেড়েছে ৩৩ হাজার ১৩৯.৮৩ বর্গকিমি থেকে ৩৪ হাজার ৭২.৯০ বর্গকিমিতে, যা মোট ভূখণ্ডের ২৩.০৯ শতাংশ। এতে ২০১৫ সালের তুলনায় নগরায়ণ বেড়েছে ২.৮২ শতাংশ। জলাশয়ের পরিমাণেও বড় পরিবর্তন এসেছে। ২০১৫ সালে ভূ-অভ্যন্তরীণ জলাশয় তথা নদী, খাল, বিল ও হ্রদের জমি ছিল ১৮ হাজার ১২০.০৫ বর্গকিমি। ২০২৩ সালে তা বেড়ে হয়েছে ১৯ হাজার ১৯৬.১২ বর্গকিমিÑ বৃদ্ধির হার ৫.৯৪ শতাংশ। উপকূলীয় জলাশয় ও মোহনার এলাকা বেড়েছে ৬৪.৮৬ শতাংশ, যা বর্তমানে ১,২৫০.৪৮ বর্গকিমি।
প্রতিবেদন আরও বলছে, ঘন জঙ্গল ও গুল্মভূমির ক্ষেত্রেও সংকোচন ঘটেছে। ঘাস ও ঝোপঝাড়ের জমি কমেছে যথাক্রমে ১৯.৮৬ শতাংশ ও ২১.৩৩ শতাংশ। এতে বন্য প্রাণীর বিচরণক্ষেত্র সংকুচিত হচ্ছে এবং জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে নতুন চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি হচ্ছে। তবে ইতিবাচক দিকও রয়েছে, ২০১৫ সালে দেশে কৃত্রিম বন ছিল ১,৩৪১.৪৮ বর্গকিমি, যা ২০২৩ সালে বেড়ে হয়েছে ১,৭০৮.৫৩ বর্গকিমিÑ বৃদ্ধির হার ২৭.৩৬ শতাংশ। অনুৎপাদনশীল জমির ব্যবহার কিছুটা বাড়ায় অব্যবহৃত জমির পরিমাণ ১.১ শতাংশ কমেছে। এভাবে কৃষিজমি ও বনভূমি পরিমাণ কমে গেলে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা কঠিন হয়ে পড়বে।
বাংলাদেশ আয়তনে বিশ্বের একটি ছোট্ট ভূখণ্ড। এর জনসংখ্যা ১৮ কোটি ছাড়িয়ে গেছে। দেশে দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে বসবাসের জন্য বাড়িঘর তৈরিতে জমির চাহিদা বাড়ছে। ফলে ধারাবাহিকভাবে কৃষিজমির পরিমাণ আশঙ্কাজনক হারে কমছে। একই কারণে জলাভূমি ভরাট, দোকানপাট নির্মাণ, হাউজিং সোসাইটি, ইটভাটাতে বনভূমি ধ্বংস করার আত্মবিনাশী প্রক্রিয়া চলছে। এখানকার মাথাপিছু আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ খুবই সামান্য। এভাবে নগরায়ণে যদি কৃষিজমি দ্রুত হারে কমে, তাহলে এই বিপুল জনসংখ্যক জনগোষ্ঠীর খাদ্যের জোগান রীতিমতো চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। আসলে আমরা আমাদের সম্পদ নিজেরাই নষ্ট করছি।আমাদের কৃষিজমিতে এখন জিংক নেই। ফলে অনেকের প্রতিবন্ধী সন্তান জন্ম হচ্ছে। আগে হাওর এলাকায় প্রচুর খালি জমি ছিল। এখন সেখানেও নগরায়ণের ছোঁয়া লেগেছে।
অপ্রিয় হলেও সত্য যে, আমাদের ভূমি ব্যবস্থাপনা এখনও সুশৃঙ্খলভিত্তির ওপর দাঁড়াতে পারেনি। অথচ জাতীয় ভূমি ব্যবহার নীতি ২০১০ এবং ‘কৃষিজমি সুরক্ষা ও ভূমি জোনিং আইন ২০১০’-এ স্পষ্ট করে বলা আছে, কোনো কৃষিজমি ভরাট করে বাড়িঘর, শিল্পকারখানা, ইটভাটা বা অন্য কোনো অকৃষি স্থাপনা কোনোভাবেই নির্মাণ করা যাবে না। অথচ সরকারি উদ্যোগেই অবকাঠামো নির্মাণ এবং শিল্পকারখানার জন্য প্রতিনিয়ত অধিগ্রহণ হচ্ছে কৃষিজমি ও বনভূমি। বিবিএসর প্রতিবেদনই এর বড় প্রমাণ।
এ কথা সত্য যে, বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা আর অস্থিরতার মধ্যেও দেশকে অনেকটা স্বাভাবিক রাখছে কৃষি। আর বনভূমি জীববৈচিত্র্যের ভারসাম্য রক্ষা করছে। সে কারণেই কৃষিজমি ও বনভূমি সুরক্ষা জরুরি। এসব জমির যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে দরকার ভূমি ব্যবহার পরিকল্পনা ও নীতিমালা। আমরা মনে করি, কৃষিজমি অকৃষি খাতে ব্যবহারের প্রবণতা কঠোরভাবে রুখতে হবে। আমরা মনে করি, সময়ের প্রয়োজনে নগরায়ণ হবে, শিল্পায়ন হবে, কিন্তু কৃষিজমি ও বনভূমি ধ্বংস করে নয়। তবে আশার কথা সম্প্রতি,অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেছেন, শিগগির কৃষিজমি সুরক্ষা আইন পাস করা হবে। সেখানে কৃষিজমি ও কৃষকের সুরক্ষার কথা থাকবে। আমরা মনে করি, কৃষি ও বনভূমি বাঁচাতেই হবে।