× ই-পেপার প্রচ্ছদ সর্বশেষ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি শিক্ষা ধর্ম ফিচার ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

শ্রদ্ধায় নত

সময় বহিয়া যায়

হোসেন আবদুল মান্নান

প্রকাশ : ২৪ জুন ২০২৫ ১৭:১৩ পিএম

হোসেন আবদুল মান্নান

হোসেন আবদুল মান্নান

আশির দশকের শেষ দিকের কথা। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের পশ্চিম পাশে এখনকার রাজু ভাস্কর্যের সোজা পূর্বদিকে একটা গোল চক্করের মতন জায়গা ছিল। মাটি থেকে এক-দেড় ফুট উঁচু ওয়ালের মতো বসার স্থান ছিল। উদ্যানে হাঁটাহাঁটি করার পর খোলা আকাশের নিচে অনেকেই সেখানটায় একটু জিরিয়ে যেতেন। তবে স্থানটি প্রায় নির্ধারিত ছিল প্রথাবিরোধী লেখক, বয়োবৃদ্ধ বিপ্লবী ও আমৃত্যু প্রতিবাদী অধ্যাপক ড. আহমদ শরীফের জন্য। যারাই বসতেন শরীফ স্যার এলেই উঠে সসম্মানে স্থান ছেড়ে দিয়ে পাশে দাঁড়াতেন। সে সময় কাউকে বসে থাকতে দেখিনি। ড. আহমদ শরীফ উদ্যানে প্রায় এক ঘণ্টা হাঁটতেন। তখন উদ্যানে দলবেঁধে হাঁটার চমৎকার ট্র্যাক ছিল। উত্তর দিকের শিশু পার্ক, ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট হয়ে বাংলা একাডেমির সামনের পুকুরের পাড় দিয়ে ঘুরে আসা যেত। তিনি হাঁটতে হাঁটতেও কথা বলতেন। যেন কথা বলাতেই তার আনন্দ ছিল। বৈকালিক হাঁটায় বেশিরভাগ সময়ে তার সহগামী হতেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিখ্যাত 

দুই দিকপাল অধ্যাপক- অধ্যাপক ড. আবদুল্লাহ ফারুক এবং অধ্যাপক মমতাজুর রহমান তরফদার। ড. ফারুক ছিলেন মার্কেটিং বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একসময়ের ট্রেজারার। তিনি পরিকল্পনা কমিশনের সদস্যও ছিলেন। ড. তরফদার ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন। তিনি দেশের সাহিত্য-সংস্কৃতির আন্দোলনের অন্যতম একজন একনিষ্ঠ সংগঠকও ছিলেন। 

শরীরের ঘাম মুছতে মুছতে শরীফ স্যার ইশারায় বলতেন, সকলেই বসো। বসা মানে উদ্যানের সবুজ ঘাসে গোল হয়ে বসা। তার দু’পাশে দুই মহারথী। সেকালের দুই মেধাবী অধ্যাপক। সামনে ঘাসের কার্পেটে আসন পেতে বসে আছেন ১৫ থেকে ২০ জন উৎসুক আগন্তুক। এরা শরীফ স্যারের অপরিচিত তবে সকলই শ্রোতা। বেশিরভাগই ছাত্র, অন্যান্য পেশাজীবীও হবে। মনে পড়ে, মাঝেমধ্যে প্রয়াত অধ্যাপক ড. হুমায়ুন আজাদকেও পেয়েছি। তিনি অধ্যাপক শরীফের সরাসরি ছাত্র এবং ভাবশিষ্যতুল্য ছিলেন। তবে তখনও তার স্থান ঘাসের আসনেই ছিল। সমাসনে নয়। আলোচনার বিষয়বস্তু কখনও নির্ধারিত করা থাকত না। কেউ বিশেষ কোনো ইস্যু উত্থাপন করলে শরীফ স্যার মন্তব্য করতেন। এ ক্ষেত্রে অনুঘটকের ভূমিকা পালন করতেন ড. আবদুল্লাহ ফারুক। তার কথায় সারাক্ষণ পাবনা অঞ্চলের রসবোধের সংশ্লেষ জড়িয়ে থাকত। তিনি আলোচনা জোরালো করার স্বার্থে প্রশ্নকারী ছাত্রটিকে সহযোগিতা করে অধ্যাপক আহমদ শরীফকে কিছুটা উস্কে দিতেন। শরীফ স্যারের ভাষা ছিল শাণিত ছুরির মতন ধারালো, যুক্তি ও তথ্যের অকাট্যতায় সব সময় বিমোহিত হতো তরুণ শ্রোতার দল। তার বলায়, শব্দ চয়নে ও কণ্ঠস্বরের গাম্ভীর্যের মাহাত্ম্য ছিল অসাধারণ এবং অননুকরণীয়। যদিও সামনাসামনি মনে হতো, তিনি খানিকটা উত্তেজিত কর্তৃত্ববাদী উপস্থাপক। 

একদিন বিকালে প্রসঙ্গক্রমে কেউ একজন বললেন, আজকের দৈনিক সংবাদ পত্রিকার ‘গাছপাথর’-এর কলাম ‘সময় বহিয়া যায়’ এতে দেশের বামপন্থিদের করণীয় নিয়ে একটা ভালো লেখা ছাপা হয়েছে। ‘তাতে কী লেখা হয়েছে’, জানতে চান অধ্যাপক আহমদ শরীফ। সঙ্গে সঙ্গে স্বগতোক্তির মতো করে তিনি নিজেই বললেন,- ‘তার লেখায় কেমন যেন ইনিয়েবিনিয়ে পেঁচিয়ে বাক্য তৈরি করা হয়। তিনি কি বলতে চান তাও স্পষ্ট হয় বলে মনে হয় না’। উল্লেখ করা যায়, সেই বিখ্যাত কলামটির লেখক ছিলেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। 

আশ্চর্যের বিষয় হলো, ঘটনার এক দশক বাদে ১৯৯৯ সালের একুশের বইমেলায় আগামী প্রকাশনী কর্তৃক প্রকাশিত হয় অধ্যাপক আহমদ শরীফের ‘নির্বাচিত প্রবন্ধ’। দুঃখজনক এবং সত্য যে, বইটা যেদিন মেলায় পৌঁছে এর আগের দিন রাতে অর্থাৎ ২৪ ফেব্রুয়ারিতে অধ্যাপক ড. আহমদ শরীফ আকস্মিক মৃত্যুবরণ করেন। কিন্তু বইয়ের প্রথম পৃষ্ঠার উৎসর্গ অংশে লেখা হলোÑ উৎসর্গ, ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী প্রিয়বরেষু। 

যা হয়তো অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী নিজেও কখনও ভাবেননি। এ-ই ছিলেন অধ্যাপক ড. আহমদ শরীফ এবং তার অভাবনীয় ব্যক্তিত্বের অনিঃশেষ ভুবন। উল্লেখ্য, তার প্রয়াণের অব্যবহিত পরের প্রথম স্মরণ সভায় ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী মনোমুগ্ধকর এক বক্তব্য রেখেছিলেন। 

বলাবাহুল্য, উভয় অধ্যাপক ছিলেন বাম ঘরানার চিন্তাবিদ, সমাজতান্ত্রিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পর্যবেক্ষক, মার্কসীয় শিল্প-সাহিত্যের নিরলস পাঠক। এঁদের শ্রেণিবিভক্ত সমাজকে নিরীক্ষণ ও বিশ্লেষণের মূল চালিকাশক্তি ছিল মার্কসীয় দর্শন। তারা উভয়ই দেশের একাধিক বাম রাজনৈতিক দলের আনুষ্ঠানিকতায় আমন্ত্রিত হয়ে যোগদান করেছেন। যা তাদের ভাবনার জগৎকে সব সময় একই সূত্রে বেঁধে রেখেছিল। 

দেশের বরেণ্য শিক্ষাবিদ, লেখক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী নবতিপর হয়েছেন। তিনি ৯০ বছরের দীর্ঘ সচল জীবন পেয়েছেন। যা নিঃসন্দেহে আনন্দের এবং সকলের প্রত্যাশার। তার জন্মদিন মানে হাজারো ভক্ত-অনুরাগীর লেখা, স্মৃতি-মন্থন ও পুষ্পাঞ্জলির বৃষ্টিতে তাকে সিক্ত করে তোলা। তার অনন্য সাধারণ যাপিত জীবনের এক বিস্ময়কর জাদুতে তিনি প্রতিদিন সতেজ ও কর্মক্ষম আছেন। তিনি প্রবন্ধে, কলামে, সাক্ষাৎকারে অনবরত সৃষ্টি করে চলেছেন সমাজ পরিবর্তনের পথে পথে পাওয়া ইতিহাসভিত্তিক ভাষা ও সাহিত্যের নানা বিশ্লেষণের সহজ-সরল উপাখ্যান। গোটা আশির দশকজুড়ে তাকে কাছ দেখেছিলাম একজন অচেনা পথিকের মতন করে। আবার কখনও সামান্য দূর থেকে বা কখনও মুখোমুখি হয়ে। দেখেছি, নিউ মার্কেটের পেছনের গলি থেকে তিনি হেঁটে যাচ্ছেন ক্যাম্পাসের দিকে। নিভৃতে ফুটপাত ধরে একা। হাতে একটা বই বা ম্যাগাজিন। কখনও রিকশা থেকে নেমে কলা ভবনের নিচতলার ইংরেজি ডিপার্টমেন্টের করিডোরে প্রবেশ করেছেন। যথাসময়ে শ্রেণিকক্ষে উপস্থিত হবেন। এই কিংবদন্তির সঙ্গে সালাম বিনিময় ছাড়া কখনও কথা বলেছি বলে মনে পড়ে না। তবুও শত শ্রদ্ধায় নত। তবে তাকে কোনোদিন গাড়ি থেকে নামতে দেখিনি। তার গাড়ি আছে কি না জানি না। 

দেশ-কাল-জাতি তথা বাঙালির নির্মোহ প্রতিনিধি হয়ে তিনি বেঁচে থাকুন আরও অনেক দিন, আরও অনেক বছর। 

  • গল্পকার ও কলামিস্ট 
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : মোরছালীন বাবলা

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা