জলবায়ু পরিবর্তন
সম্পাদকীয়
প্রকাশ : ২০ জুন ২০২৫ ১৬:০৬ পিএম
জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাব এই মুহূর্তে বিশ্বের অন্যতম আলোচিত ও উদ্বেগজনক সমস্যা। তবে উন্নত বিশ্বের তুলনায় উন্নয়নশীল দেশসমূহ এ প্রভাবের ঝুঁকিতে বেশি রয়েছে। ভূ-প্রাকৃতিক অবস্থানের কারণে আমরা প্রতিনিয়ত প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্মুখীন হচ্ছি। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশের ওপর এর প্রভাব আরও ভয়াবহ। কৃষি ও অর্থনীতিতে উপকূলীয় অঞ্চলে এর নেতিবাচক প্রভাব ইতোমধ্যে স্পষ্ট। ফলে প্রাণহানি, ভূমি, ঘরবাড়ি, জীবিকার ক্ষতি ছাড়াও ব্যক্তি এবং বিভিন্ন মানুষ স্থানচ্যুত হতে বাধ্য হচ্ছে। হুমকির মুখে পড়ছে দেশের জীববৈচিত্র্য। দেশের বিশাল জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশের ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়েছে। দেশের এখনও অংসখ্য মানুষ দারিদ্রসীমার নিচে বসবাস করছে। তাদের ওপরই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বেশি। ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইএনএম)-এর একটি প্রতিবেদন বলছে, দেশের ৩০টি সর্বাধিক দরিদ্র উপজেলা রয়েছে উচ্চ বা মধ্যম মাত্রার জলবায়ু ঝুঁকিতে। প্রতিবেদনটি তৈরি হয়েছে তিন হাজার মানুষের সঙ্গে কথা বলার পাশাপাশি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যের ভিত্তিতে। গত ১৮ জুন রাজধানীর মহাখালীর ব্র্যাক সেন্টারে ‘বাংলাদেশ দারিদ্র্য পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন-২০২৪’ প্রকাশ অনুষ্ঠানে এসব তথ্য জানানো হয়।
১৯ জুন প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এর অনলাইন সংস্করণে এই তথ্যের ভিত্তিতে ‘জলবায়ু ঝুঁকিতে রয়েছে দেশের ৩০টি দরিদ্র উপজেলা’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছেÑ দেশের সর্বাধিক দরিদ্র উপজেলাগুলোর মধ্যে গৌরীপুর, মাদারীপুর সদর, নেত্রকোণা সদর, চকোরিয়াসহ ৯টি উপজেলা উচ্চ পর্যায়ের জলবায়ু ঝুঁকিতে রয়েছে। এ ছাড়া ডাসার, হালুয়াঘাট, কালকিনি, রায়পুরাসহ সর্বাধিক দরিদ্র অন্য উপজেলাগুলো রয়েছে মধ্যম মাত্রার ঝুঁকিতে। প্রতিবেদনে বলা হয়, জলবায়ু-দুর্যোগের বিরূপ প্রভাবে সবচেয়ে বেশি পড়তে হয় দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে। দরিদ্রদের অভিযোজন সক্ষমতা সীমিত হওয়ায় তারা আরও বেশি বিপন্ন হয়ে পড়ে। অন্তর্ভুক্তিমূলক ও দারিদ্র্য সংবেদনশীল অভিযোজন কৌশল প্রণয়ন, জলবায়ু সংবেদনশীল দারিদ্র্য কমানোর উদ্যোগ, বিভিন্ন খাতে সমন্বয় ও আন্তঃসম্পর্কের সর্বোচ্চ ব্যবহার, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সমন্বয় ও সংগতি বজায় রাখা এবং স্থানীয় উদ্যোগগুলোকে শক্তিশালী করার কথা বলা হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব আমলে না নিয়ে দারিদ্র্য নিরসনের উদ্যোগ কোনোভাবেই সফল হবে না। তারা বলছেন, বর্তমানে বিশ্ব এমন একটা পরিস্থিতিতে উপনীত হয়েছে, জলবায়ুর পরির্তন থামানো সম্ভব নয়। এজন্য সমন্বিত কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
এটা সত্য যে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ধীরে ধীরে আমাদের ঋতুবৈচিত্র্য বদলে যাচ্ছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে দেশের উপকূলীয় এলাকার মানুষকে টিকে থাকতে বাড়তি লড়াই করতে হচ্ছে। গত কয়েক বছর আগেও বাংলাদেশের উষ্ণতম মাস ছিল এপ্রিল। তীব্র গরমের উষ্ণতম দিনের সংখ্যা এপ্রিল মাসেই বেশি থাকে। কিন্তু আবহাওয়াবিদরা বলছেন, বাংলাদেশে বছরের উষ্ণতম দিনের সংখ্যা এখন শুধু এপ্রিল মাস তথা গ্রীষ্মকালে সীমাবদ্ধ নেই; বর্ষাকালেও বৃদ্ধি পেয়েছে। তাদের মতে, গ্রীষ্মকালের দৈর্ঘ্য বেড়ে যাওয়া থেকে শুরু করে বর্ষাকালেও তাপপ্রবাহ চলাÑ এ সবকিছুই ঘটছে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে। ওয়ার্ল্ড ক্লাইমেট রিস্ক ইনডেক্সের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, পৃথিবীর যেসব দেশ সবচেয়ে বেশি জলবায়ু ঝুঁকিতে আছে, তার মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৭ম। তারা বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় ১৫টি জলবায়ু ঝুঁকি চিহ্নিত করেছেন। ইতোমধ্যে কৃষি খাতে জলবায়ুর পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবও লক্ষণীয়। অতিশুষ্কতার শিকার নদী, পুকুর-ডোবায় পানির সংকট; ভূগর্ভেও পানির স্তর নেমে গেছে। ফলে গভীর নলকূপেও পানির সংকট দেখা দিচ্ছে। ফলে পানির অভাবে জমির ফসল শুকিয়ে যাওয়ার শঙ্কায় থাকে কৃষক। আবার অসময়ে অতিবৃষ্টির কারণে ঘরে তোলার আগেই পানিতে ফসল ভেসে যেতে দেখা যায়। এই অবস্থায় জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। সৃষ্ট এই দুর্যোগ মোকাবিলা করতে না পারলে, দেশের এক বিরাট অংশ জলবায়ু-শরণার্থী হতে পারে বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পরিবেশগত সংকটে বিশ্ববাসী চিন্তিত। নানা সময়ে সংকট মোকাবিলায় বিশ্ববাসী একমত হলেও কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। এর অনিবার্য ফল হিসেবে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে, বাড়ছে জলবায়ু পরিবর্তনের কুফল। বস্তুত জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করা সহজ নয়। এ কঠিন কাজে সফল হওয়ার দীর্ঘমেয়াদী প্রস্তুতি নিতে হবে। এর কারণে আমাদের দেশ কতভাবে ক্ষতির শিকার হতে পারে- তা সাধারণ মানুষকে জানাতে হবে এবং পরিস্থিতি মোকাবিলায় পদক্ষেপ নিতে হবে। পরিবেশের এ পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে হবে। সবার আগে যে ৩০টি দরিদ্র উপজেলাকে চিহ্নিত করা হয়েছে, সেগুলোকে সামনে এনে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলার প্রস্তুতি নিতে হবে। যথাযথ পরিকল্পনা, প্রযুক্তির ব্যবহার এবং সচেতনতার মাধ্যমে চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করা সম্ভব। আমরা মনে করি, জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার প্রস্তুতিই হতে পারে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি নিরাপদ বাংলাদেশ নিশ্চিত করার উপায়।