ক্রীড়াঙ্গন
ইকরামউজ্জমান
প্রকাশ : ২০ জুন ২০২৫ ১৬:০২ পিএম
ইকরামউজ্জমান
‘এ ভেরি মেমোরাবল ভিকটি ফর সাউথ আফ্রিকা।’ প্রোটিয়াদের ক্রিকেট দায়মুক্ত হয়েছে। জাতির ক্রিকেটে বড় ধরনের স্বস্তি এসেছে। ক্রিকেটকে ঘিরে জন্ম হয়েছে নতুন আস্থা এবং আত্মবিশ্বাস। প্রত্যাশার সঙ্গে মিলেছে প্রতিজ্ঞা। স্বপ্ন শক্তির সঙ্গে গঠন শক্তি। ভাগ্য পাশে এসে দাঁড়িয়েছে দীর্ঘ ২৭ বছর পর। এরপর আর কে ঠেকায়। ক্রিকেটের তীর্থভূমি লর্ডসে ওদের আনন্দ আর প্রাণখোলা হাসি তো লা জবাব।
দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট অভিনন্দন বার্তায় বলেছেন, সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য অধিনায়ক টেম্বা বাভুমা তোমাকে অভিনন্দন। আমরা তোমার জন্য গর্বিত। এই জয় তোমার, এই জয় গোটা জাতির। ১৯৯৮ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত আইসিসি মিনি বিশ্বকাপে হ্যান্সি এশিয়ার অধিনায়কত্বে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে পরাজিত করে প্রথমবারের মতো বৈশ্বয়িক ট্রফি জিতে দক্ষিণ আফ্রিকা। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড এই বৈশ্বয়িক ইভেন্ট সুষ্ঠু এবং শৃঙ্খলার সঙ্গে আয়োজন করে সাংগঠনিক দক্ষতার পরিচয় দিয়েছে। এই সাংগঠনিক দক্ষতায় ২০০০ সালে টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার ক্ষেত্রে একটি ‘প্লাস পয়েন্ট’ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। তখন ভারতের জাগমোহন ডালমিয়া আইসিসির প্রেসিডেন্ট ছিলেন। ঢাকায় অনুষ্ঠিত মিনি বিশ্বকাপ টুর্নামেন্টে প্রতিদিন স্টেডিয়ামের দর্শক গ্যালারি কানায় কানায় পূর্ণ থেকেছে। মানুষ প্রাণভরে টুর্নামেন্টে আফ্রিকা আর পরবর্তীতে দীর্ঘ আড়াই যুগেরও বেশি সময় প্রতিভাসম্পন্ন এবং সামর্থ্যবান এক ঝাঁক ক্রিকেটার নিয়েও অতৃপ্তি আর হতাশার বোঝা বাড়িয়েছে। আইসিসির সব বড় ইভেন্টে প্রতিবারই তাদের স্থান হয়েছে সিংহাসনের পরিবর্তে বনবাসে। প্রোটিয়ারা দেশে ক্রিকেটপিপাসু দুটি প্রজন্মকে বৈশ্বয়িক টুর্নামেন্টে ‘এক্সাইটিং’ জয় উপহার না দেওয়ার আক্ষেপে সব সময় ভুগেছে।
দীর্ঘ সময় ধরে তাদের শুনতে হয়েছে বিভিন্ন ধরনের অপবাদ। সহ্য করতে হয়েছে হেয় প্রতিপন্ন মনোভাব। দলটি ক্রিকেটবিশ্বে পরিচিত হয়েছে ‘চোকার’ হিসেবে। আমাদের দেশে সাধারণ ক্রিকেট অনুরাগীরাও দক্ষিণ আফ্রিকা ক্রিকেট দলকে ‘কুফা’ হিসেবে সব সময় আখ্যায়িত করেছেন বিশেষ করে আইসিসির বৈশ্বয়িক ইভেন্টে। একটি দল বৈশ্বয়িক ক্রিকেটে (ওয়ানডে, বিশ্বকাপ, টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন ট্রফিতে) ১৫ বার কোয়ার্টার ফাইনাল, সেমিফাইনাল এমনকি ফাইনালে পৌঁছেও ট্রফি জয়ের স্বাদ পায়নি। ব্যর্থতার গ্লানি নিয়ে ফিরে গেছে নিজ দেশে। দরকারি সময়ে দলটি মাঠের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বারবার ভেঙে পড়েছে। চাপ সহ্য করতে পারেনি। দারুণ ছন্দে থেকে এগিয়ে গিয়েও শেষ পর্যন্ত তীরের কাছে এসে ওদের তরী ডুবেছে। এটি কি শুধু মানসিক সমস্যা! আসলে ভাগ্যও কখনও ওদের পাশে দাঁড়ায়নি। মুখ তুলে তাকায়নি। ক্রিকেট খেলাটা মানুষের নয় অদৃষ্টের। এখানে মানুষ ভাবে এক রকম আর বিধাতার ফয়সালা যে অন্য রকম। এটি কেন সেটি শুধু তিনি জানেন। বছরের পর বছর প্রোটিয়ারা কম চেষ্টা করেনি, তাদের আন্তরিকতায়ও ঘাটতি ছিল না। এরপর স্বপ্ন কাছে এসে দূরে চলে গেছে। এটি তাদের ক্রিকেট ইতিহাসে বড় একটি ট্র্যাজেডি।
বর্ণবৈষম্যের বিষয়টিকে ঘিরে দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেট সবচেয়ে বেশি আলোচিত এবং সমালোচিত হয়েছেÑ একটি দীর্ঘ সময় ধরে। শ্বেতাঙ্গ আর কৃষ্ণাঙ্গ ক্রিকেটারদের মধ্যে ছিল বিভিন্ন বিষয়ে চরম বৈষম্য। গায়ের রঙ যাদের সাদা তাদেরই সব অধিকার দেশের ক্রিকেটে। আইসিসি একসময় বাধ্য হয়েছে টেস্ট ক্রিকেট থেকে দক্ষিণ আফ্রিকাকে বহিষ্কার করতে। এরপর ১৯৯২ সালে টেস্ট ক্রিকেটে ফিরে এসেছে দক্ষিণ আফ্রিকা। এর মধ্যে বিভিন্ন ধরনের রাজনৈতিক এবং সামাজিক পরিবর্তন ঘটেছে। পরিস্থিতি উন্নতি হয়েছে। গায়ের রঙ সাদা নয় বলে নিজ দেশে পরবাসী ভাবার দিনের অবসান ঘটেছে।
১৯৯২ সালে টেস্ট ক্রিকেটে ফিরে আসার পর এবারই (২০২৫) টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপে শিরোপা জিতেছে দক্ষিণ আফ্রিকা। আর এই ফিরে আসা জার্নির নেতৃত্ব দিয়েছেন কৃষ্ণাঙ্গ ক্রিকেটার টেম্বা বাভুমা। যিনি দক্ষিণ আফ্রিকা টেস্ট দলের অধিনায়ক হিসেবে গত দশটি টেস্ট ম্যাচের ৯টিতে দেশকে বিজয়ের স্বাদ উপহার দিয়েছেন আর একটি টেস্ট ড্র হয়েছে। কৃষ্ণাঙ্গ অধিনায়কের নেতৃত্বে বৈশ্বয়িক ক্রিকেটে ‘কাম ব্যাক’ দেশের জাতীয় ঐক্য এবং সংহতিতে বড় ধরনের প্রভাব রাখবে বলে মনে করা হচ্ছে।
দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেট নিয়ে লিখতে বা আলোচনায় যে ক্রিকেটারের নামটি প্রথমেই চলে আসে তিনি হলেন ব্যাসিল ডি’অলিভেইরা বর্ণবৈষম্যের জাঁতাকলে পিষ্ট কৃষ্ণাঙ্গ ক্রিকেটার। এই কালো আদমি প্রথম ক্রিকেটার যিনি ইংল্যান্ডের হয়ে টেস্ট খেলেছেন। তার আগে যেসব ভারতীয় খেলোয়াড় ইংল্যান্ডের হয়ে টেস্ট খেলেছেন (রঞ্জি, পতৌদি, দলীপ সিংজি) তারা কেউ নিজ দেশ কর্তৃক পরিত্যক্ত হয়ে ইংল্যান্ডের পক্ষে খেলেননি। তারা টেস্ট খেলেছেন এই জন্যে যে ভারত সে সময় টেস্ট মর্যাদা লাভ করেনি।
১৯৬৩ সালের শেষ ভাগে রিচার্ডসনের অধিনায়কত্বে আলফ লোভারের কমনওয়েলথ একাদশ করাচি, লাহোর ও ঢাকায় অনুষ্ঠিত তিনটি বেসরকারি টেস্ট ম্যাচে ডি অলিভারিয়াকে খেলতে দেখেছি পাকিস্তান দলের বিপক্ষে। সেবারই প্রথম ঢাকা স্টেডিয়ামে নারী দর্শকদের খেলা দেখার জন্য পশ্চিম দিকের গ্যালারিতে পৃথক ‘এনক্লোজার’ তৈরি করা হয়েছিল। কমনওয়েলথ একাদশে সেই দলে ডি অলিভারিয়া ছাড়াও গ্রেভলি, কালহাই, কুচার, খালিদ ইকাদুন্না, ওয়াটসন, চার্লি গ্রিফিথ এবং অন্যরা ছিলেন। এদিকে পাকিস্তান দলে অধিনায়ক ইমতিয়াজ আহমদ, হানিফ মোহাম্মদ, মুস্তাক মোহাম্মদ, আসিফ ইকবাল শাফাকত রানা প্রমুখ খেলোয়াড়।
ফিরে আসি আবার ২০২৫-এর ১৪ জুন ইংল্যান্ডের ঐতিহাসিক লর্ডস গ্রাউন্ডে। টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ ফাইনালে প্যাট কামিন্সের অস্ট্রেলিয়াকে (যারা বিগত আসরের চ্যাম্পিয়ন) টেস্ট ক্রিকেটে ফিরে আসার ৩৩ বছর পর পরাজিত করে শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট মাথায় পরেছে টেম্বা বাভুমার দক্ষিণ আফ্রিকা। অস্ট্রেলিয়া জয়ের জন্য খেলে তারা ভাবতেই পারেনি এবার তারা দেখবে অন্য দক্ষিণ আফ্রিকাকে। মানুষ ভাবে একরকম সৃষ্টিকর্তা ভাবেন আরেক রকম। টেম্বা বাভুমার দল যারা মনে মনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হলেও প্রকাশ্যে হুঙ্কার দেয়নিÑ‘বৈশ্বয়িক শিরোপা এবার আমাদের’। হয়তো অতীতের ব্যর্থতা, দ্বিধাদ্বন্দ্ব তাদেরকে টেনে রেখেছে। ২৮২ রান তাড়া করে জিততে হবে। লর্ডসে তো এর আগে মাত্র দুইবার চতুর্থ ইনিংসে এত বেশি রান তাড়া করে জয়ের রেকর্ড আছে। সেখানে ভেঙে না পড়ে, চাপে না ভুগে এইডেন মার্করাম অসাধারণ ব্যাটিং (লর্ডসে কয়জন ব্যাটসম্যান চতুর্থ ইনিংসে সেঞ্চুরি করেছেন?) নৈপুণ্যের মাধ্যমে আকাশ থেকে কালোমেঘ সরে গিয়ে আকাশজুড়ে ঝলমলে রোদ উঠেছে। প্রোটিয়ারা পুরনো ব্যর্থতার ইতিহাস পেছনে ফেলে এগিয়ে এসেছে। এই এগিয়ে আসাটা তাদের ‘চোকার’ পরিচিতি ঘোচাতে পারবে কি না এর জন্য আগামীর দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে। খেলা শেষে অধিনায়ক বাভুমার চোখে জল, চোখে জল সব খেলোয়াড় এবং সমর্থকদের। এই জলের মধ্যে লুকিয়ে ছিল ‘দেশপ্রেম’ আর মুক্তির স্বাদ।