কৈশোরে সুস্থ বিকাশ
সিরাজুল ইসলাম
প্রকাশ : ১৯ জুন ২০২৫ ১৬:২৩ পিএম
সিরাজুল ইসলাম
আজকের কিশোর-কিশোরী দেশ ও সমাজের ভবিষ্যতের উন্নয়নের চাবিকাঠি। কৈশোরের সঙ্গে উন্নয়নের যোগাযোগটা সহজে চোখে না পড়লেও এটাই সত্যি। দশ থেকে ১৯ বছর বয়সি কিশোর-কিশোরী জনগোষ্ঠী হিসেবে ধরা হয়। আর এরাই দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ২০ শতাংশ। তাদের সুষ্ঠু বিকাশের জন্য পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের ক্রমবর্ধমান হারে গুরুত্ব বাড়াতে হবে এবং পাশাপাশি রাষ্ট্রের উন্নয়ন অংশীদারদেরও এই জনগোষ্ঠীর সম্ভাবনার পূর্ণ বিকাশ ঘটানোর জন্য বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
এই কৈশোর জনগোষ্ঠী যেন সুন্দর ও সুষ্ঠু, প্রতিশ্রুতিময় জীবন নিয়ে গড়ে ওঠে এবং কৈশোর জীবনটা যেন সুন্দর, রুচিশীল, সুস্বাস্থ্যের অধিকারী এবং বিশেষভাবে জ্ঞান-বিজ্ঞানে আদর্শস্থানীয় হয় সেদিকে নজর বাড়াতে হবে সংশ্লিষ্ট সবাইকে। কারণ, কৈশোরের পরই ওরা ধীরে ধীরে উচ্চতর শিক্ষা ও কর্মজীবনে ঢুকবে এবং পরিবার, সমাজ সর্বোপরি রাষ্ট্র পরিচালনায় পরবর্তীতে তারাই অবদান রাখবে। এই বয়সটা এমন যে, ওরা সব সময় নতুন কিছু করার প্রতি আগ্রহ বোধ করে, যা অনেক সময় বিপজ্জনক বা উন্মাদনায় পৌঁছে যায়। কারণ নতুন প্রাণশক্তি তাদের এ ব্যাপারে উজ্জীবিত করে। তাদের এই উদ্দীপনাকে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র তথা আমাদের সবাইকে এমনভাবে কাজে লাগাতে হবে যেন তা ক্ষতিকর দিকে না গিয়ে আমাদের সবার জন্য ইতিবাচক পরিবর্তন বয়ে আনে এবং সমাজ ও মানুষের জন্য কল্যাণকর কিছু হয়। যেমন, ধরা যাক বিজ্ঞান প্রযুক্তিতে নতুন কিছু উদ্ভাবন করার জন্য উৎসাহ প্রদান এবং সেজন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা। আবার আমরা পারি তাদের তারুণ্যভরা উদ্দীপনাকে কাজে লাগিয়ে দেশের মানুষের জন্য কল্যাণকর কাজে তাদেরকে প্রাধান্য দিয়ে জড়িত করা। তা ছাড়া দেশের বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে কৈশোরের তারুণ্যোজ্জ্বল শক্তিকে দুর্যোগকবলিত মানুষের সাহায্য-সহযোগিতায় বা বিভিন্ন জনহিতকর কাজে লাগানো যেতে পারে। যেমনটা দেখেছি আমরা ২০২৪-এর আগস্টে দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের আকস্মিক বন্যায় কিশোর ও তরুণদের অংশগ্রহণের সুফল। এতে করে কিশোর বা তরুণরা উৎসাহ পায় তাদের নিজেদেরকে ভালো কাজে জড়িয়ে রাখতে। এই বয়সটাই হচ্ছে নতুনকে গ্রহণ করার সময়। কাজেই এদের জন্য নতুনকে আমরা যতটা আকর্ষণীয় ও কল্যাণকর করে তুলতে পারব ততটাই তাদেরকে বিপজ্জনক পথ থেকে দূরে রাখতে পারব।
ইউনিসেফ ও এমবাসি অব দ্য কিংডম অব নেদারল্যান্ডস ও অন্য আরও অনেক অর্গানাইজেশনের গবেষণায় উঠে এসেছে কিশোর বয়সের ছেলেমেয়েরা মানসিক অশান্তিতে ভোগে। এটা তাদের সাধারণত এই বয়সের কারণেই হয়ে থাকে। অভিভাবক বা শিক্ষকরা এই বিষয়গুলো অনেক সময় এড়িয়ে যায়। কিন্তু এ বিষয়ে খোলামেলা আলোচনায় আমাদের বড়দের একটি কার্যকরী ভূমিকা রাখতে হবে। কৈশোর বয়স থেকেই ওরা ভালোমন্দ মেশানো কিছু বিষয় শিখবে, যা তাদের ভুল পথে নিয়ে যেতে পারে। তাদেরকে বোঝাতে হবে যে তাদের এই বয়সটা খুবই সুন্দর একটি সময়, তবে অনেকটা বিপজ্জনক বটে এবং তাদেরকে সচেতন করতে হবে এই বয়সের বিপজ্জনক দিকগুলো নিয়ে এবং উৎসাহ ও উদ্দীপনা জাগাতে হবে তাদের বয়সের সুন্দর দিকগুলো নিয়ে, যাতে তারা তাদের ভবিষ্যৎ জীবন সুন্দরভাবে গড়ে তোলার জন্য অদম্য প্রেরণা অনুভব করতে পারে। সরকারের কৈশোরকালীন মানসিক স্বাস্থ্য ও অন্যান্য সেবার জন্য ‘জাতীয় কৌশলপত্র ২০১৭-৩০’ যদি গুরুত্ব দিয়ে বাস্তবায়ন করা হয়, তাহলে জাতি নিশ্চয়ই একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ উপহার পাবে।
কেন কৈশোর নিয়ে এত কথা বলছি? কারণ, আমাদের পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ ও অর্থনীতি পুরোটাই নির্ভর করছে এই প্রজন্মের ওপর। আমরা চাই, ওদের জীবন ও চিন্তাধারা যেন আধুনিক, উন্নত ও সুস্থভাবে গড়ে ওঠে। এই প্রসঙ্গে আমাদের বর্তমান সময়ের কৈশোর ও মাদকের যোগসূত্র এবং সমাজ ও রাষ্ট্রে এর প্রভাব নিয়ে আলোচনা করতেই হয়। বর্তমানে অস্থির ও ভয়ানক একটি কৈশোরের সময়কাল পার করছি আমরা। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, মাদকের সঙ্গে কিশোর অপরাধ ও অপরাধীদের একটি ঘনিষ্ঠ যোগসূত্র রয়েছে। বর্তমানে কিশোর-কিশোরীরা ক্ষুদ্র অপরাধ থেকে শুরু করে ‘হোয়াইট কলার’ ক্রাইম পর্যন্ত করে ফেলছে। যেটাকে আমরা কিশোর গ্যাং বলে আখ্যায়িত করে থাকি। ছিনতাই, চুরি, ডাকাতি, লুণ্ঠন, রাহাজানি, ধর্ষণ, হত্যা, পতিতাবৃত্তি, অপহরণ, মুক্তিপণ আদায়, চাঁদাবাজি, ইভ টিজিং ইত্যাদি জঘন্য অপকর্ম সংঘটিত হচ্ছে তাদের দ্বারা। সামান্য সামান্য ব্যাপারে মাদকাসক্ত এসব কিশোর গ্যাংয়ের ছেলেমেয়েরা নিজেদেরই বাবা-মা, খালা, ভাইবোন এমনকি প্রতিবেশীদেরও খুন করে ফেলতে দ্বিধা বোধ করছে না। শুধু তাই-ই নয়, বর্তমান সময়ের কিশোররা মাদকাসক্তের ন্যায় মোবাইল/মোবাইল গেমে এতটাই আসক্ত হয়ে পড়েছে যে তারা পরীক্ষায় খারাপ গ্রেড, আত্মসম্মানবোধ কম, স্মৃতিশক্তির সমস্যা, মনোযোগের ঘাটতি, এ ব্যাপারে পারিবারিকভাবে বাধা প্রদান করলে তারা আত্মহননের মতো পথও বেছে নেয় এবং সামাজিক দক্ষতা এদের দুর্বল হতে হতে একটা মস্তবড় অরক্ষিত ও অস্থির কৈশোর সমাজ তৈরি করে ফেলেছে। বাংলাদেশের একটা বড় অংশের জনগোষ্ঠী কিশোর-তরুণ। যে কারণে বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীকে বলা হয় ইয়ুথ ডিভিডেন্ট। বাংলাদেশের কিশোর ও তরুণদের প্রায় ৮৫ ভাগই নানা ধরনের মাদক আসক্ত বা মোবাইল আসক্ত এবং যেভাবে এই আসক্তির সংখ্যা বাড়ছে তাতে ধারণা করা হচ্ছে, ২০৩০ সাল নাগাদ এ সংখ্যা কয়েক কোটি ছাড়িয়ে যাবে। তাহলে আমরা কৈশোরের সময়কালটাকে ভয়ংকর এই প্রভাব থেকে কীভাবে রক্ষা করব? শুধু প্রশ্ন করে থেমে গেলেই হবে না কিংবা কতগুলো পন্থা বা উপায় অবলম্বনের কথা বলে চুপ করে গেলেই হবে না। বরং কৈশোরের সুস্থ ও সুন্দর ক্রমবিকাশে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের সম্মিলিত কার্যকরী পদক্ষেপ বাস্তবায়ন দ্রুত নিশ্চিত করতে হবে এবং এই কু-প্রভাব থেকে এদেরকে তথা রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ রক্ষা করতে হবে। কিশোর-কিশোরীরা যদি শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা নিয়ে বেড়ে ওঠে, তাহলে আগামীতে দক্ষ কারিগর ও মানবমুক্তির দূত হিসেবে তারা প্রতিষ্ঠা লাভ করবে।
বর্তমান সময়ে কিশোর জনগোষ্ঠীর মধ্যে যে অস্থিরতা, খেয়ালিপনা, সিদ্ধান্তহীনতা, অপরাধ প্রবণতা ইত্যাদি দ্বিধা-দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়েছে তার কুফল দেশের প্রায় প্রতিটি ঘরে ঘরে উপলব্ধ হচ্ছে। পরিবারের যেমন দায়িত্ব তাদের সন্তানকে বিভিন্ন কু-প্রভাব থেকে রক্ষা করার জন্য শিক্ষণীয় জীবন-প্রণালী ঠিক করে দেওয়া, ঠিক তেমনই সমাজ ও রাষ্ট্রের কর্তব্য দেশের কিশোর তথা আগামীর সুন্দর ভবিষ্যৎ রক্ষার জন্য একটি নিরাপদ, সুষ্ঠু ও সুন্দর সামাজিক পরিবেশ নিশ্চিত করা। উন্মুক্ত পরিবেশ ও প্রকৃতি, পর্যাপ্ত খেলার মাঠের অভাবে আজকের কিশোর-কিশোরীরা অনেকটা ঘরবন্দি জীবন-যাপন তাদেরকে করে তুলেছে মোবাইলে আসক্ত। আর উন্মুক্ত পরিবেশ ও প্রকৃতি এবং খেলার মাঠের অভাবে তরুণরা সৃষ্টিশীল কিছুর সঙ্গে নিজেদের জড়াতে না পেরে অনেক ক্ষেত্রে মাদকাসক্তির দিকে ঝুঁকে পড়ছে।
বাংলাদেশে বর্তমানে ৩ কোটি ৬০ লাখ কিশোর- কিশোরী আছে এবং আমরা জানি তাদের মানসিক গঠন হচ্ছে আবেগগত, আচরণগত বা স্নায়বিক বিকাশজনিত। সহজ কথায়, তাদের মানসিক ও শারীরিক গঠন এমন যে, তার সম্প্রদায়ের জন্য কোনো না কোনো বিষয়ে তারা অবদান রাখতে পারে। কিন্তু মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার যে চিত্রটি বাংলাদেশের সর্বশেষ জরিপে ফুটে উঠেছে তা রীতিমতো উদ্বেগজনক। কিশোরদের মধ্যে প্রায় ১৮.৪ শতাংশই কোনো না কোনো মানসিক রোগে ভুগছে। তাহলে আমরা যদি এই সময় তাদের সঠিক মানসিক যত্নের অবহেলা করি তবে ১৫-২০ বছর পর একটি মূল্যবোধহীন সমাজ পাব। তাই পরিবারের উচিত এ সময়টাতে কিশোর-কিশোরীর সামনে শুদ্ধ আচার-আচরণ, নৈতিকতাবর্জিত আলাপ-আলোচনা, অনৈতিক কর্মকাণ্ড, নিজের সমাজের অন্যদের প্রতি অশ্রদ্ধা, অবজ্ঞার চিত্র ইত্যাদি থেকে তাদেরকে দূরে রাখা। কারণ এগুলোই তাদের মনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
কৈশোরে বিশেষ যত্ন এবং পারিবারিক, সামাজিক পরিবেশের মধ্যে নৈতিক, মানবিক, সমধিকারের প্রতিষ্ঠা, নম্রতা, শিষ্টাচার, সুখী-সুন্দর পরিবেশ সৃষ্টি তথা আদর ভালোবাসা মাখা, শ্রদ্ধা, বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক নিশ্চিত করতে পারলে প্রকৃত মানবিক মানুষ হিসেবে তারা গড়ে উঠবে, দেশ ও দশের জন্য মঙ্গল বয়ে আনবে, ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল, স্বর্ণালি, বর্ণিল ও আলোকময় হবে। তাদেরকে সব সময় বলতে হবেÑ তোমাকে দিয়েই হবে, তুমিই সেরা, তুমিই পারবে। এ ক্ষেত্রে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের যথাযথ ভূমিকা পালনের বিকল্প নেই।