× ই-পেপার প্রচ্ছদ সর্বশেষ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি শিক্ষা ধর্ম ফিচার ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

বাজেট পর্যালোচনা

কৃষিতে ভর্তুকি বাড়াতে হবে

ড. জাহাঙ্গীর আলম

প্রকাশ : ১৯ জুন ২০২৫ ১৬:২১ পিএম

ড. জাহাঙ্গীর আলম

ড. জাহাঙ্গীর আলম

বৈষম্যহীন ও টেকসই অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ার প্রত্যয় নিয়ে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট পেশ করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ। ২০০৯-১০ অর্থবছরে মোট বাজেটের পরিমাণ ছিল এক লাখ ১০ হাজার ৫২৩ কোটি টাকা। ১৫ বছর পর ২০২৪-২৫ অর্থবছরে তা ৬২১.১২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় সাত লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকায়। ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটের আকার সাত লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা।

চলতি বছরের বাজেটের আকার সাত হাজার কোটি টাকা বা ০.৮৮ শতাংশ কম। এবারের বাজেটে আনুষ্ঠানিকতা কম। পক্ষে-বিপক্ষে কোনো মিছিল বা স্লোগান নেই। বলা যায়, উত্তাপহীন বাজেট। দেশের উচ্চ মূল্যস্ফীতির কথা বিবেচনায় নিলে অযৌক্তিক ব্যয় কমানোর মাধ্যমে একটি আঁটসাঁট বাজেট প্রস্তাবই এবার কাঙ্ক্ষিত ছিল। বাজেটে মোট রাজস্ব প্রাক্কলন করা হয়েছে পাঁচ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে এনবিআর উৎস থেকে আসবে চার লাখ ৯৯ হাজার কোটি টাকা। লক্ষ্য অর্জন করতে হলে এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের প্রবৃদ্ধি হতে হবে এবারের সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রার ৭.৬৬ শতাংশ এবং মূল লক্ষ্যমাত্রার ৩.৯৬ শতাংশ বেশি।

সাম্প্রতিক আর্থিক সংকট, নিম্ন জিডিপি প্রবৃদ্ধি ও আমদানি নিয়ন্ত্রণের কারণে এই প্রবৃদ্ধি অর্জন করা খুবই কঠিন হবে। কর ও ভ্যাটের আওতা ও হার বৃদ্ধি এবং করছাড়ের মাত্রা হ্রাসের কারণে মানুষের ওপর আর্থিক চাপ বাড়বে। বর্তমানে আমাদের কর-জিডিপি অনুপাত ৭ শতাংশের মতো। এটি এশিয়ার সর্বনিম্ন। ক্রমাগত বাজেট ঘাটতি হ্রাস এবং দেশি ও বিদেশি ঋণের ওপর নির্ভরতা কমানোর জন্য কর-জিডিপির অনুপাত বাড়িয়ে ন্যূনপক্ষে ২০ শতাংশে উন্নীত করা দরকার। প্রস্তাবিত বাজেটে কর-জিডিপির অনুপাত হবে ৯ শতাংশ। ঘাটতি ধরা হয়েছে দুই কোটি ২৬ লাখ টাকা, যা জিডিপির ৩.৬ শতাংশ। অন্যান্য বছরের তুলনায় তা কম। এই ধারা অব্যাহত থাকলে বিদেশি ঋণের ওপর নির্ভরতা হ্রাস পাবে এবং স্বনির্ভর অর্থনীতি গড়ার লক্ষ্য অর্জন সম্ভব হবে।

প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৫.৫ শতাংশ। তবে বাজেট বাস্তবায়নের হার ও গুণগত মান সন্তোষজনক না হলে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব না-ও হতে পারে। বাজেটে মূল্যস্ফীতির হার ধরা হয়েছে ৬.৫ শতাংশ। বাস্তবে এটি হয়তো আরও বেশি হবে। বর্তমানে গড় মূল্যস্ফীতির হার ১০ শতাংশের কাছাকাছি। মে মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৮.৫৯ শতাংশ, এপ্রিলে যা ছিল ৮.৬৩ শতাংশ। সম্প্রতি দেশে কৃষির উৎপাদন, বিশেষ করে বোরো ধানের উৎপাদন ভালো হওয়ায় মূল্যস্ফীতির হার নমনীয় থাকবে বলে আশা করা যায়।

বাজেটে মোট উন্নয়ন ব্যয় ধরা হয়েছে দুই লাখ ৪৫ হাজার ৬০৯ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের ৩১ শতাংশ। পরিচালন বা অনুন্নয়ন ব্যয় ধরা হয়েছে চার লাখ ৯৮ হাজার ৭৮৩ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের ৬৯ শতাংশ। এটি ভারসাম্যপূর্ণ নয়। এবার পরিচালন ব্যয় বেশি হওয়ার অন্যতম কারণ সরকারি কর্মচারীদের বেতন-ভাতা খাতে বেশি বরাদ্দ রাখা। উদ্দেশ্য বিশেষ প্রণোদনা প্রদান। বর্তমানে সচিবালয় ও এনবিআরের স্থাপনাগুলোতে যা ঘটছে, দেশবাসী তা প্রত্যক্ষ করছে। তাদের সেবার মান সম্পর্কেও করদাতারা অবহিত আছেন। এ অবস্থায় পুরনো কর্মচারীদের আর্থিক সুবিধা আর না বাড়িয়ে নতুন কর্মসংস্থানের উদ্যোগ গ্রহণ করাই যুক্তিপূর্ণ নয় কি? দেশের শতকরা ৯০ ভাগ বেসরকারি চাকরিজীবীর জন্য সরকারের কোনো প্রণোদনা থাকবে কি?

প্রস্তাবিত কৃষি বাজেট গতানুগতিক। আগামী অর্থবছরে কৃষি বিষয়ক পাঁচটি মন্ত্রণালয়ের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৪৫ হাজার ২০৮ কোটি টাকা। এই টাকা মোট বরাদ্দের ৫.৮৬ শতাংশ। এর মধ্যে শস্য কৃষি খাতের জন্য রাখা হয়েছে ২৭ হাজার ২২৪ কোটি টাকা, যা মোট বরাদ্দের ৩.৪৫ শতাংশ। বাকি ২.৪১ শতাংশ মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ, বন ও পরিবেশ, ভূমি ও পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়গুলোর জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে। এটি অপ্রতুল। দিনের পর দিন বাজেটে বৃহত্তর কৃষি খাতের হিস্যা হ্রাস পেয়েছে। ২০১১-১২ সালে বৃহত্তর কৃষি খাতের হিস্যা ছিল মোট বাজেটের ১০.৬৫ শতাংশ। ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে তা নেমে এসেছে ৫.৮৬ শতাংশে। ২০০৯-১০ অর্থবছরে কৃষি খাতে প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছিল ৬.৬৫ শতাংশ। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে তা ১.৭৯ শতাংশে নেমে আসছে। এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য কৃষি খাতে ন্যূনপক্ষে মোট বাজেটের ১০ শতাংশ অর্থ নিয়োজিত করা উচিত।

২০২৩-২৪ অর্থবছরে ফসল খাতে ভর্তুকির পরিমাণ ছিল ২৪ হাজার ৯৩৫ কোটি টাকা। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে তার পরিমাণ দাঁড়ায় ১৭ হাজার ২৬১ কোটি টাকায়। এবার নয়া বাজেটে কৃষি ভর্তুকির পরিমাণ ধরা হয়েছে ১৭ হাজার ২৪১ কোটি টাকা, যা গত বছরের মূল বাজেট থেকে ২০ কোটি টাকা কম। এভাবে কৃষি ভর্তুকির ক্রমহ্রাস অনাকাঙ্ক্ষিত। এতে বিঘ্নিত হবে কৃষির উৎপাদন। খাদ্য নিরাপত্তা ব্যাহত হবে। কৃষি খাতে কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় উৎপাদন বাড়িয়ে যেতে হলে কৃষি ভর্তুকি খাতে মোট বাজেটের কমপক্ষে ৫ শতাংশ অর্থ বরাদ্দ করা উচিত।

কৃষি খাতে করমুক্ত আয়সীমা পাঁচ লাখ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এটি খুবই যৌক্তিক মনে হয়েছে। কোল্ড স্টোরেজ স্থাপনে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি আমদানিতে রেয়াতি শুল্ক সুবিধা প্রদানের প্রস্তাব করা হয়েছে। স্থানীয়ভাবে কৃষি যন্ত্রপাতি উৎপাদনকে উৎসাহিত করতে কম্বাইন্ড হারভেস্টার তৈরির যন্ত্রাংশ আমদানিতেও বিদ্যমান শুল্কহার হ্রাসের কথা বলা হয়েছে। এগুলো কৃষি উন্নয়নে সহায়ক হবে।

বাজেটে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেড়েছে। এ খাতে মোট বরাদ্দ আট হাজার ৩২২ কোটি টাকা, বেড়েছে এক হাজার ৬৮৪ কোটি টাকা বা ২৫.৩৭ শতাংশ। বর্তমানে দেশে খাদ্যগুদামের ধারণক্ষমতা খুবই কম, ২১.৮৬ মেট্রিক টন। নতুন অর্থবছরে তা ৩৭ লাখ মেট্রিক টনে উন্নীত করার অঙ্গীকার করা হয়েছে। এতে খাদ্যশস্যের বাজারে সরকারের নিয়ন্ত্রণ সক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে। বর্তমানে দেশে খাদ্যশস্যের উৎপাদন পাঁচ কোটি মেট্রিক টন। এর ন্যূনতম ১০ শতাংশ অর্থাৎ ৫০ লাখ মেট্রিক টন খাদ্যশস্য সংরক্ষণের জন্য গুদামের ধারণক্ষমতা নিরন্তর বাড়িয়ে যাওয়া প্রয়োজন।

বাজেটে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে জোর দেওয়ার কথা বলা হলেও বরাদ্দ বেড়েছে স্বল্পই। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দুই বিভাগে এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৯৫ হাজার ৬৪৪ কোটি টাকা। এটি মোট বাজেটের ১২.১ শতাংশ। এই বরাদ্দ জিডিপির ১.৭২ শতাংশ। ইউনেস্কোর সুপারিশ মতে জিডিপির ৪ থেকে ৬ শতাংশ এবং জাতীয় বাজেটের ১৫ থেকে ২০ শতাংশ শিক্ষা খাতে বরাদ্দ দেওয়া প্রয়োজন। স্বাস্থ্যসেবা খাতের দুটি বিভাগে মোট বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৪১ হাজার ৯০৮ কোটি টাকা। এটি মোট বরাদ্দের ৫.৩ শতাংশ। স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশনের মতে, জাতীয় বাজেটের ১৫ শতাংশ বা জিডিপির ৫ শতাংশ স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ করা উচিত।

সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ বেড়েছে মাত্র এক হাজার ৮৭৫ কোটি টাকা। এটি যথেষ্ট নয়। বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা ও সমাজকল্যাণ খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৪৫ হাজার ৮৩ কোটি টাকা। গত সংশোধিত বাজেটে ছিল ৪৩ হাজার ২০৮ কোটি টাকা। বরাদ্দ বৃদ্ধির হার ৪.৩৪ শতাংশ। এই বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে একত্রে, পাঁচটি মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে (সমাজকল্যাণ, মহিলা ও শিশু, খাদ্য, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও মুক্তিযুদ্ধ)। মোট উপকারভোগীর সংখ্যা বাড়ানোর যে প্রস্তাব করা হয়েছে, তা অপ্রতুল। এর আগে টিসিবির বাদ পড়া ৪৩ লাখ পরিবারের কার্ড কবে হবে, তারও কোনো নিশ্চয়তা দেওয়া হয়নি।

বাজেটে ব্যক্তি শ্রেণির করমুক্ত আয়ের সীমা তিন লাখ ৫০ হাজার থেকে বাড়িয়ে তিন লাখ ৭৫ হাজার টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। মহিলা ও ৬৫ বছরের বা তদূর্ধ্ব বয়সের করদাতাদের করমুক্ত আয়সীমা বেড়ে হবে চার লাখ ২৫ হাজার টাকা। সর্বোচ্চ কর হার আগের মতো ৩০ শতাংশ রাখা হলেও করধাপ সাতটি থেকে কমিয়ে ছয়টি করার প্রস্তাব করা হয়েছে। ফলে বেশি আয়ের করদাতাদের ওপর কর প্রদানের চাপ বেড়ে যাবে।

বাজেটের আকার ছোট। তবে বাস্তবসম্মত। বাজেট বাস্তবায়নের গুণগত মান নিশ্চিত হলে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে বর্তমান চড়া মূল্যস্ফীতি অবদমনে প্রস্তাবিত বাজেট সহায়ক হবে। এটি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হলে ঈপ্সিত লক্ষ্য অর্জনও সম্ভব হবে।

  • একুশে পদকপ্রাপ্ত কৃষি অর্থনীতিবিদ, সাবেক মহাপরিচালক, বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট 
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : মোরছালীন বাবলা

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা