কারাগার
সম্পাদকীয়
প্রকাশ : ১৮ জুন ২০২৫ ১৫:৩৯ পিএম
প্রতীকী ছবি
বন্দিদের বিষয়ে কর্তৃপক্ষ কারাফটকে একটি অঙ্গীকারনামা লিখে রেখেছেন- ‘রাখিব নিরাপদ, দেখাব আলোর পথ।’ কারাগার মূলত সংশোধনাগার। কারাগারের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে অপরাধীর সংস্কার বা সংশোধন। শুধু শাস্তি দেওয়াই কারাগারের লক্ষ্য নয়, অপরাধী সংশোধিত হয়ে যেন স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারে, সেটাও তার লক্ষ্য। তাই কারাগারের পরিবেশ ও ব্যবস্থাপনা এমন হওয়া উচিত, যাতে কোনো অপরাধী সত্যিকার অর্থে সংশোধন হয়। আমরা চাই, দেশের প্রতিটি কারাগারে এমন পরিবেশ তৈরি হোক, যাতে কারাগার থেকে বের হওয়া প্রত্যেক বন্দি বাস্তবিক অর্থেই ‘আলোর পথের অভিযাত্রী’ হয়ে উঠতে সক্ষম হয়। কিন্তু বাস্তবতা অনেক ভিন্ন, কারাগারের ওই অঙ্গীকারনামা বাস্তবে কার্যকর নয় কিংবা কার্যকর রাখা সম্ভব হচ্ছে না। কারণ দেশের কারাগারগুলোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা খুবই ভঙ্গুর। বাইরে থেকে দেখতে দুর্ভেদ্য মনে হলেও ভেতরে সব নড়বড়ে। এ যেন অনেকটা বজ্র আঁটুনি ফস্কা গেরো। পদে পদে অনিয়মে ভরা কারাগারগুলোতে টাকার বিনিময়ে মাদক, মোবাইল সুবিধাসহ সব ধরনের আরাম-আয়েশের ব্যবস্থা করে সুযোগ নেয় অনেকে। আর কারাগার থেকে বন্দি পালানো বা হত্যাকাণ্ডের মতো ঘটনা ঘটলেই দুর্বল নিরাপত্তার বিষয়টি সামনে আসে।
বিগত সরকারের পতনের পর কারাগারগুলোর অবস্থা বেশ পরিবর্তন হয়েছিল। খাবারের মান এবং নিয়ম-শৃঙ্খলার অনেকটা উন্নত হওয়ায় বন্দিরাও বেশ আশ্বস্ত ছিলেন। কিন্তু গত কয়েক মাসে ধীরে ধীরে সেই পুরনো অবস্থায় ফিরে যেতে শুরু করেছে। নিষিদ্ধ থাকার পরও এখন কারাগারে অবাধে মোবাইল ফোনে কথা বলছে বন্দিরা। মাদক কারবারসহ অন্যান্য অপরাধও হচ্ছে কৌশলে। একশ্রেণির দুর্নীতিবাজ কারা কর্মকর্তা ও কারারক্ষী বন্দির কাছ থেকে ‘সুবিধা’ নিয়ে অপকর্ম চালানোর সুযোগ করে দিচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
১৭ জুন প্রতিদিনের বাংলাদেশে ‘কারাগারগুলোতে হযবরল অবস্থা, বিপাকে কর্তৃপক্ষ’ শীর্ষক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এসব চিত্র। সম্প্রতি কারাগারে কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সময় আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে হামলাকারী সাভারের বিরুলিয়া ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান সাইদুর রহমান সুজনের গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যার ঘটনায় নিরাপত্তার বিষয়টি আবারও আলোচনায় আসে। কীভাবে তিনি আত্মহত্যা করলেন তা নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠছে। ইতোমধ্যে ঘটনার মূল রহস্য উদঘাটন করতে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও আলাদাভাবে বিষয়টি মনিটরিং করছে বলে জানা গেছে।
প্রতিবেদন বলছে, বর্তমানে দেশে ৬৯টি কারাগার রয়েছে। এগুলোর ধারণক্ষমতা ৪২ হাজারের কিছু বেশি। ৫ আগস্টের পর ৫০ হাজারের কিছু বেশি বন্দি ছিল। তারপর কারাবন্দির সংখ্যা বেড়েছে। বর্তমানে কারাবন্দি রয়েছে ৬৫ হাজারের বেশি। গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৬৯টি কারাগারের মধ্যে ১৭টি কারাগার অনেক পুরনো ও ঝুঁকিপূর্ণ। এসব কারাগার দ্রুত সংস্কার, মেরামত ও পুনর্নির্মাণ না করলে বড় ধরনের দুর্ঘটনার আশঙ্কা রয়েছে। ৫ আগস্ট ও পরবর্তী সময়ে ২২ শতাধিক কারাবন্দি পালিয়ে গেছেন। তার মধ্যে অনেকে স্বেচ্ছায় ফিরে আসেন। আবার অনেককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সব মিলিয়ে ১৫০০ জন ধরা পড়েছে। এখনও কারাগার থেকে পালানো সন্ত্রাসী, জঙ্গিসহ ৭০০ বন্দির হদিস মিলছে না। অন্যদিকে গত কয়েক মাসে জেএমবিসহ বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের ১৭৪ জন জামিনে মুক্তি পেয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন আলোচিত মামলার আসামি ও জঙ্গি সদস্যের মধ্যে এখনও পলাতক ৭০ জন। এসব নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও কারা কর্তৃপক্ষ।
আসলে নানা অনিয়মে ঢাকা দেশের কারাগারগুলো। টাকার বিনিময়ে সব ধরনের সুযোগ নিচ্ছে বন্দিরা। ৮৮টি নেটওয়ার্ক জ্যামারের মধ্যে ৭৮টি বিকল থাকায় বন্দিরা লুকিয়ে মোবাইলে কথা বলার সুযোগ পাচ্ছে বলে দাবি করেছেন কারা কর্মকর্তারা। বলা হচ্ছে, আদালতে হাজিরা শেষে কারাগারে ফেরার সময় মাদক ও মোবাইল ফোন নিয়ে আসছে বন্দিরা। কারাফটকের তল্লাশিতে প্রায়ই তাদের ধরা হলেও অনেকে চোখ ফাঁকি দিচ্ছে। এ নিয়ে বেকায়দায় কারা কর্তৃপক্ষ। কারাগারের ভেতরে বন্দিদের অপরাধ রোধ করতে নানা কৌশল নিয়েও হিমশিম খেতে হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে সবকটি কারাগারে জ্যামার বসানোসহ নানামুখী পরিকল্পনা নিয়েছে কারা কর্তৃপক্ষ। আগামী ছয় মাসের মধ্যে নতুন জ্যামার স্থাপনসহ এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হবে বলে জানা গেছে।
ভালো কারাগার এমন একটি স্থান, যা সংশোধনমূলক এবং পুনর্বাসনের ওপর দৃষ্টি রাখে, যেখানে বন্দিদের মৌলিক চাহিদা পূরণ করা হয় এবং তাদের সমাজে পুনরায় একীভূত হওয়ার জন্য প্রস্তুত করা হয়। নানা সময়ে বলা হয়েছে, বন্দি ধারণক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি কারাগারগুলোকে প্রকৃত সংশোধনাগার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চায় সরকার। সরকারের এ উদ্যোগ প্রশংসনীয়, তবে এর পাশাপাশি কারাগারে বন্দির সংখ্যা হ্রাস করার উদ্যোগও থাকা দরকার। বলার অপেক্ষা রাখে না, এক্ষেত্রে বড় প্রতিবন্ধকতা হলো স্বীকৃত কারাবন্দিদের সঠিক পরামর্শ ও আইনি সহায়তা প্রদানে অপ্রতুলতা এবং প্রচলিত বিচারব্যবস্থার মন্থরগতি। এ থেকে উত্তরণে প্রয়োজনে আইনের পরিবর্তন ও প্রয়োগের পাশাপাশি প্রক্রিয়াগত পরিবর্তনও জরুরি। কারাগারের এমন পরিবেশ দরকার যেখানে কর্তৃপক্ষের সংস্পর্শে এসে বন্দিরা নীতি-নৈতিকতায় সংশোধিত হওয়ার সুযোগ পায়। তাই এসব অনিয়ম বিরুদ্ধে কঠোর হওয়া এবং দায়ীদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ব্যবস্থা নিশ্চিত করা জরুরি। অন্যথায় কারাফটকে লেখা অঙ্গীকারনামা কার্যত ভূলবার্তা তুলে ধরবে। আমরা চাই, সর্বাগ্রে কারাগারগুলো দূষণমুক্ত হোক।