× ই-পেপার প্রচ্ছদ সর্বশেষ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি শিক্ষা ধর্ম ফিচার ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

বেদে সম্প্রদায়

দেশ গঠনে তাদের কাজে লাগানো হোক

দুলাল আচার্য

প্রকাশ : ১৮ জুন ২০২৫ ১৫:৩৪ পিএম

দুলাল আচার্য

দুলাল আচার্য

দেশের একটি প্রান্তিক ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর নাম বেদে সম্প্রদায়। সমাজে এরা মূলত ‘যাযাবর’ জীবনযাত্রার জন্য পরিচিত। এদেরকে বাদিয়া বা বাইদ্যা নামেও ডাকা হয়। অনেকে জলের জিপসিও বলেন। এদের মধ্যে মালবেদে, সাপুড়িয়া, বাজিকর, সান্দার, টোলা, মিরশিকারি, বারিয়াল সান্দা ও গাইন বেদে ইত্যাদি উপগোষ্ঠী রয়েছে। তারা দেশের বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়ায়। তাদের জীবনযাত্রা ও সংস্কৃতি অন্যান্য সম্প্রদায় থেকে ভিন্ন এবং তারা সমাজের মূল স্রোত থেকে কিছুটা দূরে। সমাজসেবা অধিদপ্তরের তথ্যমতে, দেশে বেদে সম্প্রদায়ের সংখ্যা ৮ লাখ। ভূমিহীন এই মানুষেরা জীবনের অধিকাংশ সময়ই নদীতে নৌকায় ভেসে বেড়ায়। তাদের বেশির ভাগেরই সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, আবেগ-অনুভূতি সবকিছু নৌকা আর নদীকেন্দ্রিক। এক কথায় নৌকার মধ্যেই তাদের ঘর-সংসার। জন্ম-মৃত্যু-বিয়ে সবকিছুই সেখানে হয়ে থাকে।

জোয়ার-ভাটার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে তাদের জীবনের গল্প। ঘাটে ঘাটে নৌকা ফেলা আবার নোঙর তুলে নিয়ে অন্যত্র ছুটে চলা তাদের জীবনচিত্র। তারা নাগরিক জীবনের অধিকাংশ রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত। পরিসংখ্যান মতে, বেদে সম্প্রদায়ের প্রায় ৯৮ শতাংশ সদস্য দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। বিশুদ্ধ পানি কিংবা স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটেশন ব্যবস্থার তীব্র সংকট। ভাসমান জীবনযাপনের কারণে বেদেরা শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত। এদের ৯০ শতাংশই নিরক্ষর। মূল পেশা ক্ষুদ্র ব্যবসা হলেও শিঙ্গা লাগানো, তাবিজ বিক্রি, সাপ খেলা, সাপের কামড়ের চিকিৎসা, সাপ বিক্রি, আধ্যাত্মিক স্বাস্থ্য সেবাদান, ভেষজ ওষুধ বিক্রি, কবিরাজি, বানরখেলা দেখানো, চুড়ি-ফিতা বিক্রি, জাদু দেখানো ইত্যাদি তাদের জীবিকা নির্বাহের অবলম্বন। শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত ও বসন্ত সব ঋতুতেই জীবিকার সন্ধানে ওরা ছুটতে থাকে এদিক-ওদিক। নানা প্রতিকূলতার মোকাবিলা করে কোনোমতে বেঁচে থাকতে হয়। অবহেলিত এই জনগোষ্ঠি সভ্য মানুষদের সামনে অবলীলায় জীবন কাটালেও কোনো মানুষই তাদের জীবন নিয়ে ভাবে না অথবা তাদের পুনর্বাসনের কথা কেউ চিন্তা করে না। বরং অনেকেই তাদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য ও অবজ্ঞার চোখে দেখে।

বেদে সম্প্রদায়ের পরিবার ব্যবস্থা মূলত পিতৃতান্ত্রিক। তবে নারীদের পরিবারে একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। পিতৃস্বত্বের অধিকার সাধারণত পুরুষের হাতে থাকলেও, নারীরা পরিবারে অর্থনৈতিক ও সামাজিক দিক থেকে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। বেদে সম্প্রদায়ের পরিবার ব্যবস্থায় ভাই-বোনদের মধ্যে সম্পর্ক এবং পিতামাতার প্রতি শ্রদ্ধা অন্যতম মূল বিষয়। তাদের বিবাহ ব্যবস্থা অত্যন্ত ঐতিহ্যবাহী এবং সাধারণত দীর্ঘ সময় ধরে চলে আসা রীতি অনুসারে চলে। তাদের মধ্যে প্রচলিত রয়েছে আংটি বদল, সাদৃশ্যপূর্ণ বিয়ে এবং বিয়ে সম্পর্কিত অন্যান্য ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান। তবে কিছু ক্ষেত্রে বিবাহ প্রথাগুলো আধুনিক সমাজের প্রথার সঙ্গে মিশে যাচ্ছে এবং এর মধ্যে পরিবর্তন আসছে। বেদে সম্প্রদায়ের মাঝে একাধিক বিয়ের প্রচলন রয়েছে। এই সম্প্রদায়ের পরিবার ব্যবস্থা সামাজিকভাবে সংহত, যেখানে পুরুষ ও নারীর ভূমিকা সুনির্দিষ্ট এবং তাদের বিবাহ ব্যবস্থা ঐতিহ্যবাহী।

তাদের পোশাক সাধারণত খুবই সহজ ও উপযোগী। পুরুষরা লুঙ্গি এবং পাঞ্জাবি পরিধান করেন, আর নারীরা শাড়ি অথবা সালোয়ার-কামিজ পরেন। পোশাকের নির্বাচনে তারা সাধারণত প্রাকৃতিক উপাদান ব্যবহার করে, যা তাদের পরিবেশের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। খাদ্যাভ্যাসের দিক থেকে, বেদে সম্প্রদায় খাদ্য হিসেবে মাংস, মাছ এবং শস্যভিত্তিক খাবার পছন্দের। তাদের খাদ্য তালিকায় আদা, রসুন, শাকসবজি, চাল এবং নানা ধরনের শিকারের মাংস প্রাধান্য পায়। তারা নিজেরা তৈরি করা খাবার খেতে পছন্দ করে, যা তাদের সমাজের ঐতিহ্যের অংশ। বেদে সম্প্রদায়ের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যও খুবই বৈচিত্র্যময়। তাদের সংগীত, নৃত্য এবং শিল্পকলায় এক বিশেষ ধারা থাকে। তারা সাধারণত আঞ্চলিক গীত এবং সংগীতের মাধ্যমে নিজেদের ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতিকে ধরে রেখেছে। এ ছাড়া বিভিন্ন ধরনের লোকগীতি ও লোককাহিনীর মাধ্যমে তাদের ইতিহাস ও সংস্কৃতি পরবর্তী প্রজন্মে সংরক্ষিত থাকে। এই সম্প্রদায়ের জীবনধারা এবং সংস্কৃতি সমাজের মূলধারার থেকে পৃথক।

ধর্মীয় বিশ্বাস এবং আচার-অনুষ্ঠান তাদের অত্যন্ত গভীর এবং ঐতিহ্যগত। ধর্মীয় বিশ্বাসের মধ্যে তান্ত্রিকতা, প্রাকৃতিক শক্তির পূজা করা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বাংলাদেশে অনেক মুসলিম ধর্মীয় বেদে রয়েছে, তারা ইসলাম ধর্মের রীতিনীতি পালন করে থাকে। তাদের বিশ্বাস অনুযায়ী, প্রকৃতির সঙ্গে সম্পর্ক রেখে জীবনের সব দিক নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। তাদের বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসব পালন করে, যেমন ঈদ, পূর্ণিমা, নববর্ষ এবং বিশেষ কোনো দেবতার সম্মানে বিভিন্ন অনুষ্ঠান। এরা সাধারণত নৃত্য, গান এবং তান্ত্রিক আচার-অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস পালন করে থাকে। তাদের উৎসবগুলোর মধ্যে আনন্দ, উল্লাস এবং সম্প্রীতির ঐতিহ্যকে সম্মানিত করার একটি বিশেষ সুযোগ হয়ে থাকে। এই সম্প্রদায়ের ভাষা এবং সাহিত্য তাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। যদিও বেদে সম্প্রদায়ের ভাষা একটি নির্দিষ্ট ভাষা হিসেবে পরিচিত নয়, তারা বিভিন্ন অঞ্চলের স্থানীয় ভাষা ও আঞ্চলিক শব্দ ব্যবহার করে থাকে। এই ভাষার মধ্যে সিলেটী, চট্টগ্রামসহ অন্যান্য আঞ্চলিক ভাষার মিশ্রণ দেখা যায়। তাদের ভাষায় কিছু বিশেষ শব্দ এবং বাক্য রীতি রয়েছে, যা তাদের সম্প্রদায়ের মধ্যে সংহতি এবং পরিচিতির প্রতীক। 

ইতিহাসের পাঠ থেকে জানা যায়, বেদে সম্প্রদায় একটি আদিবাসী সম্প্রদায়, যারা সাধারণত বাংলাদেশ ও ভারতসহ দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে বাস করে। এই সম্প্রদায়টি হাজার বছরের পুরনো। তাদের জীবনযাত্রা, আচার-অনুষ্ঠান, ভাষা এবং ঐতিহ্য সমাজের অন্য অংশ থেকে পৃথক। বিশেষভাবে, তারা জীবনের নানা দিকের জন্য সম্পূর্ণরূপে একক পরিচিতি লাভ করেছে। এই সম্প্রদায়কে সাধারণত ‘ভ্রাম্যমাণ জনগণ’ হিসেবে পরিচিত করা হয়। জানা যায়, ১৬৩৮ খ্রিস্টাব্দে আরাকানরাজ বল্লার রাজার সঙ্গে তাদের প্রথম ঢাকায় আগমন ঘটে। প্রথমে তারা বিক্রমপুরে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। তারপর জীবিকার তাগিদে সেখান থেকে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ও প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও আসামে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে।

এদের জীবনধারার শুরুটা ঠিক এভাবে ছিল না। বহুকাল ধরে তাদের নৌকাতেই বসবাস ছিল। বিভিন্ন নদীতে ছিল তাদের দলবেঁধে চলাফেরা। ছোট ছোট নৌকার বহর নিয়ে দেখা যেত এদের নদীবন্দরে। কিন্তু সময়ের আবর্তনে বাংলাদেশ থেকে নদীগুলো সংকুচিত হতে থাকে, সেই সঙ্গে সংকুচিত হয় বেদেদের জীবনও। এভাবে বেদেরা জীবনের তাগিদে একসময় উপকূলে আসা শুরু করে। একপ্রকার বাধ্য হয়েই বহু বেদে পরিবার এখন বসবাস শুরু করেছে বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় গোষ্ঠীভুক্ত হয়ে। বর্তমানে ঢাকার সাভার, মুন্সীগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, গাজীপুরের জয়দেবপুর, চট্টগ্রামের হাটহাজারী, মিরসরাই, কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামসহ বিভিন্ন স্থানে তাদের বসবাস দেখা যায়। 

বেদে সম্প্রদায়ের জীবনব্যবস্থা এবং তাদের হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনা নিয়ে রচিত হয়েছে অনেক গল্প-উপন্যাস, নির্মিত হয়েছে নাটক-সিনেমা। কিন্তু তারপরও কষ্টের মধ্যে দিন পার করছে দেশের যাযাবর শ্রেণিভুক্ত বেদে সম্প্রদায়। এখনও জীবনযাত্রার ক্ষেত্রে অনেক চ্যালেঞ্জ তাদের। বেশিরভাগ সদস্য এখনও আদিম জীবনযাত্রা অনুসরণ করে। এভাবে বসবাস বেদেদের জীবনে বেড়েছে নানাবিধ শঙ্কা ও অনিশ্চয়তা। একদিকে যেমন নেই তাদের নিরাপদ মাথা গোঁজার কোনো ঠাঁই, অন্যদিকে রয়েছে পরিবারগুলোর ছেলেমেয়েদের ভরণপোষণ-চিকিৎসাজনিত বিশাল সমস্যা। বর্তমানে বেদেরা সম্পূর্ণ ঠিকানাবিহীন ও অনিশ্চিত। এদের কুঁড়েঘরের ছাউনি হয় শত ছিন্ন পলিথিন কিংবা নাইলনের অথবা সিমেন্টের ব্যাগে। আর খেজুর পাতার পাটি দিয়ে তৈরি বিছানা। শিক্ষা এবং চাকরির সুযোগ তাদের জন্য খুবই সীমিত। তাদের বেশিরভাগ সন্তান স্কুলে যেতে পারে না বা শিক্ষা গ্রহণের জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ পায় না। বিশেষ করে মেয়েরা শিক্ষা থেকে বঞ্চিত থাকে এবং পরিবার পরিচালনার দায়িত্বে থাকে। এটি তাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে বাধা সৃষ্টি করে।

আমরা মনে করি, তাদের জীবনধারা এবং ঐতিহ্য ধরে রাখার জন্য সরকারি এবং বেসরকারি উদ্যোগ প্রয়োজন। বিশেষ করে, শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য সুবিধার প্রসার তাদের উন্নতির পথে এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হতে পারে। বিগত সময়ে সমাজকল্যাণ অধিদপ্তর ‘বেদে জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন কর্মসূচি’ নামে একটি কর্মসূচি হাতে নিয়ে ছিল তার অগ্রগতি কতটুকু তা দৃশ্যমান নয়। তবে বেদে সম্প্রদায়ের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা, শিক্ষা, উন্নয়ন প্রকল্প এবং আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে উজ্জ্বল হতে পারে। আগামীর নতুন বাংলাদেশ গড়তে অবহেলিত এই সম্প্রদায়ের জীবনমান ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে সরকার ও সচেতন নাগরিকদের সম্মিলিত প্রচেষ্টাই পারে তাদের মূলধারায় ফিরিয়ে আনতে। এতে বেদে সম্প্রদায়ের অবস্থান আরও সুদৃঢ় হতে পারে এবং তারা সমাজে সমান অধিকারের সুযোগ পেতে পারে। আমরা মনে করি, দেশ গঠনে তাদের সম্পৃক্ত করা জরুরি।

  • সিনিয়র সাংবাদিক
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : মোরছালীন বাবলা

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা