× ই-পেপার প্রচ্ছদ সর্বশেষ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি শিক্ষা ধর্ম ফিচার ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

কানাডা

অপরিনামদর্শীতাই ডেকে আনে দুর্ঘটনা

নিরঞ্জন রায়

প্রকাশ : ১৩ জুন ২০২৫ ১৬:১৬ পিএম

নিরঞ্জন রায়

নিরঞ্জন রায়

গত সপ্তাহে কানাডায় এক মর্মান্তিক দুর্ঘটনার শিকার হয়ে দুজন প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশি অকালে মৃত্যুবরণ করেছেন। ঘটনাটি ঘটেছে বৃহত্তম বাণিজ্যিক শহর টরন্টো থেকে প্রায় দেড়শ কিলোমিটার উত্তরে কত্রা লেক অঞ্চলে। বাংলাদেশের ব্যবসায়ী, টিম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং বিজিএমইএর সাবেক সহ-সভাপতি আবদুল্লাহ হিল রাকিব এবং বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের পাইলট সাইফুজ্জামান কত্রা লেক এলাকায় গিয়েছিলেন কটেজে অবকাশ যাপনের উদ্দেশ্যে। অবকাশ যাপনের সময় রাকিব এবং সাইফুজ্জামান কনুই নিয়ে লেকে গিয়েছিলেন এবং সঙ্গে ছিল রাকিবের ছেলে। লেকে বৈরী আবহাওয়ার কারণে কনুই উল্টে তিনজনই পানিতে পড়ে যায়। রাকিবের ছেলে সাঁতরে তীরে উঠতে পরলেও রাকিব এবং সাইফুজ্জামান দুর্ভাগ্যজনকভাবে পানিতে ডুবে মৃত্যুবরণ করেন। 

এ রকম দুর্ঘটনার শিকার হয়ে কানাডায় বাংলাদেশিদের মৃত্যু যে এটাই প্রথম তেমন নয়। বছর দুয়েক আগে বাংলাদেশি চারজন ছাত্রছাত্রী গভীর রাতে মহাসড়ক দিয়ে বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালিয়ে যাওয়ার সময় দুর্ঘটনায় পড়লে তিনজন ছাত্র-ছাত্রী মৃত্যুবরণ করে। এর আগেও বেশ কয়েকজন বাংলাদেশি সড়ক দুর্ঘটনা এবং অন্য কোনো দুর্ভাগ্যজনক পরিণতির শিকার হয়ে অকালে মৃত্যুবরণ করেছে। এভাবে দুর্ঘটনার শিকার হয়ে বাংলাদেশিদের অস্বাভাবিক মৃত্যু যেন নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আজ থেকে দুবছর আগে টরন্টোর মহাসড়কে বেপরোয়া গাড়ি চালানোর কারণে দুর্ঘটনার শিকার হয়ে তিনজন ছাত্রছাত্রীর মৃত্যুর পর আমি একটি কলাম লিখেছিলাম, যেখানে আমেরিকা-কানাডা ভ্রমণের সময় দুর্ঘটনা এড়ানোর ব্যাপারে কিছু সতর্কতা অবলম্বনের জন্য সুপারিশ করেছিলাম। কিন্তু সেই ঘটনার রেশ কাটতে না কাটেই ঘটে গেল আরেকটি দুর্ঘটনা, যেখানে দুজন প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশিকে হারাতে হয়েছে। 

আমরা আজ যে দুজন প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশিদের অকালে হারালাম, তারা কি আসলেই দুর্ঘটনার শিকার, নাকি নিজেরাই বিপদকে ডেকে এনেছেন। প্রথমত. যখন তারা টরন্টো থেকে প্রায় দেড়শ কিলোমিটার উত্তরে কটেজে অবকাশ যাপনে গেছেন, তখন কানাডায় কটেজে যাওয়ার মতো সময় হয়নি। জুন মাস শুরু হলেও অফিসিয়ালি এখনও বসন্তকাল অর্থাৎ গ্রীষ্মকাল বা সামার শুরুই হয়নি। তাছাড়া এবারের আবহাওয়া মোটেই অনুকূল নয়। এখনও তাপমাত্রা ১০ থেকে ১৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যার অর্থ হচ্ছে বেশ ঠান্ডা। যেহেতু তাদের কটেজ টরন্টো থেকে প্রায় দেড়শ কিলোমিটার উত্তরে, তাই সেখানকার তাপমাত্রা নিশ্চয়ই দশ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচেই ছিল। এ রকম আবহাওয়া কটেজে অবকাশ যাপনের জন্য মোটেই উপযুক্ত নয়। তাদের অবকাশ যাপন কটেজের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও কোনো সমস্যা ছিল না। কিন্তু কটেজ থেকে বের হয়ে এ রকম শীতের মধ্যে কনুই নিয়ে লেকে চলে গেছে পানির আনন্দ উপভোগের জন্য। কনুই হচ্ছে খুবই ক্ষুদ্রাকৃতির একটি ডিঙ্গি নৌকা, যা আমাদের দেশের তালের নৌকার মতো দেখতে। এ রকম নৌকা চালানোর জন্য প্রয়োজন বিশেষ প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা। বিশেষ করে বাতাসের গতিপ্রকৃতি এবং পানির ঢেউয়ের মাত্রা দেখে কনুইয়ের গতি সমন্বয় করতে হয়। আর এটা করতে ব্যর্থ হলে কনুই উল্টে যাবে, এটাই স্বাভাবিক। আমার এক সহকর্মী ছোটবেলা থেকে কনুই চালায়। আমি যখন এই দুর্ঘটনার কথা তার সঙ্গে আলোচনা করছিলাম, তখন সে আমাকে ওপরের কথাগুলো বলেছিল। এই ঠান্ডা আবহাওয়ার মধ্যে কনুই নিয়ে বিশাল লেকে যাওয়ার কথা শুনে আমার সেই সহকর্মী রীতিমতো অবাক। 

সবচেয়ে মারাত্মক ভুল ছিল লাইফ জ্যাকেট পরিধান না করা। কনুই নিয়ে বিশাল লেকে চলে গেছে, অথচ শরীরে লাইফ জ্যাকেট নেই। আমার ভাবতে অবাক লাগে, যারা কনুই ভাড়া দিয়েছে তারা লাইফ জ্যাকেট ছাড়া এটা দিল কীভাবে। নিশ্চয়ই পুলিশি তদন্তে বিষয়টি বের হয়ে আসবে, যদি পুলিশ সঠিক তদন্ত করে। নিহত দুজনই যদি বাংলাদেশি নাগরিক এবং ভিজিট ভিসা নিয়ে কানাডা বেড়ানোর জন্য এসে থাকে, তাহলে পুলিশ হয়তো সেই মাত্রার তদন্ত না-ও করতে পারে। এ রকম দুর্ঘটনায় যদি কানাডার নাগরিক বা স্থায়ী বাসিন্দা মারা যেত, তাহলে পুলিশ তদন্ত করে কনুই সরবরাহকারীকেও শাস্তি দিত।

অনেক ক্ষেত্রে এ রকম হয় যে কনুই এবং লাইফ জ্যাকেট পৃথকভাবে ভাড়া নিতে হয়। আমাদের একটা স্বাভাবিক প্রবণতা আছে যে আমরা অকারণে প্রচুর অর্থের অপচয় করলেও, অনেক সংগত কারণে অর্থ ব্যয় করতে কার্পণ্য করি। এ কারণেই প্রশ্ন জাগে যে অর্থ সাশ্রয়ের উদ্দেশ্যে শুধু কনুই ভাড়া নেওয়া হয়েছে কিন্তু লাইফ জ্যাকেট ভাড়া নেয়াকে অর্থের অপচয় মনে হতে পারে। তা না হলে লাইফ জ্যাকেট ছাড়া কোনো অবস্থাতেই কনুই নিয়ে লেকে যাওয়ার কথা নয়। অনেকেই আমার সঙ্গে একমত না-ও হতে পারেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে আমরা অর্থ সাশ্রয়ের জন্য অনেক প্রয়োজনীয় সার্ভিস না নিয়ে নিজেদের সবসময়ই বিপদের সামনে ফেলে রাখি। একটি দৃষ্টান্ত দিলে বিষয়টি অনেকের কাছে পরিষ্কার হতে পারে। বাংলাদেশ থেকে যারা ভিজিট ভিসা নিয়ে কানাডা আসেন, তাদের অধিকাংশ স্বাস্থ্য বীমা বা হেলথ ইনস্যুরেন্স ক্রয় করে না। আমি যাদের সঙ্গে কথা বলেছি, তাদের কেউই হেলথ ইনস্যুরেন্স নিয়ে কানাডা আসেনি। হেলথ ইনস্যুরেন্স ব্যতীত কানাডা ভ্রমণ যে কতটা বিপজ্জনক হতে পারে, তা একমাত্র ভুক্তভোগীরাই জানেন। একইভাবে যে মহাসড়ক দিয়ে ঘণ্টায় ৭০ কিমি গতিতে গাড়ি চালানর বাধ্যবাধকতা আছে, সেখানে ১৫০ কিমি গতিতে গাড়ি চালিয়ে বিপদে পড়বে, আর তাকে নিছক দুর্ঘটনা বলে চালিয়ে দেবে, তা তো হতে পারে না। 

এসব দুর্ঘটনা বা বিপদ ডেকে আনার জন্য যত না কানাডা বেড়াতে আসা বাংলাদেশিরা দায়ী, তার চেয়ে অনেক বেশি দায়ী আমরা যারা এখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করছি। কেননা যারা বাংলাদেশ থেকে কানাডা বেড়াতে আসেন, তারা এখানকার ভালো এবং খারাপ দিকগুলো সেভাবে জানবে না, এটাই স্বাভাবিক। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারা আমাদের ওপর নির্ভর করে। কিন্তু আমরাও তাদের সঠিক কথাটা বলি না। উল্টো আমরা অতিরঞ্জিত সবকিছু বলে বা দেখিয়ে হিরো সাজার চেষ্টা করি। একবার আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু আমাকে নিয়ে টরন্টো বিমানবন্দরে গিয়েছিল বাংলাদেশ থেকে আগত একজন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে রিসিভ করার জন্য। সেই ব্যক্তিকে নিয়ে যখন ফিরছিলাম, তখন আমার সেই বন্ধু যেভাবে বেপরোয়া গাড়ি চালাচ্ছিল, তাতে আমি নিজেই মারাত্মক ভয় পেয়েছিলাম। যে মহাসড়ক দিয়ে ৭০ কিমি গতিতে চলার কথা, সেখানে সে ১২০-১৩০ কিমি গতিতে গাড়ি চালাচ্ছিল। যত্রতত্র কারণে-অকারণে লেন পরিবর্তন করছিল। আমি বেশ কয়েকবার ইশারায় তাকে গাড়ি চালানোর ব্যাপারে সতর্ক করার চেষ্টা করেও সফল হতে পারনি। সেই বিশিষ্ট ব্যক্তিকে পৌঁছে দিয়ে যখন ফিরছিলাম, তখন আমি তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম যে ‘আপনি এভাবে বেপরোয়া গাড়ি চালালেন কেন?’ উত্তরে সে আমাকে বলল ‘দাদা, বোঝেন না, বাংলাদেশ থেকে এসেছে, তাই একটু দেখালাম, আর কী।’ আমি তাকে বললাম, ‘খুবই ভালো, তবে চরম বিপদের ঝুঁকি নিয়ে।’ 

বাংলাদেশ থেকে কোনো অতিথি এলে পেশাগত আলোচনার জন্য আমরা তাদের সময় পাই না। আত্মীয়স্বজন এবং পরিচিতরা তাদেরকে নিয়ে বিভিন্ন স্থানে নিয়ে যাওয়ার জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে যায়। এই অতিরঞ্জিত আপ্যায়ন এবং আতিথেয়তার পেছনে থাকে এক ধরনের দেখানো এবং শো-আপের প্রবণতা। যারা এখানে বেড়াতে আসেন তাদেরকে ধারণা দেওয়ার চেষ্টা হয় যে আমরা এখানে কত ভালো আছি। এমনও বোঝানোর চেষ্টা করা হয় যে তোমরা এখানে না এসে মারাত্মক ভুল করেছ, আর আমরা এখানে এসে অনেক ভালো কাজ করেছি। অথচ যে দেশে আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি, বা অনেক ক্ষেত্রে যে দেশে ঘিয়ের চেয়ে তেলের মূল্য বেশি, সে দেশ যে খুব ভালো থাকার জায়গা না, তা ঘুণাক্ষরেও বুঝতে দিই না। অবশ্য বাংলাদেশের চেয়ে আমরা হয়তো অনেক ভালো আছি। কিন্তু সেটা তো আর তুলনা করার মাপকাঠি হতে পারে না। কেননা বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ, যেখানে বছর জুড়েই থাকে রাজনৈতিক অস্থিরতা। যাই হোক, কানাডায় আগত অতিথিদের আপ্যায়নের জন্য টানাহ্যাঁচড়া করতে গিয়ে অনেক ক্ষেত্রেই নিয়মনীতির ব্যত্যয় ঘটে, যার পরিণতিতে ঘটে এ রকম দুর্ঘটনা। ফলে অনেক মূল্যবান প্রাণ অকালে ঝরে যায়। আমরা যারা কানাডায় স্থায়ীভাবে বসবাস করি তাদের উচিত হবে কানাডা বেড়াতে আসা বাংলাদেশিদের নিয়ে অতি উৎসাহী হয়ে হিরোইজম দেখানোর পথে না হাঁটা। বরং সব রকম নিয়মনীতি মেনে যা কিছু স্বাভাবিক এবং সাধারণ, তাই যেন করার চেষ্টা করি। 

যে দুজন প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশি দূরদর্শিতার অভাবে দুর্ঘটনার শিকার হয়ে অকালে চলে গেলেন, তারা আর ফিরে আসবে না। অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল তাদের পরিবারের এবং দেশের। যে ছেলে বাবাকে মরতে দেখেও তাকে বাঁচাতে না পেরে নিজে বেঁচে রইল, সে এই শোক সামলাবে কীভাবে, তা কল্পনা করতেও গা শিউরে ওঠে। আমরা তাদের আত্মার শান্তি কামনা এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানানোর পাশাপাশি এটাও প্রত্যাশা করি যে আর কোনো বাংলাদেশি যেন কানাডায় অপরিণামদর্শিতার পরিচয় দিয়ে দুর্ঘটনার শিকার হয়ে অকালে মৃত্যুবরণ না করে। কেননা কানাডা এমন একটি দেশ, যেখানে স্বাভাবিক মৃত্যুর নিশ্চয়তা আছে। তাই এ রকম দেশে কোনো বাংলাদেশির অস্বাভাবিক মৃত্যু কোনোভাবেই কাম্য নয়।

  • সার্টিফায়েড অ্যান্টি-মানিলন্ডারিং স্পেশালিস্ট ও ব্যাংকার, টরন্টো, কানাডা 
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মারুফ কামাল খান

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা