× ই-পেপার প্রচ্ছদ সর্বশেষ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি শিক্ষা ধর্ম ফিচার ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

ভূ-রাজনৈতিক অস্ত্র

নদীমাতৃক বাংলাদেশের পরিবেশ বিপর্যয়

কাজী লতিফুর রেজা

প্রকাশ : ১৩ জুন ২০২৫ ১৬:১৩ পিএম

কাজী লতিফুর রেজা

কাজী লতিফুর রেজা

সময়টা গত বছরের আগস্টের মাঝামাঝি। বন্যা সতর্কতা ছাড়াই ভারত রাতারাতি বাঁধের জলকপাট খুলে দিয়েছিল। এই ফ্ল্যাশ ওয়াটার মিরসরাই, ফেনী, কুমিল্লা, নোয়াখালীতে মহাপ্লাবন সৃষ্টি করে- যা ওই অঞ্চলের মানুষের জন্য ছিল অভিজ্ঞতার অতীত। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, গণঅভ্যুত্থানে তৎকালীন সরকারের পতনের সঙ্গে পূর্ব সতর্কতা ছাড়া জলকপাট খুলে দেওয়ার সম্পর্ক রয়েছে। এবারও বর্ষা সমাগত। দুরন্ত মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে কালবৈশাখীর রুদ্র রূপের দেখা মিলছে। ভারত বাঁধ দিয়ে নদীর জলপ্রবাহে দস‍্যুতা এবং পানিকে ভূ-রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে বাংলাদেশের পরিবেশ বিপর্যয়, উন্নয়ন ও জাতীয় নিরাপত্তা চরমভাবে বিঘ্নিত করছে। 

আমরা জানি ভারতের বাংলাদেশ ঘিরে বাঁধ বঙ্গীয় বদ্বীপের জল প্রকৃতির শৃঙ্খল এবং পরিবেশ ব্যবস্থাকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে। পানি আমাদের জীবন। রামসার কনভেনশন অনুযায়ী, বাংলাদেশের দুই-তৃতীয়াংশ অঞ্চল জলাভূমি। এর মধ্যে ৬৭% এলাকা সারা বছর পানির নিচে থাকে, ২১% এলাকায় বছরে ৯০ সেন্টিমিটারের বেশি বন্যার পানি জমে এবং ৩৫% এলাকায় অগভীর পানি জমে থাকে। এই জলাশয়ের মধ্যে রয়েছে ১০০০টির বেশি নদী, যার মধ্যে ৫৪টি আন্তর্জাতিক নদী। প্রাকৃতিক হ্রদ, জলাধার, হাওর, খাড়ি, বিল, পুকুর এবং মৌসুমি জলাবদ্ধ প্লাবনভূমি প্রভৃতি নিয়ে বাংলাদেশের নদীমাতৃক পরিবেশ। বাংলাদেশ পৃথিবীর বৃহত্তম কৃষিভিত্তিক সমভূমির গঙ্গা বা পদ্মা, ব্রহ্মপুত্র, সুরমা, কুশিয়ারা, মেঘনা, বারাক নিয়ে গঠিত হয়েছে। 

পানি হলো বাংলাদেশের অস্তিত্বের অংশ, সেখানে উজানের দেশ ভারত দশকের পর দশক ধরে তথাকথিত বন্ধু রাষ্ট্র হিসেবে আন্তর্জাতিক আইন ও রীতিনীতির তোয়াক্কা না করে আন্তর্জাতিক পানিপ্রবাহের ওপর দাদাগিরি করছে। ভারতের অকল্পনীয় পানিদস্যুতার কবলে পড়েছে বাংলাদেশ। ভারত নদীকে করেছে ভূ-রাজনৈতিক অস্ত্র। সাংবাদিক এমটি ইসলাম সেপ্টেম্বর ২০২৪-এ বিডিনিউজ২৪-এ প্রকাশিত প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘কীভাবে গত পঞ্চাশ বছরে বাংলাদেশের প্রতিটি সরকার পানি কূটনীতিতে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে।’ নদী রক্ষা কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান মনজুর আহমেদ যথার্থই বলেছেন, ‘নদীর ব্যাপারে ভারত বাংলাদেশের অবিশ্বস্ত বন্ধু।’ 

কার্যত বাংলাদেশ একটি বাঁধবন্দি দেশ। এর দৃঢ় প্রমাণ মেলে যখন ২৯টি পরিবেশবাদী সংগঠনের সমন্বিত উদ্যোগে বিশ্ব নদী দিবস ২০২৪-এ সেমিনারে উপস্থাপন করা প্রবন্ধে। ওই প্রবন্ধে বলা হয়েছে, ‘আন্তঃসীমান্ত নদ-নদীতে বাঁধ নির্মাণের জন্য আন্তর্জাতিক আইন থাকলেও ভারত বাংলাদেশের ক্ষেত্রে অধিকাংশ সময়ই এসব আইনের তোয়াক্কা করছে না। এরই মধ্যে ভারত আন্তঃসীমান্ত স্বীকৃত ৫৪ নদীর ৩৬টির ওপরই মোট ৫৪টি ব্যারাজ এবং ড্যাম তৈরি করেছে। ফলে এসব বাঁধ ভাটি অঞ্চলে পানির স্বাভাবিক ও যথাযথ প্রবাহে বিঘ্ন ঘটাচ্ছে। গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা অববাহিকার উজানে ভারত পানি একতরফা নিয়ন্ত্রণ করছে। বাঁধ দিয়ে পানি সরিয়ে নেওয়ায় কারণে বাংলাদেশের নদীগুলোর পানি ন্যায্য প্রাপ্যতা ও নাব্যতা শুষ্ক মৌসুমে ব্যাপকভাবে কমেছে। শুধু গঙ্গা নদীর অববাহিকাজুড়ে ভারত ১৮০টির বেশি বাঁধ দিয়েছে। উত্তর-পূর্ব ভারতের সেভেন সিস্টার্স এলাকায় বয়ে যাওয়া অভিন্ন নদীতে ভারতের প্রায় ৩০টি ব্যারাজ, ড্যাম ও পানির সংরক্ষণাগার তৈরি করেছে।…. ভারত গঙ্গার প্রায় ৬০% পানি বাংলাদেশ থেকে কৌশলে বঞ্চিত করেছে। শুধু তাই নয়, উত্তর প্রদেশ, বিহার ও পশ্চিমবঙ্গে অবস্থিত প্রায় ৩০০টি ছোট-বড় পানি নির্মাণ প্রকল্পের মাধ্যমে অতিরিক্ত পানি প্রত্যাহার করে নেয়।… 

এই পরিবেশ বিপর্যয়ের বিষয়টি যে সবচেয়ে ভালো অন্তঃকরণ করেছিল, তিনি হলেন পরিবেশ কর্মী কপিল ভট্টাচার্য। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সেচ দপ্তরের এই সুপারিনটেনডিং ইঞ্জিনিয়ার কপিল ভট্টাচার্য নিজের উদ্যোগে তৈরি করে ফেলেছেন একটি গ্রাউন্ড রিপোর্ট, ‘কেন ওই ফারাক্কা বাঁধ পরিবেশের জন্য ক্ষতিকারক হবে।’ 

সেই রিপোর্ট সংকলিত হয়েছিল নদ-নদী নিয়ে তার আকর গ্রন্থ বলে স্বীকৃত ‘বাংলাদেশের নদ-নদী ও পরিকল্পনা’-তে। তিনি ফারাক্কা বাঁধের প্রভাব নিয়ে যা যা ভবিষ্যদ্বাণী করে গিয়েছিলেন সেই পঞ্চাশের দশকে, আজতকে তা বাস্তব অভিজ্ঞতার আমরা দেখছি। বাংলাদেশে গঙ্গা নদীর প্রবাহ কমে যাওয়ার ফলে দেখা দিয়েছে : মিঠাপানির অভাব, বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণীর বিলুপ্তি ও বিপন্নতা, ফসল উৎপাদনে ও গবাদিপশু পালনে সংকট, জীবিকার ক্ষতি, বাস্তুচ্যুতি, নৌপথ সংকোচন, চরম আবহাওয়া, বন্যার প্রবণতা বৃদ্ধি, বিশুদ্ধ পানির সংকট, ভূগর্ভস্থ পানির দূষণ, উপকূলীয় অঞ্চলে পলিমাটি জমার হার কমে যাওয়া, গঙ্গার পানির মানের অবনতি এবং লবণাক্ততা অভ্যন্তরে অনুপ্রবেশ ইত্যাদি। ফলে উপকূলীয় অঞ্চলে বাংলাদেশ জমি হারাচ্ছে। লবণাক্ততার সীমারেখা ধীরে ধীরে ভেতরের দিকে এগিয়ে আসছে। বাংলাদেশের নদীগুলোর পানির গুণগত মান ক্রমাগত খারাপ হচ্ছে। অন্যান্য নদীতেও পানি প্রত্যাহারের জন্য নির্মিত স্থাপনা একই ধরনের পরিবেশগত সমস্যার সৃষ্টি করেছে।

এ ছাড়াও ভারত সীমান্তবর্তী নদীগুলো থেকে চুপিসারে বাংলাদেশের পানিও পাম্প করে নিচ্ছে। বিগত সরকারের আমলে ফেনী নদীর পানি ভারত আন্তর্জাতিক আইন না মেনেই ১০০-এর ওপর উচ্চক্ষমতা পাম্প দিয়ে পানি উত্তোলন শুরু করে। ফলে শুষ্ক মৌসুমে ফেনী অঞ্চলে জল সংকট দেখা দেয়। সরু এই পাহাড়ি নদীর ভারত অংশে তীরে বাঁধের কারণে বাংলাদেশ অংশে ভাঙনের শিকার হচ্ছে। 

আরও একটি বড় বাঁধ ও জলাধার ভারত গড়ে তুলছে বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত বরাক নদীর উজানে। বরাক নদীতে টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ হলে বাংলাদেশের অনন্য হাওর অঞ্চলের পরিবেশ একইভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে, যেমন গঙ্গা অববাহিকার হয়েছে।

ত্রিপুরা রাজ্যে বাঁধ দিয়ে ছোট ছোট অনেক জলাধার তৈরি করেছে, আমরা দেখেছি ভারত বিনা নোটিসে সবকটি বাঁধ একযোগে খুলে দিয়ে বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চল প্লাবিত করছে।

এই বিপর্যয়ের পেছনে পানিকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের ভূ-রাজনৈতিক কারণ যেমন ছিল, তেমনি করে বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা হুমকির কোথায়, তা পরিষ্কার হয়ে ধরা পড়ে। বাংলাদেশের সরকারকে দেশের স্বার্থে কঠোর অবস্থান নিতে হবে। ভারত-বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক আলোচনার সঙ্গে সঙ্গে আন্তর্জাতিক স্তরে বা জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে ন্যায্য পানির অংশ নিশ্চিত করতে পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। এ ছাড়াও ভারত দখল করে রাখা নদীর চরগুলো ফিরে পেতে জাতিসংঘের সহায়তা চাওয়া উচিত। বহুমাত্রিক পানি কূটনীতিতে বাংলাদেশ সক্রিয় হতে হবে, যা বাংলাদেশ কখনই করেনি।

জলবায়ু পরিবর্তন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত বলেন, পানি নিয়ে আমাদের জাতীয় পরিকল্পনা আছে কিন্তু বাস্তবায়নটা এখনও সমন্বিতভাবে হয়নি। বাংলাদেশের উচিত একটি জাতীয় পরিকল্পনার আওতায় নদী ও খাল খনন করে পানি সংরক্ষণ এবং শুষ্ক অঞ্চলে তা বিতরণের মাধ্যমে আর্দ্রভূমি ও জলজ পরিবেশ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা। এটি ভূগর্ভস্থ পানিতে আর্সেনিক দূষণ, মাছের সংকট, অস্থির জলবায়ু প্রভৃতি সমস্যার ধীরে ধীরে নিরসনে সহায়ক হবে। যেহেতু উজানের পানি দস্যুতার কারণে নদী-খালগুলো পলি জমে ভরাট হয়ে গেছে, তাই বাংলাদেশকে এই খনন খরচ উজান দেশ ভারতকে বহন করানোর জন্য দাবি জানানো উচিত।

যেহেতু জীববৈচিত্র্য রক্ষার বিষয়টি এখন একটি আন্তর্জাতিক অগ্রাধিকারের বিষয়, বাংলাদেশ জাতিসংঘের কাছে আবেদন জানাতে পারে যেন আন্তর্জাতিক নদীতে নতুন বাঁধ, ব্যারাজ, জলাধার ও সংযোগ খাল নির্মাণ বন্ধে কঠোর আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগ করা হয়। যারা এই আইন লঙ্ঘন করবে, তাদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা উচিত। প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক আদালতের দ্বারস্থ হওয়াও হতে পারে বাংলাদেশের জন্য একটি কার্যকর বিকল্প। 

ক্ষুদ্র পরিসরের জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে, বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে গ্রীষ্মকালে উচ্চতাপমাত্রা এবং শীতকালে অতিমাত্রায় নিম্ন তাপমাত্রা ও অনিয়মিত বৃষ্টিপাত পরিলক্ষিত হয়েছে। ভারতের পানিনীতির আগ্রাসন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, এটি বাংলাদেশের ভূপ্রকৃতির মানচিত্র পর্যন্ত বদলে দিচ্ছে। ভারতকে স্মরণ করিয়ে দিতে হবে যে, এসব সম্ভাব্য প্রভাব তাদের রামসার চুক্তির বিরোধী, যেখানে বাংলাদেশ ডেল্টাকে মরুভূমিতে রূপান্তরিত না করার প্রতিশ্রুতি রয়েছে।

জাতীয় নিরাপত্তার অন্তর্গত বিষয়গুলোর মধ্যে রয়েছে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়ন। দৃশ্যমান ও পূর্বাভাসযোগ্য সব চ্যালেঞ্জ বাংলাদেশের পরিবেশ ব্যবস্থাকে এতটাই দুর্বল করে ফেলেছে যে, জাতীয় নিরাপত্তা এখন টালমাটাল। এর ফলে মানুষের কল্যাণ, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, অর্থনৈতিক নিরাপত্তা এবং সামগ্রিকভাবে অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতার ঝুঁকি বাড়ছে। চরম পরিবেশ বিপর্যয় ও দুর্যোগের মানুষজনের জীবন ও জীবিকা হয়ে পড়ছে অনিরাপদ এবং প্রতিবেশীকে বোঝাতে হবে বাংলাদেশ অস্থিতিশীলতা এবং বিপর্যয় ঘটলে, ভারত এর থেকে নিজেকে দূরে রাখতে পারবে না, তারাও সমান ক্ষতির সম্মুখীন হবে। 

ভারতের পানিদস্যুতার বিষয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে জনসচেতনতা সৃষ্টি, মতামত গঠন ও কূটনৈতিক চাপ সৃষ্টির লক্ষ্যে সরকার এবং বেসরকারি পর্যায়ে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ জরুরি। এ লক্ষ্যে একটি বিশেষায়িত গবেষণা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা প্রয়োজন, যা নদী ও পানিসম্পদ বিষয়ক সংকট মোকাবিলায় নীতি নির্ধারণ, তথ্যভিত্তিক প্রচারণা এবং কূটনৈতিক ও আইনি ব্যবস্থার প্রস্তুতির মাধ্যমে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারবে।

  • সহযোগী অধ্যাপক, আইন ও মানবাধিকার বিভাগ, আরপি সাহা বিশ্ববিদ্যালয় 
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মারুফ কামাল খান

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা