× ই-পেপার প্রচ্ছদ সর্বশেষ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি শিক্ষা ধর্ম ফিচার ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

পরিবেশ

লাখো মানুষের দুঃখের নাম ভবদহ

দুলাল আচার্য

প্রকাশ : ০১ জুন ২০২৫ ১৫:৫৬ পিএম

দুলাল আচার্য

দুলাল আচার্য

যশোর ও খুলনার ১৫ লাখ মানুষের দুঃখের নাম ভবদহ। যশোর জেলার অভয়নগর, মণিরামপুর ও কেশবপুর এবং খুলনা জেলার ডুমুরিয়া ও ফুলতলা উপজেলার অংশবিশেষ নিয়ে এই ভবদহ। এই অঞ্চলটি বিল, নদী, খাল, গ্রামীণ জনপদের বৈচিত্র্যপূর্ণ ভূমি। এখানকার গ্রাম ও জলাশয় দুটোই সমান। এই জনপদের হাট-বাজার, খেলার মাঠ, গোচারণ ভূমি সবই জলাবদ্ধ। কখনও কখনও স্থলভাগের সন্ধান করা দুরূহ হয়ে যায়। কঠিন হয়ে পড়ে বসতির নিদর্শন নিরূপণ করাও। কখনও প্রকৃতি কখনওবা মানবসৃষ্ট নিয়তি যেন এই মানুষগুলোর নিত্যসঙ্গী। বিশেষ করে বর্ষা মৌসুম এলে এই নিয়তি যেন চরম দুর্ভোগে রূপ নেয়। এই জলাবদ্ধতার সমস্যা বেশ পুরোনো। বিভিন্ন সময়ে সরকার জলাবদ্ধতা নিরসনে বহু কর্মপরিকল্পনা নিলেও দুঃখ যেন কিছুতেই কাটছে না এই অঞ্চলের মানুষের। তাই দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের এই পুরোনো সমস্যাটির সমাধানের দাবি দীর্ঘদিনের। অভিযোগ রয়েছে, নানা সময়ে ভবদহ এলাকা সংস্কারের নামে শত শত কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। প্রকল্পের বরাদ্দের টাকা পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়, পানি উন্নয়ন বোর্ড, ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নেতা ও ঠিকাদার চক্র লুটপাট করেছে। ফলে হাজার কোটি টাকার প্রকল্পেও সুফল মেলেনি এই অঞ্চলের। 

ভবদহের ভৌগোলিক অবস্থান অনুযায়ী, এর উত্তরে যশোরের উঁচু অঞ্চল, পলি পড়ে দক্ষিণে খুলনার নিচু অঞ্চলও এখন উঁচু হয়ে গেছে; আর পূর্বে ভৈরব নদের পূর্ব অববাহিকা আগে থেকেই উঁচু এবং পশ্চিমে কপোতাক্ষের পশ্চিম অববাহিকাও অপেক্ষাকৃত উঁচু। ফলে ভবদহের আকার অনেকটা ‘বেসিন’-এর মতো হয়ে উঠেছে। চারদিকের পানি এই বেসিনে জমে; কিন্তু নেমে যাওয়ার পথ নেই। ফলে এ অঞ্চল জলাবদ্ধতায় ধুঁকছে বছরের পর বছর। সমাধানে বারবার নেওয়া ‘ভুল প্রকল্প’ শুধু রাষ্ট্রের অর্থই অপচয় করেনি; বাড়িয়েছে ভুক্তভোগীদের কষ্টও। যে কারণে একটু ভারী বৃষ্টি হলেই ফসলের মাঠ, মাছের ঘের, পুকুর, খাল-বিল উপচে পানি উঠে যায় উঠানে, ঘরে, মসজিদে-মন্দিরে, স্কুলে-কলেজসহ নানা প্রতিষ্ঠানে। একের পর এক ‘আত্মঘাতী’ প্রকল্পের খেসারত দিতে হচ্ছে ভবদহের মানুষকে। সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাবে এসব প্রকল্প ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে এনেছে বলে মনে করেন জলাবদ্ধ এলাকার মানুষ। 

ইতিহাস বলছে, একসময় ভবদহ বিল দিয়ে ২৭ বিলের পানি নদীতে গিয়ে নামত। সমুদ্রের লবণ পানি ঠেকিয়ে চাষাবাদ ও সবুজায়নের নামে পানি উন্নয়ন বোর্ড ১৯৬১ সালে ভবদহের পাঁচটি স্থানে ৪৪টি পোল্ডার (স্লুইসগেট) বসায়। ফলে ২১টি কপাটের মধ্যে ১৮টি পলি জমে বন্ধ হয়ে যায়। বলা চলে, এরপর থেকে আশপাশের মুক্তেশ্বরী, শ্রীহরি ও টেকা নদী নাব্যতা হারায়। ষাটের দশকে ভবদহ থেকে বারোহাটি নদী ১৫০ থেকে ২০০ মিটার প্রস্থ ছিল; কিন্তু এখন সেটি মাত্র ১৫ থেকে ২০ মিটার। একই অবস্থা অন্য নদ-নদীরও। 

১৯৮১ সালের পর থেকে জলাবদ্ধতা ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। নদীগুলো নাব্যতা হারানোয় প্রতিবছর সামান্য বৃষ্টিতেই নদীর দুই কূল ছাপিয়ে প্লাবিত হয় সমতল। তবে জলাবদ্ধতার ভয়াবহতা পরিলক্ষিত হয় ১৯৮৬ ও ১৯৮৮ সালে। এ সময় ভবদহ অঞ্চলের প্রায় ৯৮ ভাগ মানুষের ঘর ছিল মাটি ও খড়ের তৈরি। অপ্রত্যাশিতভাবে ৯০ ভাগ মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়ে। সেই থেকে শুরু হয় মানবেতর জীবনযাপন। বেঁচে থাকার নতুন এক যুদ্ধ। কিন্তু কোনো সরকারের আমলেই এই অঞ্চলের জলাবদ্ধতা দূর করার স্থায়ী সমাধানের তাগিদ দেখা যায়নি। অতঃপর ভবদহে ‘টিআরএম’ (টাইডাল রিভার ম্যানেজমেন্ট) প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। সেই থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত ভবদহে জলাবদ্ধতা হয়নি। ভবদহের পানিবন্দি মানুষের দীর্ঘ আন্দোলনের পর ১৯৯৮ সালে তৎকালীন পানিসম্পদ মন্ত্রীর উপস্থিতিতে সরকার এক কনভেনশনে পর্যায়ক্রমে বিলগুলোতে ‘জোয়ারাধার’ বা টিআরএম প্রকল্প গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু স্থানীয় লোকজন এবং মাছের ঘের মালিকরা টিআরএমের বিরোধী ছিল। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০১২ সালে প্রভাবশালীদের একাংশ ও ঘের মালিকরা জোটবদ্ধ হয়। এরপর এ অঞ্চল ঘিরে আর গুরুত্ব না দেওয়ার কারণে আবার জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। অবশ্য ২০০৭ সালে বিল খুকসিয়ায় সরকার আবার ‘টিআরএম’ চালু করে। এরপরের কয়েক বছর আবার জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি পায় ভবদহবাসী। সর্বশেষ ২০২০ সালে ভবদহ অঞ্চলে আবার জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। বর্তমানে ভবদহের জলাবদ্ধতা নিরসনে এলাকার কোনো বিলে ‘জোয়ারধার’ টিআরএম কার্যকর নেই। 

ভবদহের ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়, পানি উন্নয়ন বোর্ড আগে যত কর্মসূচি গ্রহণ করেছে, তার বেশিরভাগ ছিল সাময়িক সমাধানের চেষ্টা। এতে গুরুত্ব দেওয়া হয় খননযন্ত্র দিয়ে নদী খননে। এদিকে পাউবোর নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ১৯৯৭ সালের ২৯ অক্টোবর ভরতভায়না নামক স্থানে ভায়না বিলের বাঁধ কেটে দেয় স্থানীয়রা। এতে জোয়ারের তোড়ে ৩ থেকে ৫ ফুটের গভীরতার নদী ১৮ মিটার পর্যন্ত গভীর হয়ে যায়। বিলের তলদেশে গড়ে এক মিটারের বেশি পলি পড়ে উঁচু হয়। নদীর মুখে বিল উঁচু হয় আড়াই মিটার এবং শেষের দিকে অর্ধমিটারের কিছু বেশি। পরবর্তী সময়ে দেখা যায়, সব বিল জলাবদ্ধতার শিকার হলেও ভায়নার বিলের কৃষকেরা ফসল ফলাতে পারছেন। যারা ভায়নার বিলের বাঁধ কেটে দিয়েছিলেন, তাদের নামে পানি উন্নয়ন বোর্ড ফৌজদারি মামলা দায়ের করে। এতে পুলিশি ধরপাকড় শুরু হয়। অনেক কৃষক আত্মগোপনে চলে যান, অনেকে জেল খাটেন। কিন্তু জলাবদ্ধতা দূর করতে সাধারণ মানুষের এ প্রাকৃতিক পন্থাকে পাউবো গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। কৃষকদের উদ্ভাবিত এই পন্থাকে স্থানীয় ভাষায় বলা হয় ‘ডাকজোয়ার’। এই প্রথাকেই পানি উন্নয়ন বোর্ড নাম দেয় টিআরএম বা জোয়ার-আঁধার (জোয়ারাধার)।

একসময় নানা পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ করে ভবদহ জলাবদ্ধতা সমস্যার অন্যতম সমাধান হিসেবে ‘জোয়ারধার’ পদ্ধতিকে বেছে নেওয়া হয়েছিল। মূলত নদীসংলগ্ন বিলে বাঁধ তৈরি করে নদীর পাড় কেটে দিয়ে জোয়ারের সঙ্গে নদী দিয়ে আসা পলি বিলে জমা হতে দেওয়া হয়। এতে করে নদীর নাব্যতা অটুট থাকে। বিলে বাঁধ দিয়ে ‘টিআরএমের’ মাধ্যমে পলি ব্যবস্থাপনার এই পদ্ধতিকে বলা হয় ‘জোয়ারধার’। পলি ব্যবস্থাপনার এই পদ্ধতি এ অঞ্চলে স্থানীয়ভাবে এবং পরে সরকারিভাবে জলাবদ্ধতা নিরসনে ব্যবহার করা হতো। এ ব্যবস্থার ফলে ভবদহে বর্ষা মৌসুমে জলাবদ্ধতা হতো না। এ বাস্তবতায় বর্ষা মৌসুমে যে বছর ‘জোয়ারধার’ কার্যকর না থাকে; সে বছর যশোরের ভবদহ অঞ্চলের লাখ লাখ মানুষের দুঃখের অন্ত থাকে না। বিপুলসংখ্যক মানুষের জীবিকার পথ বন্ধ হয়ে যায়। ফলে আবারও জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। বিশেষ করে বর্ষা মৌসুমে ভবদহে শত শত গ্রাম জলমগ্ন হয়ে পড়ে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায়। হাজার হাজার হেক্টর জমিতে আমন ধান নষ্ট হয়ে যায়। পানিবন্দি মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি বেড়ে যায়। এই অস্বাভাবিক জীবনযাত্রার ফলে ভবদহবাসীর জীবনে ঘোর অন্ধকার নেমে আসে। 

আসলে ভবদহ ও তৎসংলগ্ন বিল এলাকার জলাবদ্ধতা দূরীকরণ প্রকল্প নামে ভবদহ এলাকার আশপাশের নদ-নদী খনন, কালভার্ট-বাঁধ নির্মাণ, স্লুইসগেট নির্মাণ ও সংস্কারের কথা রয়েছে। ভবদহ জলাবদ্ধতার স্থায়ী সমাধান কাম্য। আমরা মনে করি, স্লুইসগেটগুলোর পলি দ্রুত অপসারণ করতে হবে। পরিকল্পিতভাবে ব্যবস্থা নিলে ‘টিআরএম’ নদী সচল করতে পারে। কেননা পাখিমারা বিলে (সাতক্ষীরার তালায়) ‘টিআরএম’ প্রকল্পের ফলে কপোতাক্ষ নদ কিছুটা হলে সচল করা গেছে। তবে ‘টিআরএম’ বাস্তবায়নে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর ব্যাপক সম্পৃক্ততা ও পর্যবেক্ষণ প্রয়োজন। ভবদহে ‘টিআরএম’ আবার বাস্তবায়ন করা গেলে জলাবদ্ধতা যেমন দূর হবে; তেমনি নদ-নদীও সচল থাকবে।

পরিবেশবিদরা মনে করেন, ভবদহ অঞ্চলের জলাবদ্ধতা নিরসনের একমাত্র উপায় প্রকৃতিকে তার স্বাভাবিক গতিতে চলতে দেওয়া। ভুক্তভোগী মানুষ, আন্দোলনরত সংগ্রাম কমিটির নেতারা এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাদের অভিমত হলো, এই অঞ্চলের জলাবদ্ধতা দূর করতে দরকার জোয়ারাধার পদ্ধতি চালু করা। পাশাপাশি চুয়াডাঙ্গার দর্শনায় মাথাভাঙ্গা-পদ্মার সঙ্গে ভৈরব নদের সংযোগ পুনঃস্থাপিত করে ভৈরব নদ ও মুক্তেশ্বরী নদী সংস্কার করা। এতে এলাকার নদীগুলো স্বাভাবিক প্রবাহ ফিরে পাবে। ভবদহ অঞ্চলের পানি ওঠানামা করে মুক্তেশ্বরী, টেকা, শ্রী ও হরি নদী দিয়ে। চলমান জলাবদ্ধতার মূল কারণ বাঁধ ও স্লুইসগেটের জন্য পলি জমে এই নদীগুলোর তলদেশ উঁচু হয়ে পড়া; আর এলাকার বিলগুলো নদীর তুলনায় নিচু হয়ে যাওয়া। তাই টানা বর্ষণ হলে বিল উপচে পুরো ভবদহ অঞ্চল পানিতে তলিয়ে যায়।

এলাকাবাসীর দাবি, ভবদহ জলাবদ্ধ অঞ্চলকে ‘দুর্গত’ অঞ্চল ঘোষণা করে সরকার ভুক্তভোগী মানুষের পাশে দাঁড়াক। প্রয়োজনে জাতীয় বাজেটে এ ব্যাপারে বিশেষ বরাদ্দের ব্যবস্থা করা হোক। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, পুনর্বাসনসহ সরকারি সহায়তা না পেলে এই অঞ্চলটি ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব হবে না। তাই স্থায়ী সমাধানের জন্য একটি সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা জরুরি। সম্প্রতি অন্তর্বর্তী সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় এবং পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান ভবদহ অঞ্চলের সমস্যা সমাধানে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন। এ আশ্বাসের অপেক্ষায় লাখ লাখ ভবদহবাসী।

  • সাংবাদিক
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : মোরছালীন বাবলা

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা