তারুণ্য
রহমান মৃধা
প্রকাশ : ৩০ মে ২০২৫ ১৬:০৪ পিএম
রহমান মৃধা
যখন রাষ্ট্রচিন্তা দুর্বল হয়ে পড়ে, নেতৃত্বে নৈতিক অবক্ষয় স্পষ্ট, তখন আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল মনে করিয়ে দেন: নেতৃত্ব মানেই ক্ষমতা নয়, এটি একটি পবিত্র দায়িত্ব। কাজী নজরুল ইসলামের লেখা ও জীবনদর্শনে যে জাতীয় আদর্শ গাথা আছে, সেটা আজকের বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক। এই প্রবন্ধ সেই অসমাপ্ত স্বপ্নের পথেই একটি নৈতিক প্রশ্নের উত্তরের খোঁজ করে।
বাংলাদেশ আজ এক নৈতিক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। এই মুহূর্তে জাতির ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হচ্ছে একটি গভীর প্রশ্নের মাধ্যমে : এই দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে কারাÑ মেধা ও সততার পথিকৃৎ নেতৃত্ব, নাকি উত্তরাধিকার ও দুর্নীতির ছায়াতলে বেড়ে ওঠা সুবিধাবাদী গোষ্ঠী?
একদিকে রয়েছেন এমন কিছু নাগরিক, যারা দীর্ঘদিনের শিক্ষা, পেশাদারিত্ব এবং নৈতিক দৃঢ়তা দিয়ে নিজেদের নেতৃত্বের জন্য প্রস্তুত করেছেন। তারা কখনও ক্ষমতার পেছনে ছোটেননি, বরং দায়িত্বকে সম্মান জানিয়ে কাজ করেছেনÑ দেশের অভ্যন্তরে হোক কিংবা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে। তাদের সিদ্ধান্তে থাকে ভবিষ্যৎমুখী দৃষ্টিভঙ্গি, কার্যপদ্ধতিতে থাকে জবাবদিহিতা এবং বিশ্বাসে থাকে দেশের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা।
অন্যদিকে আমাদের রাজনীতিতে এমন এক উত্তরাধিকারভিত্তিক গোষ্ঠীর প্রভাব প্রকট, যারা কেবল পারিবারিক নাম, দলীয় ক্ষমতা এবং প্রশাসনিক সুবিধাকে পুঁজি করে নেতৃত্বে এসেছে। নিজেদের ব্যক্তিগত দক্ষতা বা জনসেবার মানসিকতা প্রমাণ না করেই তারা প্রতিষ্ঠা পেতে চেয়েছে রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক কাঠামোর অপব্যবহারের মাধ্যমে। তাদের কাছে রাজনীতি জনসেবা নয়, বরং ব্যক্তিস্বার্থ রক্ষার এক কৌশলী হাতিয়ার। দুর্নীতি, বিচারহীনতা এবং অবাধ ক্ষমতা যেন এই নেতৃত্বের স্বাভাবিক অঙ্গ হয়ে উঠেছে।
বাংলাদেশের ইতিহাস স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে, যখন নেতৃত্বে এসেছে মেধা ও সততা, তখন রাষ্ট্র হয়েছে নীতিনিষ্ঠ, স্বচ্ছ ও আন্তর্জাতিকভাবে সম্মানিত। আর যখন নেতৃত্ব এসেছে কেবল উত্তরাধিকার ও ক্ষমতার মোহে, তখনই আমরা দেখেছি রাষ্ট্রযন্ত্রের দুর্বলতা, সামাজিক বিভাজন ও গণতন্ত্রের বারবার অপমান।
এই বাস্তবতায় তরুণ প্রজন্মের সামনে আজ এক কঠিন দ্বন্দ্ব : তারা কি ভবিষ্যতের জন্য স্বচ্ছতা, দক্ষতা ও আদর্শনিষ্ঠ নেতৃত্ব বেছে নেবে, নাকি আত্মস্বার্থ ও প্রভাবের খেলায় বন্দি থেকে আবারও একটি অন্ধকার অধ্যায়ের সাক্ষী হবে?
এখনই সময়- মেধার মূল্যায়ন করতে হবে, সততার পুরস্কার নিশ্চিত করতে হবে এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। নেতৃত্ব এমন মানুষদের হাতে থাকা উচিত যারা দেশকে ভালোবাসেন, জনগণের কাছে জবাবদিহি মানেন এবং নেতৃত্বকে দেখেন এক মহান দায়িত্ব হিসেবেÑ নয় কোনো সুযোগ ভোগের প্রতীক।
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম শুধু একজন কবি ছিলেন না, তিনি ছিলেন একটি মুক্তচেতা বিদ্রোহী আত্মার প্রতীক, যিনি চিন্তা, চেতনা এবং কলম দিয়ে জাতিকে ন্যায়, সাম্য ও মানবতার পথে আহ্বান জানিয়েছিলেন। তার কবিতা যেমন অন্যায়ের বিরুদ্ধে নির্ভীক উচ্চারণ, তেমনি তা ছিল শোষিত-বঞ্চিত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর সাহসী ঘোষণা।
আজকের বাংলাদেশে যখন রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা, সামাজিক বৈষম্য এবং মতপ্রকাশের সংকোচ এক গভীর সংকট তৈরি করছে, তখন নজরুলের আদর্শ নতুন করে সামনে আনার প্রয়োজনীয়তা আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি।
নজরুল এমন একটি সমাজের স্বপ্ন দেখেছিলেন, যেখানে মানুষকে ধর্ম, বর্ণ, জাতি কিংবা শ্রেণির ভিত্তিতে বিচার করা হবে না। তার ‘আমি চিরবিদ্রোহী বীর’ উচ্চারণ কেবল ব্যক্তি-স্বাধীনতার দাবি নয়, বরং একটি মুক্ত গণতান্ত্রিক চেতনার সাহসী ঘোষণা। আজকের বাংলাদেশে এই বিদ্রোহী চেতনা হতে পারে নতুন রাজনৈতিক দর্শনের ভিত্তি।
নজরুলের সাহিত্য, তার আদর্শ ও জীবনদর্শন একটি জাতিকে নির্মাণ করার নৈতিক রসদÑ যা এখনও অসমাপ্ত রয়ে গেছে। তিনি বাঙালির আত্মপরিচয়ের ভিত্তি রচনা করেছিলেন। আজ এই জাতি যখন বিভ্রান্তির মধ্যে দিক হারাচ্ছে, তখন নজরুল হতে পারেন দিকনির্দেশক আলোকবর্তিকা।
আজকের তরুণ সমাজকে এক জটিল বাস্তবতার মধ্যে বড় হতে হচ্ছেÑ বেকারত্ব, মতপ্রকাশের দমন, বিচারহীনতা এবং সাংস্কৃতিক বিচ্যুতি তাদের মনন ও আত্মবিশ্বাসকে ক্ষয় করছে। কিন্তু এই অবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে নজরুলীয় বিদ্রোহÑ যা বিনাশ নয়, বরং ন্যায় ও মানবতাভিত্তিক এক নতুন সমাজ নির্মাণের স্বপ্ন।
এখন সময় এসেছে একটি নৈতিক বিপ্লবেরÑ যেখানে দলমত নির্বিশেষে সমস্ত গণতান্ত্রিক শক্তি একত্রিত হবে। লক্ষ্য হবে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, জবাবদিহিমূলক ও অংশগ্রহণভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলা।
এই প্রেক্ষাপটে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মতো আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত, নিরপেক্ষ ও নৈতিক নেতৃত্ব জাতিকে একটি বিশ্বাসযোগ্য দিকনির্দেশ দিতে পারেন। তিনি দলীয় রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে একটি জাতীয় মঞ্চ গঠনের মাধ্যমে দেশকে নেতৃত্ব দিতে সক্ষমÑ যেখানে বিভাজন নয়, ঐক্যই হবে মূল ভিত্তি।
বাংলাদেশের এই সংকটকালে সবচেয়ে জরুরি প্রয়োজনÑ একটি স্বাধীন বিচারব্যবস্থা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন ব্যবস্থা এবং সর্বোপরি, জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ। নাগরিক সমাজ, বিবেকবান মানুষ এবং রাজনৈতিক নেতৃত্বÑ সবার সম্মিলিত উদ্যোগেই সম্ভব এই পরিবর্তন।
নজরুলকে স্মরণ মানে কেবল তার কবিতা পাঠ নয় বরং তার চিন্তা ও চেতনায় বাংলাদেশ গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি নেওয়া। তার বিদ্রোহের স্পৃহা যেন আমাদের অন্তরে জাগেÑ একটি মানবিক, ন্যায়ভিত্তিক এবং দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশের স্বপ্নে।
এই অসমাপ্ত স্বপ্নের পথে আমাদের সংগ্রাম হোক নেতৃত্বে সততা ফিরিয়ে আনার, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের এবং একটি জবাবদিহিমূলক রাষ্ট্র নির্মাণের। এটাই হবে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের প্রতি পবিত্র দায়িত্ব।