সম্পাদকীয়
প্রকাশ : ২৮ মে ২০২৫ ১৬:২০ পিএম
লুটপাট ও অনিয়ম-জালিয়াতির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ছয়টি দুর্বল বেসরকারি ব্যাংককে একীভূত করে সরকারি নিয়ন্ত্রণে আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আগামী জুলাই মাসের মধ্যে এ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে বলে গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর। প্রাথমিকভাবে সরকারই এসব ব্যাংকের মালিকানা গ্রহণ করবে। পরবর্তী ধাপ এগোনোর জন্য একটি রোডম্যাপ তৈরির প্রস্তুতিও চলছে। পরে পর্যাপ্ত মূলধন জোগান দিয়ে ব্যাংকগুলোর ভিত্তি শক্ত করা হবে। ছয়টি ব্যাংক হলো– সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক ও ইউনিয়ন ব্যাংক। এর মধ্যে সোশ্যাল ইসলামী, গ্লোবাল ইসলামী ও আইসিবি ইসলামিক মিলে একটি এবং এক্সিম, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ও ইউনিয়ন ব্যাংক মিলে আরেকটি ব্যাংক করা হতে পারে।
উল্লেখ্য, ব্যাংক রেজল্যুশন অধ্যাদেশের আলোকে ইসলামী শরিয়াহভিত্তিক পরিচালিত এই ব্যাংকগুলোকে একীভূত করার লক্ষ্যে গত জানুয়ারি মাসে ব্যাংকের সম্পদের প্রকৃত অবস্থা যাচাই শুরু হয়, যা এখন প্রায় শেষ পর্যায়ে। চূড়ান্ত মূল্যায়ন প্রতিবেদনের ভিত্তিতে এখন ব্যাংকগুলো নিষ্পত্তির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। এর মধ্যে পাঁচটি ব্যাংকই এস আলমের নিয়ন্ত্রণে ছিল। বাকি ব্যাংকটি ছিল নজরুল ইসলাম মজুমদারের নিয়ন্ত্রণে। জানা গেছে, এ রকম ১৫টি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। দীর্ঘদিন কোনোমতে টিকে থাকা ব্যাংকগুলোকে আর সামনে না টেনে একটি সমাধানে আনতে চাচ্ছে। এ লক্ষ্যে ‘ব্যাংক রেজল্যুশন অধ্যাদেশ ২০২৫’ জারি করা হয়েছে।
২৬ মে প্রতিদিনের বাংলাদেশে ‘জুলাইয়ে একীভূত হচ্ছে ৬ ব্যাংক’Ñ শীর্ষক প্রতিবেদনে এ তথ্য পাওয়া গেছে। প্রতিবেদন বলছে, ব্যাংকগুলো দীর্ঘ সময় ধরে উচ্চমাত্রার খেলাপি ঋণ, অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি এবং সুশাসনের অভাবে জর্জরিত। বিগত রাজনৈতিক সরকারগুলোর সময় বারবার ঋণ পুনঃতফসিল, বড় অঙ্কের ঋণ বিতরণে অনিয়ম, পরিচালনা পর্ষদের অদক্ষতা এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থার নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে ব্যাংকিং খাতে তারল্য সংকট দেখা দেয়। অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, অন্তর্বর্তী সরকার যদি সময়মতো পুনর্গঠনের পদক্ষেপ না নিত, তাহলে পুরো ব্যাংকিং খাতে আরও আস্থার সংকট তৈরি হতে পারত। এ উদ্যোগ ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা ফেরানোর পাশাপাশি বিনিয়োগকারীদের আস্থা পুনঃস্থাপনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে তারা মনে করছেন।
যেকোনো দেশের অর্থনীতিতে ব্যাংকিং সেক্টর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আর বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে তার ভূমিকা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এ কথা সত্য যে, বাংলাদেশের অর্থনীতির যে আকার ও শক্তি, তার তুলনায় ব্যাংকের সংখ্যা বেশি। ব্যাংকগুলো প্রায় একই ধরনের সেবা নিয়ে গ্রাহকদের কাছে যাচ্ছে। ব্যাংকের সংখ্যা বেশি বা কম, তার চেয়েও বেশি তাত্পর্যপূর্ণ হচ্ছে ব্যাংকগুলো কেমন চলছে। তারা কি গ্রাহক সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারছে? পরিসংখ্যান বলছে, বিগত সময়ে ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনায় বাংলাদেশ ব্যাংক যেসব প্রবিধান প্রণয়ন করছে, তার অধিকাংশই বাস্তবায়ন বা অনুসরণ করতে পারেনি ব্যাংকগুলো। ফলে খেলাপি ঋণ বৃদ্ধিসহ ব্যাংকগুলো নানা জটিলতার মুখোমুখি অবস্থান করছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ব্যাংক একীভূতকরণ খুব একটা স্বাভাবিক বা সাধারণ ঘটনা বলা যাবে না। যদিও বহু দেশে এ ধরনের একীভূতকরণের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানগুলোকে অধিকতর শক্তিশালী করার উদাহরণ রয়েছে। তবে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট অনেকটা ভিন্ন। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে বেহাল অর্থনীতির মধ্যে নাজুক অবস্থায় পড়ে কয়েকটি ব্যাংক। তড়িঘড়ি করে সেগুলোকে তুলনামূলক ভালো ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। তখন সবচেয়ে দুর্দশাগ্রস্ত হিসেবে পদ্মা ও এক্সিম ব্যাংককে একীভূত করতে ব্যাংক দুটির পর্ষদে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। এ নিয়ে একটি এমওইউ চুক্তিও স্বাক্ষরিত হয়। ওই বছর বাংলাদেশ ব্যাংকের সবুজ সংকেতের পর ন্যাশনাল ব্যাংককে ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ন্যাশনাল ব্যাংকের আপত্তি থাকায় শেষ পর্যন্ত উদ্যোগটি বাতিল হয়ে যায়।
আমরা মনে করি, কোনো ব্যাংককে অন্য ব্যাংকের সঙ্গে পারস্পরিক আলোচনার ভিত্তিতে একীভূতকরণ করা উচিত। কেননা একীভূত হওয়ার সময় অন্যান্য প্রাসঙ্গিক বিষয়ের পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চাকরির বিষয়টি গুরুত্ব দিতে হবে। রয়েছে আমানতকারীদের প্রসঙ্গটিও। ২০০৯ সালে বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংক ও বাংলাদেশ শিল্প ঋণ সংস্থা একীভূতকরণ করা হয়। নামকরণ করা হয়েছে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড। তখন উভয় প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে সমঝোতামূলক মনোভাব নিয়ে কাজ করার ক্ষেত্রে ঘাটতি লক্ষ করা গেছে। শুধু তাই নয়, সব ক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ সুশাসন নিশ্চিত করা সম্ভব হয়েছে, এটাও বলা যায় না। তাই ভবিষ্যতে যেসব ব্যাংক একীভূত করা হবে, তারা যেন আগের তুলনায় ভালো চলতে পারে, অধিকতর শক্তিশালী ব্যাংক হিসেবে নিজেদের তুলে ধরতে পারে, তা নিশ্চিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
বাস্তবতা হচ্ছে, দেশের ব্যাংক খাতের বর্তমান পরিস্থিতির পেছনে যে কয়েকটি কারণ রয়েছে, তার মধ্যে সুশাসন, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, মাত্রাতিরিক্ত খেলাপি ঋণ ও তারল্য সংকট অন্যতম। অতীতে বহু ঋণখেলাপি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে জালিয়াতির মাধ্যমে ঋণ নিয়ে বিদেশে পাচার করে দিয়েছে, এটা এখন ওপেন সিক্রেট। অন্যদিকে ফেরত না আসা বিপুল পরিমাণ অর্থ খেলাপি হওয়ার কারণে প্রভিশন রাখাও ব্যাংকের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এতে ব্যাংকের আটকে যাচ্ছে প্রায় দ্বিগুণ অর্থ। এসব কারণে ব্যাংকগুলো ক্রমেই দুর্বল হয়ে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের গতিকে বাধাগ্রস্ত করছে। ব্যাংক হচ্ছে অর্থনীতির প্রাণ। এই প্রাণ দুর্বল হলে অর্থনীতিও দুর্বল হবে, এটাই স্বাভাবিক। আমরা চাই, বাংলাদেশ ব্যাংকের এই উদ্যোগ সফল হোক। ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা এবং গতিশীল অর্থনীতির জন্য শুধু ব্যাংক একীভূত করলেই হবে না, যাদের কারণে ব্যাংকগুলোর আজকের এই অবস্থা তাদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হোক। সবার আগে ব্যাংকগুলো পরিচালনায় সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। সুশাসন ফিরলেই ব্যাংকগুলোর শৃঙ্খলা নিশ্চিত হবে এবং আস্থা বাড়বে।