সম্পাদকীয়
প্রকাশ : ২৪ মে ২০২৫ ১৭:০২ পিএম
বেশ কয়েক দিন ধরেই রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলো আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। নানা দাবিতে রাস্তা অবরোধে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে; যা নগরবাসীর জন্য চরম ভোগান্তির কারণ। এর সঙ্গে কষ্ট বাড়াচ্ছে বৃষ্টি। প্রখর তাপদাহে বৃষ্টি প্রশান্তি দিলেও সৃষ্টি করে নগরজীবনের দুর্ভোগের আরেক অধ্যায়। বৃহস্পতিবার সকালে শুরু হয় একটানা বৃষ্টি। সপ্তাহের শেষ এই কর্মদিবসটিতে ঘণ্টাব্যাপী চলা বৃষ্টিতে ডুবে গেছে নগরীর বেশিরভাগ রাস্তাঘাট ও অলিগলি। কোন কোন স্থানে প্রধান সড়কে চলাচল করা ব্যক্তিগত গাড়ির ভেতরেও ঢুকে গেছে পানি। ইঞ্জিনে পানি ঢুকে বহু সিএনজি বন্ধ হয়ে গেছে রাস্তায়। বেশি ভোগান্তিতে পড়ে শিক্ষার্থী ও কর্মজীবীসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ। আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্যমতে, এদিন ঢাকায় ২২ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। খানিক বৃষ্টিতেই এমন জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হওয়ায় সামাজিক মাধ্যমে অনেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
অন্যদিকে এই দুর্ভোগকে আরও দীর্ঘায়িত করেছে বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র হিসেবে শপথ পড়ানো ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শাহরিয়ার আলম সাম্যের হত্যাকারীদের গ্রেপ্তারের দাবিতে রাজধানীর কাকরাইল এবং শাহবাগে আন্দোলন ও বিক্ষোভ। এসব কারণে যানজট ছড়িয়ে পড়ে রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ পল্টন, গুলিস্তান, কাকরাইল, মালিবাগ, রামপুরা, মহাখালী, মগবাজার, বাংলামোটর, কারওয়ান বাজার, মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ, সায়েন্স ল্যাব, নিউমার্কেট, ধানমন্ডিসহ ঢাকার বিভিন্ন এলাকায়। এতে এক ঘণ্টার পথ পাড়ি দিতে হয় দুই থেকে তিন ঘণ্টায়। ভুগতে হয়েছে গণপরিবহন না পাওয়ার সংকটও। সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছেন শহরের নিত্য আয়ের মানুষগুলো। ভোগান্তিতে পড়েছেন শিক্ষার্থী ও কর্মজীবীরা। সব মিলিয়ে দিনটি ঢাকাবাসীর জন্য হয়ে উঠেছিল ভোগান্তির শহরে। ২৩ মে প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এ ‘যানজট জলজটে নাকাল অবস্থা’ শীর্ষক প্রতিবেদনেও উঠে এসেছে রাজধানীবাসীর ভোগান্তির এসব চিত্র।
ঢাকা শুধু দেশের অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক কেন্দ্রই নয়, এটি বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ শহরও। এ শহরের সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী ও ভোগান্তিকর সমস্যাগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো যানজট। যা প্রতিদিন লাখ লাখ মানুষের জীবনকে প্রভাবিত করে। দুই কোটির বেশি জনসংখ্যার এ শহরের সড়ক অবকাঠামো মোটেও এত বিপুল যানবাহনের জন্য পর্যাপ্ত নয়; যার ফলে যানজট এখন চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। রয়েছে অপরিকল্পিত নগরায়ণ, বিশৃঙ্খল গণপরিবহন ব্যবস্থা, দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থা, রাজনৈতিক কর্মসূচি এবং যানবাহনের ক্রমাগত বৃদ্ধি। আর রাজধানীর জলজট ও জলাবদ্ধতার জন্য দায়ী মূলত সমন্বিত পরিকল্পনার অভাব। টানা বৃষ্টির ফলে সৃষ্ট জলাবদ্ধতায় রাজধানীর ট্রাফিক ব্যবস্থাই শুধু ভেঙে পড়ে না, রাস্তায় আটকে পড়ে শ্রমজীবী ও শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। প্রতি বছরই বর্ষাকাল নগরবাসীর জন্য দুর্ভোগের কারণ, কিন্তু এ থেকে মুক্তি মিলছে না আজও।
আসলে নগরায়ণের শুরু থেকেই ঢাকার পানি নিষ্কাশনের কথা বিবেচনা করা হয়নি। নানা সময়ে কৃত্রিম পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা গড়ে তোলা হলেও কার্যত খুব বেশি সুফল মিলছে না। সামান্য বৃষ্টিতেই নগরবাসীকে নানা রকম দুর্ভোগ ও ধকল সামলাতে হচ্ছে। রাজধানীর এই জলাবদ্ধতার প্রধান কারণগুলোর মধ্যে প্রথমদিকে রয়েছে, অপরিকল্পিত ড্রেনেজ সিস্টেম, অপরিকল্পিতভাবে বাড়িঘর নির্মাণ, পানিপ্রবাহের ছোট-বড় নালায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি, বিভিন্ন স্থানে নালা সরু করে ফেলা এবং সঠিকভাবে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন না করা, খাল দখল ও ভরাট প্রভৃতি। জানা গেছে, বিগত সময়ে রাজধানীর ২৬টি খাল, তিন হাজার কিলোমিটার ড্রেন ও জলাশয় ওয়াসার কাছ থেকে সিটি করপোরেশনের হাতে ন্যস্ত করা হলেও সেগুলো তদারকির অভাবে ক্রমশ আবর্জনায় ভরাট হচ্ছে। মাঝেমধ্যে লোক দেখানো অভিযান চললেও দিন শেষে যেই লাউ সেই কদু। বর্তমান সরকারও প্রথম দিকে দখলকৃত খাল-ডোবা উদ্ধারে হাঁকডাক দিলেও সেটাও মাঝপথে থেমে যায়। ফলে দখল ও ভরাট ঠেকানো যাচ্ছে না, সৃষ্টি হচ্ছে জলাবদ্ধতা।
বর্তমানে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন চলছে প্রশাসকনির্ভর। তাদের সঙ্গে নেই বিভিন্ন ওয়ার্ডের শতাধিক কাউন্সিলরও। ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের পর কেউ গ্রেফতার হয়েছেন, কেউ বা পলাতক। বলা চলে নির্বাচিত অভিভাবকহীন রাজধানীর নাগরিকরা। ফলে বেশিরভাগ ওয়ার্ডেই উন্নয়ন কাজ থমকে আছে। যেগুলো চলছে তারও যথাযথ দেখভালের কেউ নেই। তাই যানজট ও জলজটের মতো নাগরিক এই বিড়ম্বনা সামাল দেওয়া অনেকটা দুরূহ হয়ে পড়েছে। দেখা গেছে, সড়কের যেসব স্থানে সংস্কার দরকার, সেখানে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়, সেসব স্থান দিয়ে যানবাহন চলাচল না করায় অন্যান্য সড়কের ওপর চাপ বাড়ে। ফলে সৃষ্টি হয় দীর্ঘ যানজটের। এসব কারণে ঢাকা শহরের নাগরিকরা এক ধরনের হুমকির মুখে। যানজট ও জলজট নিরসন ছাড়া আমাদের এই প্রিয় শহরে বাসযোগ্যতায় উন্নতি করা যাবে না। আমরা আশা করি, দুই সিটিতে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রশাসকসহ সংশ্লিষ্টরা সমন্বিতভাবে বৃষ্টি-পরবর্তী ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা ও নগর পরিকল্পনায় কিছুটা পরিবর্তন এনে এ সমস্যার দ্রুত সমাধানে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করবেন। রাজধানীবাসী জরুরিভিত্তিতে যানজট ও জলজটের স্থায়ী সমাধান চায়।