× ই-পেপার প্রচ্ছদ সর্বশেষ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি শিক্ষা ধর্ম ফিচার ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

নজরুল জয়ন্তী

দ্রোহে প্রেম, প্রেমে দ্রোহ : নজরুলের দার্শনিক জগৎ

মুন্সী আবু বকর

প্রকাশ : ২৪ মে ২০২৫ ১৭:০১ পিএম

দ্রোহে প্রেম, প্রেমে দ্রোহ : নজরুলের দার্শনিক জগৎ

বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে বাংলা সাহিত্যাকাশে এক ধূমকেতুর মতো আবির্ভাব ঘটেছিল কাজী নজরুল ইসলামের। তিনি কেবল একজন কবি, সংগীতজ্ঞ বা সাহিত্যিক ছিলেন না, বরং ছিলেন এক বিপ্লবী দার্শনিক। তার কবিতার প্রতিটি পঙ্‌ক্তিতে, গানের প্রতিটি সুরে এবং প্রবন্ধের প্রতিটি ছত্রে এক গভীর জীবনদর্শন অনুরণিত হয়েছে। এই দর্শন একদিকে যেমন ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে তীব্র, অগ্নিক্ষরা দ্রোহের প্রকাশ ঘটায়, তেমনই অন্যদিকে মানবপ্রেম, সাম্যবাদ ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার এক অনুপম বার্তা বহন করে। নজরুলের দার্শনিক জগৎ তাই ‘দ্রোহে প্রেম, প্রেমে দ্রোহ’Ñ এই আপাতবিরোধী অথচ অবিচ্ছেদ্য ভাবনার এক অসাধারণ মেলবন্ধন।

নজরুলের কবিতার প্রধানতম বৈশিষ্ট্য হলো তার বলিষ্ঠ দ্রোহ। পরাধীনতার নাগপাশ থেকে মুক্তিলাভের অদম্য আকাঙ্ক্ষা, সমাজের সর্বস্তরের অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদ তার কবিতাকে এক স্বতন্ত্র তেজস্বিতা দান করেছে। তার কালজয়ী কবিতা ‘বিদ্রোহী’ এই দ্রোহী চেতনার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। কবিতাটির প্রতিটি পঙ্‌ক্তিতে কবির আত্মবিশ্বাস, ঔদ্ধত্য এবং শোষণের বিরুদ্ধে ঘৃণা মূর্ত হয়ে উঠেছে :

আমি সেই দিন হব শান্ত, 

যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন রোল 

আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না– অত্যাচারীর খড়্গ কৃপাণ 

ভীম রণভূমে রণিবে না 

বিদ্রোহী রণক্লান্ত

আমি সেই দিন হব শান্ত।

এখানে কবি নিজেকে এক সর্বব্যাপী বিদ্রোহী সত্তা হিসেবে উপস্থাপন করেছেন, যিনি ততক্ষণ পর্যন্ত শান্ত হবেন না যতক্ষণ না পৃথিবী থেকে নিপীড়ন ও অত্যাচার সম্পূর্ণরূপে দূরীভূত হয়। এই দ্রোহ কেবল ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে একটি রাজনৈতিক অবস্থান নয়, বরং এটি সমাজের সকল প্রকার অসাম্য ও শোষণের বিরুদ্ধে এক সর্বজনীন প্রতিবাদ। নজরুলের এই দ্রোহের মূলে ছিল পরাধীন জাতির অপমান, দরিদ্র মানুষের হাহাকার এবং সমাজের কুসংস্কারাচ্ছন্ন অচলায়তনের বিরুদ্ধে এক তীব্র ঘৃণা।

তবে নজরুলের দর্শন ও চিন্তার জগৎ কেবল ধ্বংসাত্মক বিদ্রোহের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। তার দ্রোহের গভীরে প্রোথিত ছিল এক গভীর ও অকৃত্রিম মানবপ্রেম। তিনি সমাজের সকল স্তরের মানুষের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন এবং তাদের মুক্তির স্বপ্ন দেখতেন। ‘মানুষ’ কবিতায় তিনি ধর্মের ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে মানুষের জয়গান গেয়েছেন :

গাহি সাম্যের গান–

মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান,

নাই দেশকাল পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্ম জাতি,

সব দেশে, সব কালে, ঘরে-ঘরে মানুষের জ্ঞাতি।

এই কবিতায় কবি স্পষ্ট ঘোষণা করেছেন যে তার কাছে সকল মানুষ সমান এবং তিনি সেই দিনের গান গাইবেন যেদিন নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলে ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ হবে। নজরুলের এই সাম্যবাদী দর্শন তার সমগ্র সাহিত্যকর্মে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছে। তিনি ধর্ম, বর্ণ, জাতি বা লিঙ্গ পরিচয়ের ঊর্ধ্বে উঠে সকল মানুষকে সমান মর্যাদা দিয়েছেন এবং তাদের মধ্যে ঐক্য ও ভালোবাসার সেতুবন্ধনের নিরন্তর প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। তার কাছে প্রেম কেবল ব্যক্তিগত আবেগ বা অনুরাগ নয়, বরং এটি সামাজিক বৈষম্য দূরীকরণের এবং মানবতাকে এক সূত্রে গ্রোথিত করার এক শক্তিশালী মাধ্যম।

নজরুলের দার্শনিক জগতে প্রেম এবং দ্রোহ তাই একে অপরের পরিপূরক। তার দ্রোহের জন্ম যেমন সমাজের অন্যায় ও অবিচার থেকে, তেমনই সেই দ্রোহকে সঞ্জীবিত করে মানুষের প্রতি গভীর ভালোবাসা ও মমত্ববোধ। তিনি ভেঙে ফেলতে চেয়েছেন সেই পুরোনো, জীর্ণ সমাজব্যবস্থাকে, যেখানে মানুষে মানুষে বিভেদ তৈরি করা হয়। আর সেই ধ্বংসস্তূপের ওপর তিনি নির্মাণ করতে চেয়েছেন এক নতুন, সাম্যবাদী সমাজ, যেখানে প্রেম, ভ্রাতৃত্ব ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে।

‘কামাল পাশা’ কবিতায় তুরস্কের জাতীয় বীর মোস্তফা কামাল আতাতুর্কের বিপ্লবী আদর্শের প্রতি নজরুলের অকুণ্ঠ সমর্থন তার দ্রোহী চেতনারই অন্য একটি দিক উন্মোচন করে। পরাধীন জাতির মুক্তি সংগ্রামে কামাল পাশার বীরত্ব ও নেতৃত্ব নজরুলকে গভীরভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল। আবার ‘পূজারিণী’ কবিতায় ধর্মের নামে ভণ্ডামি ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে তার তীব্র সমালোচনা সেই একই বিপ্লবী মানসিকতার পরিচায়ক। অন্যদিকে তার অসংখ্য গান ও কবিতায় রাধা-কৃষ্ণের প্রেমলীলা, নর-নারীর চিরন্তন আকর্ষণ এবং প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যের বন্দনা প্রেমের এক ভিন্ন ও গভীরতর দিক উন্মোচন করে। এই প্রেম কেবল ব্যক্তিগত অনুভূতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং তা বিশ্বজনীন ভালোবাসার এক প্রতীক হয়ে উঠেছে।

নজরুলের দার্শনিক জগৎ কোনো সরল বা একরৈখিক ধারণা নয়। এখানে দ্রোহ যেমন বিদ্যমান, তেমনই প্রবহমান প্রেম; ঘৃণার বিপরীতে সহানুভূতির স্রোত; ধ্বংসের কামনার পাশাপাশি নতুন সৃষ্টির স্বপ্ন। এই আপাতবিরোধী ভাবনার সহাবস্থানই নজরুলকে এক অনন্য দার্শনিক উচ্চতায় অধিষ্ঠিত করে। তিনি একদিকে যেমন ঔপনিবেশিক শক্তির ভিত কাঁপিয়ে দিতে চেয়েছেন, তেমনই অন্যদিকে মানুষের হৃদয়ে ভালোবাসার বীজ বপন করতে চেয়েছেন। তার কাছে বিপ্লব কেবল অস্ত্রের ঝনঝনানি বা রক্তপাতের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং তা মানুষের অন্তরের গভীর প্রেম ও মমত্ববোধ থেকে উৎসারিত হয়।

নজরুল-সাহিত্যে উপরোক্ত দার্শনিক ভাবনা আজও বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমান বিশ্বে যখন জাতিগত বিভেদ, ধর্মীয় হানাহানি এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য প্রকট আকার ধারণ করেছে, তখন নজরুলের দ্রোহী অথচ প্রেমপূর্ণ বার্তা আমাদের নতুন করে ভাবতে শেখায়। তিনি আমাদের শিখিয়েছেন কীভাবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে নির্ভয়ে রুখে দাঁড়াতে হয়, আবার একই সঙ্গে কীভাবে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের প্রতি ভালোবাসা ও সহানুভূতির হাত প্রসারিত করতে হয়। তার ‘দ্রোহে প্রেম, প্রেমে দ্রোহ’– এই দার্শনিক দ্বৈততা আমাদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে ভারসাম্য বজায় রাখতে এবং একটি ন্যায়ভিত্তিক, সহানুভূতিশীল সমাজ গঠনে আজও প্রেরণা জোগাতে পারে। নজরুল কেবল একজন বিস্মৃত কবি নন, তিনি একালের পথপ্রদর্শক, যার দার্শনিক আলোকবর্তিকা আজও আমাদের সঠিক পথের সন্ধান দেয়। তার কবিতা ও গান আমাদের মনে দ্রোহের আগুন জ্বালায়, আবার একই সঙ্গে ভালোবাসার অমৃতবারি সিঞ্চন করে। এই দ্বৈততাই নজরুলকে কালজয়ী করে রেখেছে।

  • অধ্যাপক (অব.) দর্শন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : মোরছালীন বাবলা

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা