সম্পাদকীয়
প্রকাশ : ২১ মে ২০২৫ ১৫:৫৬ পিএম
বিগত সময়ে লুটপাটের মাধ্যমে যারা অর্থ আত্মসাৎ করেছেন, তাদের জব্দ করা টাকা ও শেয়ার দিয়ে একটি ‘তহবিল’ গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। লুটপাটের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যাংকগুলো এ তহবিল থেকে তাদের লুন্ঠিত টাকা ফেরত পাবে। এতে আমানতকারীদের টাকা ফেরত দিতে পারবে ব্যাংকগুলো। ব্যাংকঋণের বাইরে অবৈধ উপায়ে অর্জিত অর্থ দরিদ্র জনগণের কল্যাণে ব্যয় করা হবে। সোমবার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে এক সংবাদ সম্মেলনে সরকারের এই সিদ্ধান্তের কথা জানান বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর। এর আগে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় দেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার অগ্রগতি পর্যালোচনা বিষয়ক বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত হয়। জানা গেছে, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর এখন পর্যন্ত ১ লাখ ৩০ হাজার ৭৫৮ কোটি টাকার সম্পত্তির মূল্য জব্দ করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর জানিয়েছেন জব্দকৃত অর্থ ব্যবহারের ক্ষেত্রে পুরো প্রক্রিয়াটি আইনি কাঠামোর মধ্যেই সম্পন্ন হবে। তিনি আরও বলেছেন, আদালতের সিদ্ধান্ত ও প্রয়োজনে আইন সংশোধনের মাধ্যমে ফান্ড গঠন করা হবে। ব্যাংক ক্ষতিপূরণ এবং জনহিতকর কাজে ব্যবহারের জন্য দুই ধরনের ফান্ড গঠনের পরিকল্পনা রয়েছে। উল্লেখ্য, দেশের বড় ১০টি ব্যবসায়ী গ্রুপ ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পরিবারের বিরুদ্ধে ওঠা অর্থ পাচারের অভিযোগ তদন্ত করছে আন্তঃসংস্থা টাস্কফোর্সের আওতাধীন ১১টি টিম। এই দলে রয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), নেতৃত্ব দিচ্ছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সমন্বয়ের দায়িত্বে রয়েছে বিএফআইইউ। এ-সংক্রান্ত হালনাগাদ তথ্য বৈঠকে তুলে ধরা হয়।
২০ মে প্রতিদিনের বাংলাদেশে ‘এক লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা জব্দ করেছে সরকার’ শীর্ষক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এ তথ্য। প্রতিবেদনে আরও জানা যায়, সরকার লুটের টাকা বা জব্দ অর্থ বাজেটে ব্যবহার নয় বরং দরিদ্র জনগোষ্ঠীর উপকারে ব্যবহার করবে। গভর্নর বলেছেন, যারা লুটপাটের মাধ্যমে অর্থ আত্মসাৎ করেছেন, তাদের সংযুক্ত ও অবরুদ্ধ করা টাকা এবং শেয়ার ব্যবস্থাপনায় একটি আলাদা তহবিল গঠন করছে সরকার। বর্তমান সরকারই প্রথমবারের মতো এ ধরনের একটি তহবিল গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। জব্দ করা অর্থ ও সম্পদ এরই মধ্যে সরকারের নিয়ন্ত্রণে এসেছে। তিনি বলেছেন, দ্রুত সময়ের মধ্যেই এ তহবিলের কার্যক্রম শুরু করা সম্ভব হবে। জানা গেছে, মাঝারি আকারের আরও ১২৫টি অনিয়ম তদন্তের আওতায় রয়েছে। আমরা মনে করি, সরকারের এই সিদ্ধান্ত অত্যন্ত সময়োপযোগী এবং আগামীর বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে দৃষ্টান্ত হিসেবে কাজ করবে।
উল্লেখ করা প্রয়োজন, বাংলাদেশে অর্থনীতি ভেঙে পড়ার অন্যতম কারণ অতীতে সর্বস্তরে দুর্নীতি, লুটপাট ও অর্থ পাচার। এক্ষেত্রে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দুর্নীতি ও অপরাধ প্রতিরোধে যে উদ্যোগ নিয়েছে তা প্রশংসনীয়। তবে এ কথা ভুললে চলবে না, বিগত সরকারগুলোর সময়েও নানা অনিয়ম, প্রতারণা ও দুর্নীতির কারণে অর্থ জব্দের কথা শোনা গিয়েছিল। অবাক ব্যাপার যে, জব্দ হওয়া অর্থের প্রকৃত চিত্র পরে আর দৃশ্যমান থাকেনি। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বিগত সময়ে অর্থ আত্মসাৎ ও দুর্নীতির মামলায় অভিযুক্ত পিকে হালদার নামক এক ব্যক্তির মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের ৯৬০ কোটি টাকা জব্দ করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানসহ কয়েকটি অপরাধের বিরুদ্ধে বিপুল পরিমাণ অর্থ জব্দের কথা শোনা গিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত জব্দ টাকার গন্তব্য কোথায় তা অজ্ঞাত রয়ে যায়। সাধারণভাবে বলা যায়, কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে নগদ অর্থ কিংবা ব্যাংকে থাকা অর্থ বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কিংবা দুর্নীতি দমন কমিশন জব্দ করতে পারে। সেক্ষেত্রে অর্থ জব্দের পর যখন মামলা হয়, তখন দুদক, ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট কিংবা অন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে এই অর্থের তথ্য আদালতে উপস্থাপন করতে হয়। নগদ অর্থ জব্দ করার ক্ষেত্রে আদালত নির্ধারণ করেন যে ওই অর্থ কোথায় এবং কার জিম্মায় রাখা হবে।
তার মানে একটি আইনি প্রক্রিয়া রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গর্ভনরও বিষয়টি উল্লেখ করেছেন, এর অর্থ দাঁড়ায় যতদিন পর্যন্ত মামলার সুরাহা না হচ্ছে, ততদিন পর্যন্ত ওই জব্দকৃত অর্থ সেই অবস্থায়ই থাকবে। জব্দ করা বা বিক্রি করা টাকা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা হলেও রাষ্ট্র সেই অর্থ খরচ করতে পারে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না আদালত এ ব্যাপারে নির্দেশ দেন। এক্ষেত্রে আইন সংশোধনের বিষয়টিই প্রাধান্য পায়। তাই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের আগে আইনি বিষয়টি বিবেচনার দাবি রাখে। এখানে উল্লেখ্য, বিগত ওয়ান-ইলেভেনের সময় প্রচুর পরিমাণ অবৈধ অর্থ জব্দ করা হয়েছিল। ওই অর্থের যথাযথ ব্যবহার নিয়েও নানা সময়ে প্রশ্ন উঠেছে। আমরা মনে করি, জব্দ হওয়া অর্থ ব্যবহারের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা থাকা দরকার। পাশাপাশি দুদকসহ সরকারের অন্যান্য সংস্থাকে অবৈধ অর্থ-উদ্ধারের ব্যাপারে আরও সক্রিয় ও দায়িত্বশীল হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি। আমরা চাই, জব্দ টাকায় ভাগ্য ফিরুক দরিদ্র মানুষের। সরকারের কার্যকর পদক্ষেপই এক্ষেত্রে প্রত্যাশিত।