জীবন-জীবিকা
সিরাজুল ইসলাম
প্রকাশ : ২১ মে ২০২৫ ১৫:৫০ পিএম
সিরাজুল ইসলাম
নগরে উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত বা নিম্নমধ্যবিত্ত- নারীর যে অবস্থাই বলি না কেন, কেউ সন্তোষজনক অবস্থায় নেই। প্রতিটি নারী তার প্রাত্যহিক জীবনে প্রতিনিয়ত কোনো না কোনোভাব সংগ্রাম করে যাচ্ছেন। এই সংগ্রাম উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত বা সহায়-সম্বলহীন নারীর ক্ষেত্রে প্রায় একই রকম হলেও শ্রেণিভেদে এদের চিত্র অনেকটা ভিন্ন ভিন্ন হয়। নারীর সর্বজনীন বিভিন্ন সমস্যার সঙ্গে নিম্নবিত্ত পরিবারের নারীদেরকে জীবন ও জীবিকার জন্য আরও অনেক বেশি চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে হয়।
নগরের বা শহুরে নিম্নবিত্তের মানুষ বলতে আমরা সাধারণত বুঝে থাকি, যারা অপ্রতুল সম্পদবিশিষ্ট ও অসচ্ছল এবং যারা পরিবারসহ ভাত, কাপড় চিকিৎসা, আশ্রয়ের সংকটে পড়ে তাদের নিজেদের গ্রাম বা জেলা থেকে মাইগ্রেটেড বা অভিবাসী হয়ে জীবন ও জীবিকার তাগিদে কাজের আশায় শহরমুখী হয়। নিজ এলাকার বিভিন্ন প্রতিকূল পরিস্থিতি থেকে রক্ষা পেতে এবং সুন্দর ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে মানুষ অভিবাসনের পথ বেছে নেয়। শহরমুখী এসব পরিবারের নারীরাই নগরের নিম্নবিত্তের অভিবাসী হিসেবে আমাদের কাছে পরিচিত। শহরেও এসব নারীদের জীবন খুব একটা সুখের হয় না। শুধু পেট ভরে খাবার খাওয়ার জন্য আর মাথা গোঁজার একটু আশ্রয়ের জন্য এদেরকে যে ধরনের কাজকে বেছে নিতে হয় তা সম্মানজনক তো নয়ই বরং খুবই পরিশ্রমের আর প্রতি মুহূর্তে থাকে নিরাপত্তাহীনতার আশঙ্কা। এই জাতীয় বেশিরভাগ নারীই গার্মেন্টস ও বাসাবাড়িতে গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করে থাকে। আবার কেউ কেউ নির্মাণ শ্রমিক, ইট ভাঙ, পিঠা বানানো ও বিক্রি করা, ছোট্ট চায়ের দোকানে বা ফ্লাস্কে চা বিক্রি করা, সেলাইয়ের কাজ করা, রাস্তার আশপাশে ভাসমান দোকানে অল্পবিস্তর ফল বা ডাব বিক্রি করা এমনকি কেউ কেউ রিকশা চালিয়েও তাদের জীবন ও জীবিকার যুদ্ধে অংশ নিয়ে থাকে। এতদসত্ত্বেও তাদের জীবনে সুখ নামক অনুভূতিটাকে তারা অর্জন করতে পারে না আর উপভোগ করতে পারার তো প্রশ্নই ওঠে না। এদের কেউ শারীরিক, কেউ আবার নানাভাবে মানসিক নির্যাতন, অপমান ও নিরাপত্তাহীনতার শিকার হয়ে দিন কাটায়। আর স্বামীর ঘরে তো একটা কমন সমস্যা এদের সবার তা হলো- যৌতুক সমস্যা ও শারীরিক নির্যাতন।
বাংলাদেশের নিম্নবিত্ত নারীদের জীবনসংগ্রাম একদিকে যেমন গভীর কষ্টের আবার সব নারীর জন্য প্রেরণাদায়ক অধ্যায়ও বটে। এটি শুধু একটি নির্দিষ্ট স্থান, সময় বা শ্রেণির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; বরং প্রতিটি স্থান, কাল, পাত্রবিশেষে তাদের সংস্কৃতি অনুসারে নারীরা বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করছে এবং শক্তি ও দৃঢ়তার সঙ্গে উদাহরণও স্থাপন করেছে। কিন্তু তাদের সংগ্রাম, আশা এবং নিরাশার কাহিনী প্রতিটি স্থানে একে অপরের থেকে ভিন্ন। কিন্তু এই ভিন্নতাগুলোর মধ্যেও এক গভীর সাদৃশ্য থাকে যেখানে প্রতিটি নারীই তার অধিকার, মর্যাদা এবং স্বাধীনতার জন্য লড়াই করে। শহুরে বা নগরের নিম্নবিত্তের নারীরাও এসবের ব্যতিক্রম নয়।
শহরের নারীদের জীবন তুলনামূলকভাবে স্বাধীনতা এবং সুযোগে পূর্ণ বলেই নিম্নবিত্তের নারীরা এখানে ছুটে আসে তাদের মনের লালিত পালিত স্বপ্নের সুখপাখিটাকে ধরতে। কিন্তু এখানে এসেই তাদেরকে কঠিন সংগ্রামের মুখোমুখি হতে হয় এবং এই নগর-জীবনের চ্যালেঞ্জগুলোকে মোকাবিলা করতে করতে সেই স্বপ্ন ভঙ্গ হলেও জীবন চালিয়ে নেয় জীবনেরই তাগিদে। যদিও শহর অনেক ক্ষেত্রেই তাদের জন্য অধিক সুযোগ তৈরি করেছে, তবে শহুরে সমাজে এদের প্রতি বৈষম্য, ধর্ষণ, সহিংসতা, শোষণ ও নির্যাতন একটি বড় সমস্যা। আর এই চ্যালেঞ্জগুলো শহুরে নিম্নবিত্তের নারীদের জীবনকে করে তোলে আরও জটিল। শহরে এসে প্রথমেই তাদেরকে পড়তে হয় আবাসন সংকটে। তাদের বসবাসের জন্য বেছে নিতে হয় নগরের বিভিন্ন বস্তি এলাকা যেগুলোর বেশিরভাগই অস্বাস্থ্যকর ও অনিরাপদ। স্যানিটারি ব্যবস্থা, পান করার পানি কোনোটাই এসব জায়গায় স্বাস্থ্যকর নয় এবং নারীদের এখানে বাস করার জন্য যথেষ্ট নিরাপদ পরিবেশও নেই।
ডিভোর্স, বহুবিবাহ, বাল্যবিবাহ, যৌতুক, নিপীড়ন, গলা ফাটানো ঝগড়া সবই হয় এসব নিম্নবিত্ত পরিবারে। এ শ্রেণির পরিবারের নারীরা কঠিন পরিশ্রম করেও ভোগ করতে পারে না তাদের উপার্জিত আয়। অধিকাশ ক্ষেত্রেই তাদের স্বামী বা শাশুড়ি হস্তগত করে নেয় কষ্ট করে উপার্জন করা তাদের সব অর্জিত অর্থ এবং প্রতিবাদ তো দূরের কথা; বরং একটু ব্যতিক্রম হলেই তাদের ওপর চলে অমানবিক শারীরিক নির্যাতন। ঘরে বাইরে কোথাও কি নারী তার ন্যায্যতা পায়? যেখানে সব শ্রমিক এখনও আন্তর্জাতিক শ্রম আইনের নিরিখে তাদের ন্যায্যমূল্য পায় না; সেখানে নারী শ্রমিকের অবস্থা তো আরও করুণ এবং অসহনীয় দুর্ভোগের। একে তো শারীরিকভাবে পিছিয়ে পড়া নারীর জন্য ইট মাথায় নেওয়া, ভাঙা, মাটি কাটা ও ঝাঁকা মাথায় মাটি এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিতে পুরুষ সহকর্মীর তুলনায় কিছুটা কষ্টকর। আবার শ্রমঘণ্টায় নারী পুরুষের কোনো পার্থক্যও নেই এবং কাজের ধরনও প্রায়ই অভিন্ন।
হাড়ভাঙা শ্রমের বিনিময়ে যখন প্রাপ্য মজুরির জন্য হাত পাততে হয় সেখানেও জোটে লাঞ্ছনা, গঞ্জনা এবং কঠোর রোষানল; নারী হিসেবে পায় না আলাদা কোনো মর্যাদা। তার ওপর আছে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ। স্যানিটেশনের ব্যাপারে নেই কোনো সুচিন্তিত পদক্ষেপ। তার ওপর নির্মাণ শ্রমিকদের কাজ করতে হয় খোলা আকাশের নিচে, রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে তাদের জীবনপ্রবাহ চলে এক অনাকাঙ্ক্ষিত প্রেষণে। তার ওপর শারীরিকভাবে মাসের কয়েক দিন কাটে অস্বস্তিকর অবস্থায়, আবার গর্ভবর্তী অবস্থায়ও কাজ করে যেতে হয়। কিন্তু এতসব ঝামেলা পোহানোর পরও মজুরি নিতে এসে বঞ্চনায় নিপীড়িত হয়, এমন অসম বিভাজনের শেষ পরিণতি কোথায়। সমাধান আছে কি না ভাবা দরকার।
এবার আসি পোশাক রপ্তানি শিল্পে নারী শ্রমিকের অবদান প্রসঙ্গে। বিজিএমইএর তথ্য অনুযায়ী (বায়োমেট্রিক্স ডাটাবেজড অনুসারে) বাংলাদেশে তৈরি পোশাক কারখানায় ৩৩ লাখ ১৭ হাজার ৩৯৭ জন শ্রমিক রয়েছেন। এর মধ্যে নারী শ্রমিক রয়েছেন ১৭ লাখ ৩৪ হাজার ৪৫৯ জন, যা মোট শ্রমিকের ৫২ দশমিক ২৮ শতাংশ। আবার বিকেএমইএর তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে নিট সেক্টরে বর্তমানে মোট ১৭ লাখ ২৫৫ জন শ্রমিক রয়েছেন। এর মধ্যে নারী শ্রমিক রয়েছেন ১০ লাখ ৫৪ হাজার ১৫৭ জন, যা মোট শ্রমিকের ৬২ শতাংশ। অর্থাৎ দেশে তৈরি পোশাক খাতে মোট ৫০ লাখ ১৭ হাজার ৬৫২ জন শ্রমিক রয়েছেন। এর মধ্যে নারী শ্রমিক ২৭ লাখ ৮৮ হাজার ৬১৬ জন (ইপিজেড ব্যতীত), যা মোট শ্রমিকের ৫৫ দশমিক ৫৭ শতাংশ। আর বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮০ শতাংশ আসে তৈরি পোশাক খাত থেকে। তাহলে দেশের অর্থনৈতিক খাতে নগরের নিম্নবিত্তের নারীদের এই বিরাট অবদানের আমরা কী মূল্য দিতে পারছি? না পারছি তাদের শ্রমের সঠিক মূল্য দিতে, না পারছি কর্মক্ষেত্রে তাদেরকে মর্যাদাপূর্ণ ও নিরাপদ কাজের পরিবেশ নিশ্চিত করতে। শুধু গার্মেন্টস কর্মীই নয়, এই চিত্র নগরের সব নিম্নবিত্ত নারীর কর্মক্ষেত্রে বিরাজমান।
শহরের নিম্নবিত্তের নারীরা তাদের জীবন ও জীবিকার তাগিদে পুরুষশাসিত সমাজ কর্তৃক এবং রাষ্ট্রের অবহেলায় যেসব চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে, যেমনÑ কর্মক্ষেত্রে হয়রানি, নিরাপত্তাহীনতা, মজুরি বৈষম্য, যৌন হয়রানি, পারিবারিক নির্যাতন ইত্যাদি সমস্যাগুলোর সমাধানে আমাদের তথা রাষ্ট্রের যথাযথ ও কার্যকরী ভূমিকা নিতে হবে। নগরের নিম্নবিত্তের নারীর সব কর্মে ও জীবনবোধে বৈষম্য প্রতিরোধে কতিপয় পন্থা অবলম্বন করতে হবেÑ দেশের আইন ও স্বীকৃত আন্তর্জাতিক সনদসমূহ অনুসরণ করে কর্মক্ষেত্রে নারীর সমান অংশীদারত্ব, সমান সুযোগ, সমমর্যাদা, সমআচরণ, নিরাপদ, স্বাস্থ্যসম্মত এবং নারীবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে এবং জাতীয় অর্থনীতিতে নারীর অবদানের প্রেক্ষিতে প্রতিটি ক্ষেত্রে এদের প্রতি যেকোনো ধরনের বৈষম্যের অবসান ঘটাতে হবে।