সম্পাদকীয়
প্রকাশ : ১৬ মে ২০২৫ ২০:০৮ পিএম
রাজধানী ঢাকা যেন আন্দোলনের শহর। এমন কোনো দিন নেই যেখানে দাবি আদায়ের কোন কর্মসূচি নেই। ফলে প্রতিদিনই যানজটের কবলে পড়ছে সাধারণ মানুষ। তীব্র যানজটে নাকাল অফিসগামীসহ বিভিন্ন কাজে বের হওয়া মানুষজন। ছুটির দিনগুলোতেও মুক্তি নেই এই দুর্যোগ থেকে। সাম্প্রতিক সময়ে শিক্ষার্থী, পেশাজীবী ও বিভিন্ন সংগঠনের ব্যানারে নিজ নিজ দাবিদাওয়া জানানোর প্রবণতা বাড়ছে। বিশেষ করে ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে বিগত সরকারের পতনের পর থেকে ছাত্র, শ্রমিক, চাকরিপ্রার্থীসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষকে তাদের বঞ্চনার প্রতিকারে শাহবাগ, প্রেস ক্লাব, সচিবালয়, প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনের সামনের সড়কসহ রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ সড়ক অবরোধ করে আসছে। ফলে যানজটে নগরবাসীর জীবনে দুর্বিষহ নিয়তি। গত বুধবারও রাজধানীর শাহবাগ, মৎস্য ভবন, কাকরাইল, কারওয়ান বাজার, ফার্মগেট, মালিবাগ,পল্টন, কাঁটাবন, সায়েন্সল্যাব মোড়সহ পুরো শহরে হেঁটে কিংবা খণ্ড খণ্ডভাবে রিকশায় চেপে যাতায়াত করতে হয়েছে মানুষকে। এমনিতেই যানজটের কারণে ঢাকা বিশ্বের সবচেয়ে ধীরগতির শহর। সড়কে ছোট-বড়, ধীর-দ্রুতগতি মিলিয়ে ১৮ সংস্করণের যান চলাচল করায় ন্যূনতম শৃঙ্খলা রাখাটা অত্যন্ত কঠিন। এ পরিস্থিতি আরও নাজুক ও ভয়াবহ হয়, যদি চলাচলের সড়ক বন্ধ করে দেওয়া হয়। এ কথা সত্য যে, রাজধানীর যানজট নিরসনে কর্তৃপক্ষের উদ্যোগ আছে, প্রচেষ্টা আছে, আন্তরিকতাও দৃশ্যমান। কিন্তু তারপরও অবরোধের কারণে অবস্থার উন্নতি হচ্ছে না, এটাই বাস্তবতা। তবে রাজপথে মিছিল-মিটিং ও কর্মসূচি পালনই যানজটের একক কারণ নয়। ফুটপাত দখল করে দোকানপাট বসানো, যেখানে-সেখানে গাড়ি পার্কিংও যানজটের বড় কারণ। উল্টোপথে গাড়ি চালানো এবং চালকদের আচরণবিধি লঙ্ঘনও যানজটের কারণ হিসেবে বলা হয়।
১৫ মে প্রতিদিনের বাংলাদেশে ‘আন্দোলনে সড়ক অবরোধ, তীব্র যানজটে নাকাল রাজধান’ শীর্ষক প্রতিবেদনে জানা গেছে, বাংলাদেশের সর্বস্তরের ডিপ্লোমা ইন নার্সিং এবং ডিপ্লোমা ইন মিডওয়াইফারি কোর্সকে স্নাতক সমমানের স্বীকৃতি দেওয়ার দাবিতে রাজধানীর শাহবাগ মোড় অবরোধ করেন শিক্ষার্থীরা। আবাসন সমস্যার সমাধানসহ তিন দফা দাবিতে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনা অভিমুখী সড়ক অবরোধ করেন। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়রের দায়িত্ব ইশরাক হোসেনকে বুঝিয়ে দেওয়ার দাবিতে গুলিস্তানের নগর ভবনের সামনে অবস্থান নেয় হাজারো মানুষ। এসব কারণে শাহবাগ ক্রসিং এবং কাকরাইল মসজিদের সামনের ক্রসিং পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। এই দুটি ক্রসিং ব্যবহার করা গাড়িগুলো বিকল্প পথে যেতে বাধ্য হলে আশপাশের অঞ্চলেও গাড়ির চাপ বেড়ে যানজটের সৃষ্টি হয়। যানজট পৌঁছে যায় নগরের অন্যান্য অঞ্চলেও। সেদিন সকাল থেকে রাত অবধি রাজধানীর জনদুর্ভোগের চিত্র ছিল এটি। এই দুর্ভোগ কেবল ঢাকায় বসবাসরত ২ কোটি মানুষের নয়, পরোক্ষভাবে দেশের ১৮ কোটি মানুষের কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পরিসংখ্যান বলছে, রাজধানীতে প্রতিদিন যানজটে নষ্ট হচ্ছে ৫০ লাখ কর্মঘণ্টা। এতে বছরে প্রায় ৩৭ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে। আমরা মনে করি, যানজটের ক্ষতি শুধু কর্মঘণ্টা বা অর্থমূল্য দিয়ে নিরূপণ করলে চলে না, সামগ্রিকভাবে বিবেচনায় নিয়ে একে মোকাবিলা করতে হবে। পরিসংখ্যান আরও বলছে, একটি মেগা সিটিতে শহরের আয়তনের ২৫ শতাংশ সড়ক থাকতে হয়। কিন্তু ঢাকায় আছে মাত্র ৮ শতাংশ। আবার সড়কের অনেক জায়গা দখলদারের দখলে থাকে। সেখানে দোকানপাট, ময়লার ভ্যান, যত্রতত্র গাড়ি রেখে রাস্তা সংকীর্ণ করে ফেলা হচ্ছে।
গণতান্ত্রিক সমাজে শান্তিপূর্ণ ও নিয়মতান্ত্রিকভাবে দাবিদাওয়া জানানো সব নাগরিকের গণতান্ত্রিক অধিকার। কিন্তু এটাও মনে রাখতে হবে, অধিকার আদায়ের নামে অন্য নাগরিকদের ভোগান্তিতে ফেলাও অগ্রহণযোগ্য। দেশে সড়ক বন্ধ করে সভা-সমাবেশ ও প্রতিবাদ করার চর্চা বহু বছর ধরে চলে আসছে। তা বন্ধ হওয়া প্রয়োজন। যেকোনো নগরে সভা-সমাবেশ করা কিংবা প্রতিবাদ জানানোর জন্য আলাদা জায়গা থাকা অত্যাবশ্যক। আধুনিক নগর-পরিকল্পনায় এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একসময় মুক্তাঙ্গনে রাজনৈতিক দল এবং বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ গিয়ে তাদের দাবিদাওয়া জানাত। সেই স্থানটি এখন অন্যদের দখলে। প্রেস ক্লাবের সামনে নাগরিকদের বিভিন্ন অংশ তাদের দাবিদাওয়া জানিয়ে আসছে। কিন্তু সেখানে একটু বড় জমায়েত হলে যান চলাচলে সমস্যা তৈরি হয়। এখানেও জনগণকে দুর্ভোগ পোহাতে হয়।
যানজটের কারণে অনেক মুমূর্ষূ রোগীকে সময়মতো হাসপাতালে নেওয়া সম্ভব হয় না। তাছাড়া রাস্তায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে আটকে থাকার ফলে সৃষ্ট ভোগান্তিতে অনেক সুস্থ মানুষও শারীরিক বা মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। রাজধানীর বায়ুদূষণের বড় কারণও যানজট। এর পরোক্ষ প্রভাব পড়ছে জনস্বাস্থ্যে। তবে এই মুহূর্তে যানজট নিরসনে প্রাইভেটকারের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, চৌরাস্তাগুলোতে টানেল নির্মাণ, ছোট ছোট বিকল্প রাস্তা তৈরি করা, ট্রাফিক পুলিশের জনবল বাড়ানো, পথচারীদের ট্রাফিক আইন মেনে চলতে বাধ্য করার বিকল্প নেই। তবে সবার আগে ফুটপাতসহ সব রাস্তা দখলমুক্ত করতে হবে। আমরা মনে করি, সবার উচিত জনদুর্ভোগ সৃষ্টিকারী যেকোনো কর্মসূচি পরিহার করা। দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছিলেন রাজপথে নয়, যেকোনো দাবি সরকারকে লিখিত আকারে অবহিত করার জন্য। কিন্তু কেউ সে পথে হাঁটছেন বলে মনে হয় না। কথায় কথায় সড়ক অবরোধের প্রবণতা থেকে সবারই সরে আসা উচিত। আমরা আশা করব, এ ব্যাপারে সবার শুভবুদ্ধির উদয় হবে এবং সবাই দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেবেন।