প্রাক-বাজেট
নিরঞ্জন রায়
প্রকাশ : ১৬ মে ২০২৫ ২০:০৭ পিএম
বাংলাদেশে জুন মাস হচ্ছে আগামী অর্থবছরের জন্য বাজেট প্রণয়নের সময়। আশা করা যায় আগামী মাসের কোনো এক সময় অন্তর্বর্তী সরকার ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য জাতীয় বাজেট ঘোষণা করবেন। বাজেট প্রণয়ন সবসময়ই বেশ চ্যালেঞ্জের কাজ, তা সে উন্নত বিশ্বের কোনো দেশের বাজেটই হোক বা বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের বাজেটই হোক। আমেরিকার মতো বিশ্বের সবচেয়ে বৃহৎ অর্থনীতির দেশকেও বাজেট তৈরি করতে হিমশিম খেতে হয় এবং অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেই বাজেট প্রণয়ন করতে হয়। আবার সোমালিয়ার মতো হতদরিদ্র দেশকেও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেই বাজেট তৈরির কাজটি করতে হয়। তাই আমাদের দেশের বাজেট তৈরিতে অনেক চ্যালেঞ্জ থাকবে, এটাই স্বাভাবিক এবং এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেই জাতীয় বাজেট প্রণয়ন করতে হবে।
আমাদের দেশে, যেখানে সম্পদের অপ্রতুলতা আছে, সেখানে বাজেট প্রণয়ন এমনিতেই এক জটিল কাজ। তার ওপর এ বছর বাজেট তৈরির ক্ষেত্রে আছে বাড়তি চ্যালেঞ্জ এবং অনিশ্চয়তা, যার কিছু আন্তর্জাতিক অঙ্গনের অস্থিরতার সঙ্গে জড়িত এবং কিছু দেশের অভ্যন্তরীণ অনিশ্চয়তার সঙ্গে জড়িত। অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জের মধ্যে রাজনৈতিক অস্থিরতা, ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতা, দেশীয় বিনিয়োগে নেতিবাচক অবস্থা, পুঁজিবাজারে স্থবিরতা, ব্যাংকিং খাতে অব্যবস্থা এবং মানুষের ক্রয়ক্ষমতার হ্রাস উল্লেখযোগ্য। বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জের মধ্যে বিশ্বব্যাপী সৃষ্ট বাণিজ্য যুদ্ধের সন্তোষজনক সুরাহা না হওয়া, আমেরিকাসহ পশ্চিমা বিশ্বের অনেক দেশে মন্দার আশঙ্কা, আঞ্চলিক রাজনৈতিক উত্তেজনা উল্লেখযোগ্য। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেই বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে বাজেট প্রণয়ন করতে হবে। ফলে কাজটা যে বেশ কঠিন তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
সাধারণত বাজেট প্রণয়নের আগে বাজেট নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয় এবং বিভিন্ন মহল থেকে আসে নানা রকম সুপারিশ। কিন্তু এ বছর সেরকম আলোচনা হতে দেখিনি। বিভিন্ন পেশাজীবী প্রতিষ্ঠান এবং থিংকট্যাংক থেকে কিছু আলোচনা হলেও ব্যবসায় সংগঠনের কাছ থেকে সে রকম আলোচনার কথা আমাদের নজরে আসেনি। এমনকি উল্লেখযোগ্য সুপারিশও সেভাবে আসেনি। এর একটি কারণ হতে পারে যে দেশে এখন অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায়। সাধারণত এই ধরনের অরাজনৈতিক সরকারের কাছ থেকে খুব সহজে দাবিদাওয়া আদায় করা যায় না। তাছাড়া দেশে ব্যবসায়ীরা এখন এক কঠিন সময় পার করছে এবং নানান চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে টিকে থাকার লড়াইয়ে ব্যস্ত। এ রকম অবস্থায় আগামী দিনের জন্য সুনির্দিষ্ট ব্যবসায়িক পরিকল্পনা গ্রহণ করা কঠিন হয়ে পড়ে।
দেশ পরিচালনা এবং অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে হলে সরকারকে বাজেট দিতে হয়। আর বাজেট প্রণয়ন করতে হলে দেশের বিভিন্ন খাতের অগ্রযাত্রার বিষয়টিও বিবেচনায় রাখতে হয়। এ রকম কিছু অগ্রাধিকার খাত হচ্ছে, ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসা, প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা, বিনিয়োগ, অবকাঠামো উন্নয়ন, কৃষি খাত এবং আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য। দেশের অর্থনীতিতে এসব খাতের আছে উল্লেখযোগ্য অবদান। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসা। কারণ দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নতিতে এই ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসার গুরুত্ব অপরিসীম। কিন্তু এই খাত কখনই সেভাবে স্বীকৃতি পায়নি এবং সরকার ও অন্যান্য সংস্থা থেকে বিশেষ সুবিধা সেভাবে পায় না। অনেক প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে তাদের ব্যবসায়িক কার্যক্রম চালিয়ে যেতে হয়।
ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা নিজের উদ্যোগেই ব্যবসায়ের ঝুঁকি গ্রহণ করেন, মূলধন বিনিয়োগ করে এবং ব্যবসা পরিচালনা করে থাকে। এসব ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা ব্যবসা শুরু করার জন্য কোনো রকম প্রাতিষ্ঠানিক সহযোগিতা পায় না। এমনকি অধিকাংশ ব্যবসায়ী ব্যাংক থেকে স্বাভাবিকভাবে ঋণ সুবিধা পর্যন্ত পায় না। অনেকেই বলবেন যে অধিকাংশ ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ী ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েই ব্যবসা পরিচালনা করছেন। কথা সত্য। কিন্তু তারা যে প্রক্রিয়ায় ব্যাংক থেকে যে পরিমাণ ঋণ পেয়ে থাকে, তা অনেক ক্ষেত্রে শুরু থেকেই তাদের জন্য গলার ফাঁস হয়ে দাঁড়ায়। অনেক ব্যবসায়ী এই ঋণের কারণে ব্যবসা বন্ধ করতে বাধ্য হন। এমনকি অনেক ব্যবসায়ী ঋণখেলাপির খাতায় নাম লিখিয়েছেন শুধু ব্যাংক থেকে জটিল প্রক্রিয়ায় ঋণ গ্রহণের কারণে।
দেশের অর্থনীতিতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের অবদান অপরিহার্য। প্রথমত, এই ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা মূলত আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ হিসেবে কাজ করে। ফলে দেশের বেকার সমস্যা সমাধানে এই খাত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। দেশের পণ্য সরবরাহ, বিশেষ করে ভোক্তাদের কাছে পণ্যসামগ্রী পৌঁছে দেওয়ার কাজটি করে থাকে এই ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা। অর্থাৎ দ্রব্যসামগ্রীর স্বাভাবিক সরবরাহ বজায় রাখার ক্ষেত্রে সাপ্লাই চেইনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে কাজ করে এই ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসা। এই ব্যবসা প্রতিষ্ঠা করতে এবং চালু রাখতে সরকার বা অন্য কোনো পক্ষের প্রত্যক্ষ সাহায্য সহযোগিতার প্রয়োজন হয় না। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা নিজেদের চেষ্টায় প্রয়োজনীয় মূলধন সংগ্রহ করে ব্যবসা শুরু করে। অবশ্য সরকার বা অন্যান্য সংস্থা থেকে নীতি সহযোগিতা পেলে তারা ব্যবসায় আরও অনেক ভালো করতে পারত। এই নীতি সুবিধা দেওয়া সম্ভব বাজেটের মাধ্যেম, যদি সেখানে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হয়। দেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের জন্য কিছু সুযোগ প্রস্তাবিত বাজেটে রাখতে পারলে, দেশের সার্বিক ব্যবসা-বাণিজ্যে যেমন ভালো গতি আসবে, তেমনি দেশের অর্থনীতিকে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রেও ভালো অবদান রাখতে পারবে।
দেশের অর্থনীতি এবং আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থায় ক্ষুদ্র এবং মাঝারি ব্যবসায়ীদের গুরুত্ব যে শুধু আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশেই আছে, তেমন নয়। বরং এই খাতের গুরুত্ব উন্নত বিশ্বেও যথেষ্ট আছে। অর্থনীতিতে অবদান এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টির ভালো বিকল্প হিসেবে কাজ করে জন্য উন্নত বিশ্বে এই খাতকে সরকারিভাবে বিশেষ ধরনের সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়। উন্নত বিশ্ব তো মুক্তবাজার অর্থনীতি, তাই স্বাভাবিকভাবেই এখানে কোনো রকম ব্যক্তি উদ্যোগের ব্যবসাকে সরকারি সহযোগিতা প্রদানের কথা নয়। কিন্তু তারপরও সরকার এই ক্ষুদ্র এবং মাঝারি ব্যবসাকে উৎসাহিত করে নানা রকম প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রণোদনা প্রদানের মাধ্যমে। তাই আমাদেরও দেশের অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এই খাতকে সহযোগিতা প্রদানের বিষয়টি সক্রিয় বিবেচনায় নেওয়া প্রয়োজন।
আমরা লক্ষ্য করেছি যে বাজেট প্রণয়নে অর্থনীতির অন্যান্য খাত, বিশেষ করে বৃহৎ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং করপোরেট ব্যবসায়ীদের জন্য কিছু সুযোগ-সুবিধা থাকলেও ক্ষুদ্র, মাঝারি এবং ব্যক্তিগত ব্যবসায় নিয়োজিত ব্যবসায়ীরা বাজেট থেকে সেরকম কোনো সুবিধা পায় না। অন্তত বাজেট ঘোষণার পর সেরকম বিশেষ কিছু সুযোগ-সুবিধার বিষয় সেভাবে দেখা যায় না, যা দেশের ক্ষুদ্র এবং মাঝারি ব্যবসায়ীদের জন্য রাখা হয়েছে। অথচ দেশের অর্থনৈতিক উন্নতিকে টেকসই করতে হলে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে একটি শৃঙ্খলার মধ্যে নিয়ে এসে একে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে হবে। আমাদের অর্থনীতি মূলত এখনও কৃষিপ্রধান এবং আগামীতেও যে কৃষিপ্রধানই থাকবে, তা মোটামুটি নিশ্চিত করেই বলা যায়। মোট দেশজ উৎপাদনের বৃহৎ অংশ এখনও কৃষি খাত থেকেই আসে। বাজেটে এই খাতকে বরাবরই অগ্রাধিকার দেওয়া হয় এবং এ বছরও হয়তো এর ব্যতিক্রম হবে না। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাজেটে কৃষি খাতে সহযোগিতা দেওয়া হয় ভর্তুকি প্রদানের মাধ্যমে। একথা অনস্বীকার্য যে কৃষি খাতে ভর্তুকি প্রদানের মাধ্যমে কৃষকদের কিছুটা আর্থিক সহযোগিতা দেওয়া হয় ঠিকই।। কিন্তু এতে কৃষকদের মূল সমস্যার সমাধান হয় না। কৃষকদের প্রধান সমস্যা হচ্ছে উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য মূল্য না পাওয়া। আর এই ন্যায্য মূল্য না পাওয়ার পেছনে অন্যতম কারণ হচ্ছে আমাদের দেশে উৎপাদিত কৃষিপণ্য আধুনিক পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করে বছরব্যাপী সরবরাহ করার মতো গুদামজাত সুবিধা নেই।
এই আধুনিক গুদামজাত ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারলে যুগপৎ দুটো উদ্দেশ্য অর্জন হবে। প্রথমত, কৃষকের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। দ্বিতীয়ত, বছর ধরে পণ্যসামগ্রীর স্বাভাবিক সরবরাহ নিশ্চিত করা সম্ভব হবে, ফলে দ্রব্যমূলের ঊর্ধ্বগতি অনেক ক্ষেত্রেই রোধ করা সম্ভব। এ কারণেই প্রতিবছর বাজেট বরাদ্দের মাধ্যমে কৃষি খাতে এই অবকাঠামোগত সুবিধা গড়ে তোলা প্রয়োজন। অনেকেই বলবেন যে বাজেটের মাধ্যমে এই ধরণের সুবিধা কীভাবে গড়ে তোলা সম্ভব। এ কথা ঠিক যে রাজস্ব বাজেটের মাধ্যমে এই ধরনের সুবিধা গড়ে তোলার ব্যাপারে কিছুই করা সম্ভব হবে না। কিন্তু উন্নয়ন বাজেটে বাৎসরিক বরাদ্দের মাধ্যমে কৃষি খাতের এই ধরনের অবকাঠামোগত সুবিধা গড়ে তোলা সম্ভব।
একইভাবে দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী এবং হতদরিদ্র মানুষের জন্য কিছু সুযোগ বাজেটে রাখার কথা সক্রিয় বিবেচনায় নিতে হবে। কেননা নানান কারণে দেশে দারিদ্র্যসীমার নিচের জনসংখ্যার পরিমাণ বেড়ে চলেছে। এ ব্যাপারে সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন আশান্বিত হওয়ার মতো নয়। হতদরিদ্রের সংখ্যা যাতে কোনোভাবেই আর বৃদ্ধি না পায়, বরং হ্রাস পায় তা নিশ্চিত করতে হলে বাজেটে এই জনগোষ্ঠীর জন্য বিশেষ বরাদ্দ রাখার কোনো বিকল্প নেই। একইভাবে দেশের শিল্প উৎপাদন, আমদানি-রপ্তানি এবং স্বাস্থ্য খাতেও বিশেষ বরাদ্দ দেওয়া প্রয়োজন। সবকিছু মিলিয়ে এ বছর হবে চ্যালেঞ্জের বাজেট। কিন্তু বাস্তবতার আলোকে বাজেটে বরাদ্দ রাখতে হবে। চ্যালেঞ্জ এবং বাস্তবতার মধ্যে সর্বোচ্চ সমন্বয় করে যে বাজেট প্রণয়ন করা হবে, সেটাই হবে এই সময়ের জন্য সেরা বাজেট। অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ উপদেষ্টা হয়তো সেই কাজটিই করতে চলেছেন।