পরিবার
মীর আব্দুল আলীম
প্রকাশ : ১৬ মে ২০২৫ ২০:০৪ পিএম
সংসার নামক নাট্যমঞ্চে প্রতিদিনই বদলায় চরিত্রের সংলাপ। আজ যে বউ, সে কাল শাশুড়ি। আজ যে শাশুড়ি, একদিন সেও ছিল কারও ঘরের নতুন মুখ। অথচ নাটকের পাণ্ডুলিপিটা কেমন যেন একঘেয়েÑ বউয়ের চোখে শাশুড়ি ‘দুই টাকার মাসিমা’, আর শাশুড়ির চোখে বউ ‘স্মার্টফোনে ডুবে থাকা এক গাম্ভীর্যহীন প্রজন্ম’। নাটক জমে না, কেবলই দ্বন্দ্ব আর অপমানের দৃশ্যপট।
পুলিশ অফিসার পলাশের আত্মহত্যার পর একজন পুত্রবধূ সেদিন এভাবেই বলছিলেনÑ ‘শ্বশুরবাড়িতে ঢোকার আগের রাতটা আজও মনে পড়ে। ছিমছাম সংসার ছেড়ে যাচ্ছি, বুকের মধ্যে ফুঁসে উঠছে একরাশ আশঙ্কা। চোখের কোণে জল, কিন্তু মুখে হাসি। মা বলেছিলেন, ‘শ্বশুরবাড়িতে মায়ের মতো শাশুড়ি পাবে, ভাইয়ের মতো দেবর, বোনের মতো ননদ।’ কিন্তু বাস্তবে পেয়েছিলাম এক কঠিন বাস্তবতা।
বাংলার ঘরে ঘরে বউ-শাশুড়ির সম্পর্ক যেন এক অলিখিত প্রতিযোগিতা। একে অন্যকে ছাপিয়ে যাওয়ার অভিপ্রায়, একে অন্যকে বোঝার আগেই ভুল ধরার প্রবণতা। অথচ সম্পর্কগুলো এমন হতে পারত নাÑ হৃদ্যতা, সহানুভূতি আর পারস্পরিক শ্রদ্ধায় গাঁথা হলে। একজন মেয়ে যখন অন্য এক বাড়িতে পুত্রবধূ হয়ে আসে, তখন সে একজন মানুষ হিসেবে পরিপূর্ণ হলেও সংসারধর্মে সে একেবারে নবীন। তার শেখার আছে অনেক কিছু। কিন্তু অনেক সময় আমরা ভুলে যাই এই সাধারণ কথাটুকু। পরিবার ভাবতে শুরু করেÑ ‘সে তো এখন বউ, মানে পরিপূর্ণ গৃহিণী।’
সে যে কেবল কিছুদিন আগেই নিজ বাড়িতে মা-বাবার কোলে ঘুমানো আদরের শিশু ছিল, তা আমরা ভুলে যাই। আমরা ভুলে যাই, তারও আবেগ আছে, ভয় আছে, অনভিজ্ঞতা আছে। অথচ তাকে তখনই ভাবি ‘দায়িত্ববান’, ‘পরিপক্ব’, ‘পরিবারের মান রক্ষার বাহক’। এই অতিরিক্ত প্রত্যাশা তাকে করে তোলে জড়সড়, ক্লান্ত, ভীত।
শাশুড়ির অবস্থানও সহজ নয়। তিনি নিজেও একদিন এই বাড়িতে এসেছিলেন নতুন বউ হয়ে। তারও ভুল হয়েছিল, কষ্ট হয়েছিল। কিন্তু অনেক সময় তিনিও ভুলে যান নিজের অতীতের সেই দিনগুলোর কথা। তিনি হয়ে ওঠেন এক বিচারকÑ বউয়ের ভুল খোঁজা যেন তার নিত্যকার চর্চা।
এই সংঘাতে মাঝখানে পড়ে থাকেন সেই মানুষটি, যিনি একদিকে মায়ের ছেলে, অন্যদিকে স্ত্রীর স্বামী। তিনি একটি ভারসাম্য তৈরির চেষ্টা করেন। কিন্তু পারিবারিক রাজনীতির এই প্যাঁচে অনেক সময় হারিয়ে ফেলেন নিজেকেই। মা চান ছেলে যেন বউকে তার নিয়মে চালান। স্ত্রী চান স্বামী যেন সব বিষয়ে তার পাশে থাকেন। আর এই চাওয়া-পাওয়ার টানাপড়েনে ক্লান্ত হয়ে পড়েন তিনি।
পুরুষদের কষ্ট নিয়ে আমরা কমই বলি। নারী নির্যাতন নিয়ে যে উদ্বেগ, যে আন্দোলন, তা অবশ্যই জরুরি। কিন্তু সংসার-নির্যাতনের এক নীরব শিকার পুরুষরাও। বাড়িতে শান্তি নেই, অফিসে চাপ, সমাজে অপমানÑ সব মিলিয়ে পুরুষদের একাংশ মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। দাম্পত্য কলহ, পারিবারিক দ্বন্দ্ব তাদের করে তোলে বিষণ্ন, নির্জীব। বহু সময় তারা মুখ ফুটে কিছু বলতে পারেন না। ফলে, একসময় তৈরি হয় শারীরিক ও মানসিক রোগ। কখনও কখনও পুলিশ অফিসার পলাশদের মতো মানুষকেও বলির পাঁঠা হতে হয়, জীবন দিতে হয়।
এই সমাজে মানবিকতা হারিয়ে যাচ্ছে। মানুষ মানুষকে আর বিশ্বাস করতে পারছে না। আমরা পরিবার গড়ি, কিন্তু সম্পর্ক গড়তে জানি না। বউ আর শাশুড়ির মধ্যে যদি একটু সহনশীলতা, একটু মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি থাকতÑ তাহলে পরিস্থিতি ভিন্ন হতে পারত।
বিয়ের আগে আমরা ফুল, গয়না, জামাকাপড় নিয়ে যতটা ভাবি, সম্পর্ক নিয়ে ততটা ভাবি না। কোন পারিবারিক পরিবেশে মেয়ে যাচ্ছে, তার মানসিক প্রস্তুতি কেমন, ছেলেটির মা-বাবা সম্পর্কের কোন ভাষা বোঝেনÑ এসব নিয়ে কোনো আলোচনা হয় না। ফলে, বিয়ের সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয় ভুল বোঝাবুঝির দৌড়।
বউ যদি শাশুড়িকে মায়ের মতো দেখেন, শাশুড়ি যদি তাকে নিজের মেয়ের মতো ভাবেনÑ তবে সম্পর্কের এই টানাপড়েন এমনিতেই কমে যায়। হ্যাঁ, মতের মিল সব সময় হবে না। কিন্তু মতের অমিল মানেই শত্রুতা নয়। একসঙ্গে বসবাস মানেই তো কিছুটা আপস, কিছুটা ছাড়, কিছুটা সহানুভূতি। একটা পরিবারের শান্তি নির্ভর করে এই ছোট ছোট মানবিক আচরণের ওপর। একজন শাশুড়ির একটু প্রশ্রয়, একজন বউয়ের একটু ধৈর্যÑ এই দুটো মিলেই গড়ে ওঠে সুখী সংসার।
সুতরাং, আমাদের দরকার মানসিকতার পরিবর্তন। দরকার পারিবারিক শিক্ষার প্রসার। শুধু পড়ালেখা দিয়ে মানুষ গড়ে না, সম্পর্ক গড়ার শিক্ষাও জরুরি। স্কুলে, কলেজে, এমনকি গণমাধ্যমেও এই বার্তাগুলো প্রচার হওয়া দরকার।
আমরা যেন আর কাউকে মানসিকভাবে অসুস্থ না করি। সম্পর্কের নামে একে অপরকে হেনস্থা না করি। আমাদের ঘর যেন হয়Ñ সহানুভূতির ঘর, ভালোবাসার ঘর। যেখানে বউ-শাশুড়ির সম্পর্ক হবে শ্রদ্ধার, নয়তো অন্তত সহ্য করার মতো। আর মাঝখানে থাকা সেই মানুষটা স্বামীÑ সেও যেন পায় একটু শান্তি, একটু নিঃশ্বাস।
আসলে বউ-শাশুড়ি সম্পর্ক যুগে যুগে সবচেয়ে আলোচিত সম্পর্ক। এই সম্পর্ক সব সময়-ই এক ধরনের জটিলতার মধ্য দিয়ে যায় আর এটার কারণ হলো একে অপরের প্রতি সমান শ্রদ্ধা ও সম্মান না থাকা। যৌথ পরিবারে বউ-শাশুড়ির দ্বন্দ্বটা থেকেই যায়। অন্য এক মেয়ে ছেলেকে, পর করে দিচ্ছে এ ব্যাপারগুলো মেনে নিতে হয়তো অনেক বেশিই সময় লাগিয়ে নেন শাশুড়িরা। অনেক সময় মেনে নেয়ও না। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, বিয়ের পর বহু বউ স্বামীকেন্দ্রিক হতে। তাদের কাছে সংসার মানে স্বামী-স্ত্রীতেই যেন সীমাবদ্ধ। পরিবারের অন্যদের অবস্থান তাদের ভাবার বিষয় না। তাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বউ-শাশুড়ি একে অপরকে প্রতিপক্ষ ভাবতে থাকে।
বাঙালির হাজার বছরের সংস্কৃতির সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে একান্নবর্তী পরিবার। যে পরিবারে মা-বাবা, ভাই-বোন, দাদা-দাদি, চাচা-চাচি, চাচাতোÑ ভাইবোন, ফুপুরাসহ বন্ধন। আমরা অনেকেই এমন একটি পরিবার থেকেই বেড়ে উঠেছি। কিন্তু সেই একান্নবর্তী পরিবারগুলো আজ ভেঙে যাচ্ছে। আধুনিকতার নামে গড়ে উঠছে ছোট পরিবার। ফলে নেই সেখানে প্রাণবন্ত আবেগ আর আবেশ। কালের অতলে হারিয়ে যেতে বসেছে এক্কান্নবর্তী সংসারজীবনের সেই সুমধুর অতীত। একক পরিবারের কালছায়ায় গড়ে উঠছে স্বার্থপর ও হতাশাগ্রস্ত এক সমাজ। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পরিবারের শিশু-কিশোরদের নৈতিকতা ও মানবিক মূল্যবোধ বিকাশের ক্ষমতা। দিনে দিনে তারা হয়ে উঠছে অবাধ্য ও স্বেচ্ছাচারী। আদব-কায়দা প্রদর্শনের ন্যূনতম বোধও বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে তাদের মধ্যে। আমরা মনে করি, আবারও সময় এসেছে একান্নবর্তী পরিবারের গুরুত্ব উপলব্ধি করার।
সবশেষে বলতে চাইÑ সমাজকে মানবিক করতে হলে পরিবার থেকেই শুরু করতে হবে। পরিবার মানে শুধু রক্তের সম্পর্ক নয়, আত্মিক বন্ধনও। তাই সকল সম্পর্ক যদি শ্রদ্ধা, সহমর্মিতা আর পরস্পরের প্রতি সহনশীলতায় গড়ে ওঠে, তাহলে একদিন পরিবার হবে শান্তির আশ্রয়স্থল। যেখানে কেউ কারও শত্রু নয়- সবাই হবে একে অন্যের সহযাত্রী। পুরুষ বা নারী-দুই পক্ষই পাবে তাদের প্রাপ্য সম্মান, ভালোবাসা এবং স্বস্তি। আমাদের এখনই ভাবতে হবেÑ ঘর ভাঙা নয়, ঘর গড়ার সময় এসেছে।