সামাজিক মূল্যবোধ
শেলী সেনগুপ্তা
প্রকাশ : ১৪ মে ২০২৫ ১৬:২১ পিএম
শেলী সেনগুপ্তা
মানুষ সামাজিক জীব। জন্ম থেকেই সমাজবদ্ধভাবে জীবনযাপন করে। এটিই মানুষের মৌলিক বৈশিষ্ট্য। মানুষ কখনও একা বসবাস করতে পারে না। মানুষের এই সঙ্গবদ্ধ সমাজকে পরিচালনা করার জন্য আছে কিছু নিয়মনীতি, শৃঙ্খলা ও সৌন্দর্য; যা অবশ্যই মেনে চলতে হয়। এগুলো না মানলেই শুরু হয় সামাজিক অবক্ষয়। পরিণতি হয় দুঃখজনক।
তাছাড়া সামাজিক অবক্ষয়ের আরও কিছু কারণ আছে, তার মধ্যে দারিদ্র্য, জনসংখ্যার আধিক্য, বেকারত্ব, মাদকাসক্তি, সম্পদের অসম বণ্টন ব্যবস্থা, সামাজিক কারণ, পারিবারিক কারণ, সঙ্গদোষ, অনাকাঙ্ক্ষিত অনুকরণ ইত্যাদি। দারিদ্র্যের দিক থেকে এই সময় আমরা বলতে গেলে এগিয়েই আছি। তাই জীবনের চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে এবং পরিবারের ভরণপোষণের ব্যবস্থা করা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। এজন্য কিছু মানুষ সমাজবিরোধী কাজকর্মে লিপ্ত হচ্ছে- যা সমাজের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর নিদর্শন।
শুধু আজ নয়, সকল সময় বেকারত্ব মানুষকে মহাসংকটে ফেলে। পরিবারের অর্থনৈতিক দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বেকার মানুষ অনেক সময় অন্যায়ের পথে চলে যায়। শুরু হয় অবক্ষয়, এ অবক্ষয় ব্যক্তিগত ও সামাজিকভাবে হয়।
মাদকাসক্তি এমন একটি মন্দ অভ্যাস, যা মানুষকে নীতিবোধের বাইরে নিয়ে যায়। মাদকাসক্ত মানুষ পারে না এমন কোনো কাজ নেই। মাদক সেবনের টাকা সংগ্রহ করার জন্য সব ধরনের অন্যায়ের পথে পা বাড়ায়। কখনও কখনও মানুষ মাদকের টাকা সংগ্রহ করার জন্য নৈতিকতা বর্জন করে অন্যায় কাজে লিপ্ত হয়।
আমরা বর্তমানে এমন এক সমাজে বসবাস করছি, যেখানে কন্যাসন্তান জন্মের পর থেকেই তার নিরাপত্তা নিয়ে তটস্থ থাকতে হয় অভিভাবককে। তাকে একা কোথাও পাঠানো যায় না এমনকি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও তারা নিরাপদ নয়।
দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপচর্চার ফলে হতাশার কবলে পড়ছে মেধাবী যুবসমাজ। তারা যার যার মতো করে আইন হাতে তুলে নিচ্ছে। তাদের কাছে মানুষের জীবনের কোনো মূল্যই নেই। এর ফলে নিজের সঙ্গে সঙ্গে সমাজেরও ক্ষতি করছে। হচ্ছে সামাজিক অবক্ষয়।
শুধু এখন নয়, সব সময়ই দরিদ্রতা থেকে মুক্তির জন্য যুবসমাজ পাড়ি দিতে চায় বিদেশে। সেখানেও কেউ কেউ প্রতারণার ফাঁদে পড়ে হারাচ্ছে অনেক কিছুই। দেশে ও বিদেশে অপহরণ এখন নিত্যদিনের ঘটনা। একইভাবে মাদকের ছোবলে নিশ্চিহ্ন হচ্ছে অনেক জীবন। অনিয়ম যেন এখন চিরায়ত প্রথা।
সবকিছুরই মূলে রয়েছে ন্যায়বিচারের অভাব। এ কারণে আমরা আজ ন্যায়-অন্যায় ভুলে গেছি, প্রত্যেকেই চলছি নিজের মতো। প্রতিদিন পত্রিকার খুললেই চোখে পড়ে দুর্নীতি, ঘুষগ্রহণ, ধর্ষণ কিংবা দলবদ্ধভাবে পিটিয়ে মারার খবর। ঘটনাগুলো ঘটছে বিচারবহির্ভূতভাবে। একইভাবে হচ্ছে নিয়োগ বাণিজ্য, উন্নয়নের ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক পার্সেন্টেজ, মার খাচ্ছে আইনের শাসন। এ অবস্থায় কে রোধ করবে অবক্ষয়, কে করবে অবক্ষয় প্রতিরোধ।
কখনই একসঙ্গে চলে না সেবা ও ঘুষ, একইভাবে চলে না পার্সেন্টেজ ও উন্নয়ন। বিষয়টি নিয়ে ভাবার সময় এসেছে। যখন আমরা ছোট অপরাধের বিচার করি সাড়ম্বরে, তখন শতকোটি টাকার লুটপাটকারী, ঘুষখোররা সমাজে বুক ফুলিয়ে হাঁটে। আইন তাদের কাছে মাথা নত করে চলে।
প্রতিদিন বাড়ছে দ্রব্যমূল্য, বাড়ছে জীবন রক্ষাকারী ওষুধের দাম। শিক্ষা উপকরণের দামও থেমে নেই। সমাজের সর্বত্রই রয়েছে বণ্টনের বৈষম্য। সবকিছুর মধ্যে দরকার সুপরিবর্তন। কে আনবে সুপরিবর্তন, কার কাছে যাবে সমাজ? দরকার আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা। যত দিন আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা হবে না, তত দিন মানুষের ভাগ্যোন্নয়ন করা, মানুষে মানুষে সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা ও সামাজিক অবক্ষয় রোধ করা যাবে না। সামাজিক অবক্ষয় রোধ করার জন্য দরকার সুশিক্ষা।
আমাদের দেশে একটি শিশু জন্মলাভ করার পর থেকে বাবা-মা তাকে শিক্ষিত করে তোলার সর্বাত্মক চেষ্টা করে থাকে, কিন্তু তাকে কখনও মানবিক বা ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার চিন্তা করে না। শুধু সার্টিফিকেট-সর্বস্ব শিক্ষাই তার অর্জিত হয়। ভালো পেশায় যুক্ত হয় তবে কতটুকু ভালো মানুষ হয়েছে, তা ভাবার বিষয়।
আমাদের দেশে সাক্ষরতা বেড়েছে অনেক, কিন্তু সুশিক্ষা বাড়েনি। শিক্ষা হয়েছে শুধুই কাগজে-কলমে। সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন আনার মতো শিক্ষা হয়নি। ফলে জীবনের পরতে পরতে দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে মানুষ। কেউ কারও ওপর ভরসা রাখতে পারে না, কারণ এখানে প্রতারণা আর দুর্নীতি হয়ে উঠেছে সাধারণ বিষয়। এমন পরিস্থিতি চলতে থাকলে সমাজে অরাজকতা ও নৈরাজ্য বৃদ্ধি পায়। সমাজের প্রতি থাকে না কোনো দায়বদ্ধতা। এজন্য শিক্ষা হতে হবে জীবনমুখী ও জীবনে শিক্ষার প্রভাব ফুটিয়ে তুলতে হবে এবং একই সঙ্গে আইনের চোখে সবাই সমান, এ ধারণাটা আরও জোরালোভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। ক্ষমতার অপব্যবহার রোধ করতে হবে। ক্ষমতার অপব্যবহার রোধ করার জন্য ব্যক্তি সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।
আমাদের সামাজিক অবক্ষয় এখন জাতীয় সমস্যার রূপ ধারণ করেছে। দেশ ও জাতির স্বার্থে এ সমস্যার প্রতিকার অত্যন্ত জরুরি। এজন্য সবার আগে চেষ্টা করতে হবে দারিদ্র্য বিমোচনের। কর্মহীনদের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে। এজন্য বিভিন্ন ধরনের কারিগরি প্রশিক্ষণের পাশাপাশি ঋণ দিয়ে দেশের মানুষকে উৎপাদনমুখী কর্মে নিয়োগ করতে হবে। বেকারত্ব হ্রাসের চেষ্টা করা দরকার। আমরা জানি, সমাজের অধিকাংশ অপরাধ বেকারদের দ্বারা হয়ে থাকে, তাই বেকারদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা আগেই করতে হবে। সম্পদের সুষম বণ্টন অত্যন্ত জরুরি। সবার সম্পদের হিসাব রাখতে হবে। আয়ের সঙ্গে সম্পদের কতটা সামঞ্জস্য, তাও দেখতে হবে। সম্পদের সঠিক ব্যবহার ও নিয়ন্ত্রণ থাকতে হবে।
রাজনৈতিক অঙ্গীকার সঠিক হতে হবে। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে যেন দেশের যুবশক্তিকে ব্যবহার করা না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা থাকতে হবে। পেশিশক্তি নয়, মেধাশক্তিকে অধিক গুরুত্ব দিতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে রাজনীতিমুক্ত রাখার শতভাগ প্রচেষ্টা থাকতে হবে। নিজস্ব সংস্কৃতিকে সম্মান করতে হবে। বিদেশি সংস্কৃতিকে সম্মান করা যায়, তবে বিদেশি সংস্কৃতির কতটুকু গ্রহণ এবং বর্জন করব, সে বিষয়ে সচেতন হতে হবে। বিদেশি সংস্কৃতির সবটুকুই আমাদের জন্য মঙ্গলজনক হবেÑ এমন ভাবার কিছু নেই। বুঝেশুনেই গ্রহণ করতে হবে।
পরিবারের সবাইকে নিয়ে শিক্ষামূলক অনুষ্ঠানগুলো উপভোগ করা উচিত। তাতে পারিবারিক বন্ধন দৃঢ় হয়। আমরা জানি, যেকোনো শিক্ষা শুরু হয় পরিবার থেকে। তাই পিতা-মাতাকে সন্তান মানুষ করার সময় অনেক বেশি সচেতন থাকতে হবে, যেন সে সঠিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে ওঠে। সন্তানের পারিপার্শ্বিক দিকটি খেয়াল রাখতে হবে। সন্তান যেন অতিরিক্ত সময় ডিভাইসে সময় না দেয়, সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। দিনের একটা সময় পরিবারের সবাইকে কিছুটা সময় কাটাতে হবে। পরিবারের বড়রা সন্তানের কথা শুনবেন এবং গুরুত্ব দেওয়ার চেষ্টা থাকা দরকার।
তা ছাড়া সমাজের গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে থাকা মানুষগুলো আমাদের যুবসমাজের অনুপ্রেরণা হতে পারে, হতে পারে আদর্শ ও দিকনির্দেশক। বিষয়টি মনে রাখা দরকার, এদিকে খেয়াল রেখে জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করা উচিত। কর্মজীবন, ব্যক্তিজীবনে থাকতে হবে সততা, নৈতিকতা, মানবিকতা। একজন জনপ্রতিনিধির মধ্যে পরমতসহিষ্ণুতার মানসিকতা থাকতে হবে।
আমরা সবাই জানি, সামাজিক অবক্ষয় এমন একটি অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি; যা সমাজে প্রতিষ্ঠিত মূল্যবোধকে অস্বীকার করে। ফলে সমাজের সর্বত্র হতাশা ও বিশৃঙ্খলতার সৃষ্টি হয়। সমাজের মানুষের মধ্যে শৃঙ্খলা আনতে হলে বিভিন্ন অনুপ্রেরণামূলক কর্মসূচি গ্রহণ করা যেতে পারে। এজন্য শুধু সরকারের ওপর নির্ভর করলে চলবে না। সমাজের সব স্তর থেকে এ প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো এ বিষয়ে কাজ করতে পারে। বাড়ি বাড়ি গিয়ে উঠান বৈঠক করা যায়, করা যায় সেমিনার, পোস্টার ছাপিয়ে বিলি করা যায়।
যেকোনো অবস্থান থেকে মানুষের প্রতি শ্রদ্ধাশীল মানসিকতা দেখাতে হবে। দলবদ্ধ মানুষ পারে না এমন কোনো কাজ নেই। সুতরাং আমরাই পারি নৈতিকতা, মানবিকতা ও ব্যক্তি সচেতনতার দৃঢ় অবস্থানের সঙ্গে অবক্ষয়মুক্ত একটি সুন্দর সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে, শুধু থাকতে হবে ইচ্ছে ও প্রচেষ্টা।