× ই-পেপার প্রচ্ছদ সর্বশেষ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি শিক্ষা ধর্ম ফিচার ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

স্মরণ

আর পি সাহা : নিভে যাওয়া দীপশিখা

কাজী লতিফুর রেজা

প্রকাশ : ০৭ মে ২০২৫ ১৬:১২ পিএম

কাজী লতিফুর রেজা

কাজী লতিফুর রেজা

দিনটি ছিল মেঘাচ্ছন্ন। টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে। টাঙ্গাইল থেকে নারায়ণগঞ্জে ফিরেছেন। রাস্তাঘাটে যান চলাচল খুব কম। প্রিয় পুত্রকে সঙ্গী করে, পথের চড়াই-উতরাই পেরিয়ে, অনেক কষ্টে পৌঁছেন নারায়ণগঞ্জে। রাঁধুনি ফজলের হাতে প্রিয় মুরগির ঝোল খেয়ে গড়িয়ে নিচ্ছিলেন। রাস্তার ধকল তো কম নয়। রাতের গহিন তমসার নিস্তব্ধতা চিরে কুকুরের কান্না কানে আসছে। ‘ফজল কি কুকুরটাকে খেতে দেয়নি!’ বহুদূর থেকে ভেসে আসছে চাপাকান্নার করুণ সুর, মির্জাপুরের কথা ভাবছেন, জয়া-বিজয়ারা কেমন আছে, ভয় পাচ্ছে না তোÑ এমন সব ভাবতে ভাবতে তন্দ্রাচ্ছ রণদা প্রসাদ সাহা। ‘বাবু জেগে আছেন’ ডাকে সাড়া দিয়ে উঠে বসলেন। আলোয়ানটা জড়িয়ে বাইরে এসে দেখলেন তার কর্মচারীরা দাঁড়িয়ে আছেন সার বেঁধে। কিছু অচেনা লোক। মুখোশধারী। তারা ছেলের কথা জিজ্ঞাসা করেন। পিতার হৃদয় কেঁপে ওঠে। ভবানী ঘুমজড়ানো চোখে বাবার পাশে এসে দাঁড়ান। মুখোশধারীরা তাদের সঙ্গে আসতে বললেন। ঘন অন্ধকারে তিরতির করে কেঁপে উঠল চিরচেনা বাগানের পাতারা। কোনো এক অজানা পাখি বেমক্কা ডেকে চুপ হয়ে গেল। ছোট্ট দলটি চেনা পথ ধরে, চির অচেনার পথে পাড়ি দিয়েছে।

দিনটি ছিল ৭ মে, ১৯৭১। দানবীর রণদা প্রসাদ সাহা এবং তার প্রিয় পুত্র ভবানী প্রসাদ সাহাকে নারায়ণগঞ্জের খানপুরের বাসা থেকে অপহরণ করা হয়েছিল। তারা আর ফিরে আসেননি। ১৯৭১ সালের সেই দিনটিতে, মুক্তিযুদ্ধের নৃশংসতম অধ্যায়ের সহস্র করুণ দৃশ্য একটি। নিভে গিয়েছিল মানবতার এক উজ্জ্বল প্রদীপ রণদা।

বৈশাখের উত্তাল নাচে প্রকম্পিত স্বদেশ। শকুনের থাবার নিচে বাঙালি জনপদ। আবালবৃদ্ধবনিতা ভয়ে থরথর। বাংলাদেশ প্রতিরোধের আগুনে প্রজ্বলিত। যুদ্ধ, নৃশংসতা, কিছু স্বদেশির মিরজাফরিতে ন্যুব্জ মানবতা। রক্তে লাল পদ্মা, মেঘনা, যমুনা থেকে বঙ্গোপসাগর। জড়সড় সুন্দরবন। কান্না হয়ে নামছে মেঘ। জীবনের চিহ্ন নিশ্চিহ্ন হওয়ার দ্বারপ্রান্তে। দেশি দোসর সহায় হয়ে, হায়েনা হানা দিচ্ছে বাংলার দ্বারে দ্বারে। শত শত বিদ্বান, পণ্ডিত, সুহৃদ, মানবিক বোধসম্পন্নদের তুলে নিয়ে গেছে। যারা কখনও ফিরে আসেননি। মানুষ রণদা প্রসাদের পবিত্র দেহ মিশে আছে বাংলার ৩০ লাখ শহীদের সঙ্গে। কিন্তু কর্মী রণদা প্রসাদের কর্ম আজও দীপ্তিমান। গোলাপের সুবাস হয়ে ঘ্রাণ ছড়াচ্ছে আমার বাংলাদেশে।

তিনি ছিলেন সেই সব ব্যাতিক্রমি মানুষের একজন, যিনি নিজের অর্জিত ধনসম্পদ বিলিয়ে দিয়েছিলেন মানুষের কল্যাণে। কুমুদিনী হাসপাতাল, ভারতেশ্বরী হোমস, কুমুদিনী কলেজÑ প্রতিটি প্রতিষ্ঠান তার হৃদয়ের ফোঁটা এক একটি ফুল।

তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন শিক্ষার আলো পৌঁছে যাবে এ ভূখণ্ডের প্রতিটি দরিদ্র শিশুর কাছে। নারীরা পাবে সম্মান আর সেবা পাবে অসহায় মানুষ। কিন্তু যারা অন্ধকারের পক্ষপাতী, যারা মানবতার শত্রু তারা সহ্য করতে পারেনি এ আলোকবর্তিকাকে। ৭ মে, ১৯৭১Ñ দেশি দোসররা তাকে ও তার পুত্রকে ধরে নিয়ে যায়। সে মুহূর্ত থেকেই তারা নিখোঁজ। তাদের আর কোনো খোঁজ মেলেনি। হয়তো তাদের হত্যা করা হয় অজ্ঞাত কোনো স্থানে। মায়ের কোলে যেমন সন্তান নিশ্চিন্তে ঘুমায়, তেমন কোথাও বাংলা মায়ের বুকে ঘুমিয়ে আছেন এ মহানুভব মানুষটি।

তার অপহরণ ও হত্যার বিচারের জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হয়েছে প্রায় অর্ধশতাব্দী। রণদা প্রসাদ সাহাকে হত্যা বা গুম কোনো বিচ্ছিন্ন অপরাধ ছিল না, ছিল ভয়ংকর গণহত্যা পরিকল্পনার অংশ। তার পরিচয়, তার আদর্শ, তার মানবিক কর্মকাণ্ড সবকিছু মুছে ফেলার অপচেষ্টা ছিল এটি। এ হত্যার বিচার, মনে হয় কিছুটা হলেও ইতিহাসের কাছে আমাদের দায় মিটিয়েছে।

রণদা প্রসাদ সাহা ছিলেন নিঃশব্দ বিপ্লবী। তিনি বন্দুক হাতে যুদ্ধ করেননি, কিন্তু হৃদয় দিয়ে, ভালোবাসা দিয়ে, শ্রম দিয়ে গড়ে তুলেছিলেন একটি নতুন সমাজের স্বপ্ন, এক একটি প্রতিষ্ঠান। তাই তার মৃত্যু মানে ছিল মানবতার ওপর নির্মম আঘাত। আজও যখন কুমুদিনী হাসপাতালের কোনো দরিদ্র রোগী বিনামূল্যে চিকিৎসা পায়, ভারতেশ্বরী হোমসের কোনো কন্যা শিক্ষার আলোয় দীপ্ত হয় তখন মনে হয় আমাদের রণদা প্রসাদ বেঁচে আছেন তার স্বপ্নের ভেতর, তার ভালোবাসার ভেতর, মানুষের হৃদয়ে।

আজ যখন দুনিয়াজুড়ে মানবতার সংকট, স্বার্থের লড়াই, অবিচারের ছায়া ঘনাচ্ছে, তখন রণদা প্রসাদ সাহার মতো মানুষকে স্মরণ করা শুধু আনুষ্ঠানিকতা নয়; এটি একটি আদর্শ জাগিয়ে রাখা। এমন ত্যাগী মানুষ, দুর্লভ আদর্শ এখন একান্ত প্রয়োজন। কারণ তার আত্মত্যাগ আমাদের দেখিয়েছে কীভাবে নিঃস্বার্থ ভালোবাসা দিয়ে একটা জাতিকে আলোকিত করা যায়।

যতদিন এ দেশ থাকবে, যতদিন কোনো শিশু তার মায়ের হাত ধরে বিদ্যালয়ে যাবে, যতদিন কোনো রোগী হাসিমুখে হাসপাতাল থেকে ফিরবে ততদিন রণদা প্রসাদ সাহার নাম উচ্চারিত হবে শ্রদ্ধায়, ভালোবাসায়, কৃতজ্ঞতায়।

  • সহযোগী অধ্যাপক ও পরিচালক, এলএলএম প্রোগ্রাম, আর পি সাহা বিশ্ববিদ্যালয়, নারায়ণগঞ্জ
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : মোরছালীন বাবলা

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা