সম্পাদকীয়
প্রকাশ : ০৬ মে ২০২৫ ১৬:২৭ পিএম
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আধার হাওর। এর বিস্তীর্ণ জলরাশি হাওরের মানুষের সুখ-দুঃখের গাঁথা। প্রতিবছর বর্ষা ঋতুর পালাবদলে প্রকৃতি যেমন রঙ বদলায়, তেমনি বদলায় কিশোরগঞ্জের ইটনা, নিকলী, অষ্টগ্রাম, মিঠামইন উপজেলার প্লাবনভূমি হাওরের রূপও। শীতকালে যা পরিণত হয় সবুজ ঘাসে মোড়া বিস্তীর্ণ মাঠে। কিন্তু এবারের চিত্র একেবারে ভিন্ন। এবার বর্ষার আগেই হাওরের নদ-নদী, খাল-বিলে পানিপ্রবাহ প্রায় শূন্যের কোঠায়। বিশাল হাওর এখন পানির জন্য হাহাকার করছে। জানা গেছে, গত কয়েক বছরে এ অঞ্চলে এত কম পানি দেখা যায়নি। এবার বর্ষার শুরুতে জলাশয়গুলোয় পানি না থাকায় হাওরের প্রকৃতি, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে। তথ্যমতে, এখানকার ৫০টি হাওরের নদীসহ জলাশয়গুলো প্রায় পানিশূন্য। এতে হাওরের স্বাভাবিক পরিবেশ বদলে যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, এ অবস্থা চলতে থাকলে অচীরেই মরুভূমিতে পরিণত হবে জীববৈচিত্র্যর আবাস এই হাওরগুলো।
৫ মে প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এ ‘মরুভূমি হওয়ার পথে হাওর’ শীর্ষক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এই ভয়াবহ তথ্য। অথচ প্রতি বছর এ সময়টায় এই অঞ্চলের নদ-নদী, হাওর ও জলাশয়ে পানির গতিপ্রবাহ প্রবল থাকে। এই সময়টায় ঘরবাড়ি রক্ষা ও আফালের জন্য প্রস্তুতি নিতে হয়। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, পানিপ্রবাহ না থাকায় হাওরে নিচু ভূমির টিউবওয়েলগুলোতে পানি উঠছে না। জেলে পল্লীগুলোতে চলছে এক ধরনের হাহাকার। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের পাশাপাশি বর্ষা মৌসুমে নদীর উৎপত্তিস্থল থেকে জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ড্যাম তৈরির মাধ্যমে নদীর পানি আটকে দেওয়ায় প্রতি বছর হাওরে পানি কমে যাচ্ছে। এতে হাওর এলাকার বিশাল জনগোষ্ঠীর জীবনধারায় পরিবর্তন এসেছে। অভিযোগ রয়েছে, কিছু উন্নয়ন কাজও যথাযথ সমীক্ষাভিত্তিক হচ্ছে না। হাওরে বড় বড় ভাসমান সড়ক, অপরিকল্পিত ডুবো সড়ক (সাবমার্সিবিল) রোডসহ বাঁধ নির্মাণে পানিপ্রবাহ কমছে। হাওরে বর্ষায় ৯০ শতাংশ এলাকায় পানি থাকে। প্রাকৃতিক এই নিয়মে হঠাৎ বাধা পড়ায় হাওরে পানি নেই। এতে পরিবেশের ভারসাম্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ ব্যাপারে এখনই পদক্ষেপ না নিলে ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয় দেখা দিতে পারে। হাওরবাসীদের মতে, আগে এ সময়টায় পাহাড়ি ঢলের আশঙ্কায় হাওরবাসী উদ্বিগ্ন ও উৎকণ্ঠায় দিন পার করত। এবার ঢল ও বৃষ্টির দেখা নেই। ফলে হাওর যেন মরুভূমিতে রূপ নিচ্ছে। এবার গোটা হাওর ও হাওর সংলগ্ন এলাকায় মৎস্য উৎপাদন হয়নি। মৎস্যসম্পদ না থাকায় জেলেরা বেকার হয়ে বিকল্প পেশার সন্ধান করছেন। এ বছর পানি আসবে কি না, তা নিয়েও তারা সংশয়ে আছেন। আশঙ্কা করছেন, পানি কম আসায় জমিতে পলি পড়বে কম। এতে ফসল উৎপাদনও কমে যাবে।
বাংলাদেশ হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যমতে, দেশে মোট ৪১৪টি হাওর রয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের হিসাবমতে, বাংলাদেশে হাওরের সংখ্যা ৪২৩টি। এর মধ্যে সুনামগঞ্জে ১৩৩, সিলেটে ৪৩, হবিগঞ্জে ৩৮, মৌলভীবাজারে ৪, কিশোরগঞ্জে ১২২, নেত্রকোণায় ৮০ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ৩টি হাওর রয়েছে। দেশে শনির হাওর, হাইল হাওর ও হাকালুকি হাওর বিখ্যাত হাওরগুলোর মধ্যে অন্যতম। এই হাওরগুলোতে বোরো ধান চাষ করা হয়। এতে লাখ লাখ টন ধান উৎপাদন হয়। এই জমিগুলো একফসলি। এ ছাড়া দেশের চাহিদার বিশাল অংশের মাছ উৎপাদন হয় এই হাওরগুলোয়।
হাওরকে মরুভূমিতে রূপান্তরে মানবসৃষ্ট বন্দোবস্তও যেন থেমে নেই। বিভিন্ন সময়ে নানা উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের নামে হাওর অঞ্চলকে সংকুচিত করে ফেলা হয়েছে। পানি আইন ২০১৩-তে স্পষ্টভাবে বলা আছেÑ ‘জলস্রোতের স্বাভাবিক প্রবাহ বন্ধ বা উহার প্রবাহে বাধা সৃষ্টি বা উহার গতিপথ পরিবর্তন বা পরিবর্তনের চেষ্টা করিতে পারিবে না।’ বলতেই হয়, এই আইনের স্পষ্ট ব্যত্যয় ঘটছে। অনেক স্থানে মাছের প্রজনন ও লালনভূমিগুলো নষ্ট হয়ে গেছে। নির্বিচারে মৎস্য নিধন, রাসায়নিক বর্জ্য ও বিল শুকিয়ে মাছ ধরার কারণে হাওরের পরিবেশে তাত্ত্বিক পরিবর্তন ঘটেছে। প্রতি বছর নদী ও হাওরে প্রচুর পলি জমা হয়। নদী ও হাওরগুলো নানা স্থানে ভরাট হয়ে যাওয়ায় পানি ধারণ করে রাখতে পারে না। এমনিতেই হাওর অঞ্চলের মানুষের সমস্যার শেষ নেই। প্রকৃতির সঙ্গে রীতিমতো সংগ্রাম করে তাদের বেঁচে থাকতে হয়। বেশিরভাগ মানুষই গরিব। বর্ষায় নৌকা আর শুষ্ক মৌসুমে হাঁটা জীবন তাদের। অধিকাংশই কৃষিকাজ ও মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন। এই সীমিত আয় দিয়েই তাদের কষ্টের সংসার। আমরা মনে করি, যথাযথভাবে সমীক্ষা ও পরিকল্পনার মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত এবং মানবসৃষ্ট বিপর্যয় মোকাবিলা করে মরুময়তা থেকে হাওরগুলো রক্ষা করা উচিত। এজন্য দীর্ঘমেয়াদি, পরিবেশবান্ধব এবং কৃষক-জেলেদের জীবিকানির্ভর প্রকল্প গ্রহণ করা হোক। শুধু কিশোরগঞ্জের হাওর নয়, দেশের সব হাওর অঞ্চলেই যেন তা কার্যকর হয়।