সম্পাদকীয়
প্রকাশ : ০৪ মে ২০২৫ ১৬:১৬ পিএম
স্বাস্থ্যসেবায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্টরা। স্বাস্থ্য খাতের প্রাতিষ্ঠানিক প্রয়োজনেও তাদের উপস্থিতি সরব। সারা বিশ্বের উন্নত ও স্বল্পোন্নত দেশের স্বাস্থ্যকাঠামোয় ফার্মাসিস্টরা সরাসরি যুক্ত আছেন। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশে এখনও স্বাস্থ্যকাঠামোয় ফার্মাসিস্টদের সেভাবে যুক্ত করা সম্ভব হয়নি। এতে মানুষ সম্পূর্ণ স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। অথচ পূর্ণাঙ্গ স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হলে ফার্মাসিস্টদের বিকল্প নেই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুযায়ী প্রতি ২৫ শয্যার হাসপাতালের জন্য একজন করে গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট থাকা বাধ্যতামূলক। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে আমাদের দেশের হাসপাতালগুলোয় তা অনুপস্থিত। ফলে দিন শেষে নেই গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্টদের যোগ্য কর্মসংস্থান। স্বাস্থ্যসেবায় ডাক্তার, নার্স, হেলথ টেকনোলজিস্টের পাশাপাশি সঠিকভাবে ওষুধ সংরক্ষণ, রোগীর জন্য সঠিক ওষুধ ব্যবহার এবং ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নজরদারি ও প্রতিরোধে একজন দক্ষ ফার্মাসিস্টের গুরুত্ব অপরিহার্য বলে অভিমত সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের। ২ মে রাজধানীর গুলশানে বাংলাদেশ ফার্মেসি কাউন্সিল আয়োজিত এক মতবিনিময় সভায়ও বক্তারা বলেছেন, চিকিৎসক ও নার্সের পাশাপাশি একজন দক্ষ ফার্মাসিস্ট না থাকলে ‘সম্পূর্ণ স্বাস্থ্যসেবা’ সম্ভব নয়। আর রাষ্ট্রীয়ভাবে অব্যবস্থাপনা ও অবহেলার কারণে সে ঘাটতি আজও রয়ে গেছে। তারা মনে করেন, চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন সঠিকভাবে বাস্তবায়নের জন্য ফার্মাসিস্টের গুরুত্ব অপরিসীম। পরিসংখ্যান বলছে, দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে প্রতি বছর সাড়ে ৩ থেকে ৪ হাজার গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট বের হলেও তাদের ৮০ ভাগ সরাসরি ওষুধ উৎপাদনে কাজ করছেন। হাসপাতাল বা ফার্মেসিতে কাজের সুযোগ না পেয়ে দেশ ছাড়ছেন বহু ফার্মাসিস্ট। বিগত সময়ে ফার্মাসিস্টদের ওষুধ বিক্রি ও কাউন্সেলিংয়ে কাজে লাগাতে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর (ডিজিডিএ) ৬০০-এর বেশি মডেল ফার্মেসির লাইসেন্স দিয়েছে। কিন্তু নজরদারির অভাবে ৯৫ শতাংশ ফার্মেসিতে খাতা-কলমেই উপস্থিতি এদের। জানা গেছে, সারা দেশে বৈধ-অবৈধ লাখেরও বেশি ফার্মেসিতে ডিপ্লোমাধারী ও কোর্সসম্পন্ন ব্যক্তিরা চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়াই ওষুধ বিক্রি করছেন।
৩ মে প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এ ‘৬৫৪টি সরকারি হাসপাতালে একজনও ফার্মাসিস্ট নেই’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে হাসপাতালের সংখ্যা ৬৫৪টি। এসব হাসপাতালে শয্যাসংখ্যা ৫১ হাজার ৩১৬টি। এ বিশালসংখ্যক হাসপাতালে ডাক্তার, নার্স এবং স্বাস্থ্য প্রযুক্তিবিদদের উপস্থিতি থাকলেও গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্টের সংখ্যা শূন্য। অথচ স্বাস্থ্যসেবা খাতে ডাক্তার, নার্স এবং স্বাস্থ্য প্রযুক্তিবিদদের কাজ যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমন ফার্মাসিস্টদের ভূমিকা অত্যাবশ্যক। বিশেষ করে সঠিকভাবে ওষুধ সংরক্ষণ, রোগীর সঠিক ওষুধ ও ডোজ নির্ধারণ, ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া প্রতিরোধ, ফার্মাকোভিজিলেন্স কার্যক্রম পরিচালনা এসব ক্ষেত্রে ফার্মাসিস্টদের উপস্থিতি অপরিহার্য। ২০১৬ সালের জাতীয় ওষুধনীতি এবং ২০২৩ সালের ওষুধ ও কসমেটিক আইনেও পর্যায়ক্রমে সব সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে ফার্মাসিস্টদের তত্ত্বাবধানে আন্তর্বিভাগ এবং বহির্বিভাগে হসপিটাল ফার্মেসি চালু করার সুপারিশ করা হয়েছে। ফার্মাসিস্টদের উপস্থিতির গুরুত্ব বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) গাইডলাইনেও স্পষ্ট। ডব্লিউএইচও-র তথ্যানুযায়ী, একজন গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্টের ৫৫ শতাংশ কমিউনিটি ফার্মেসিতে, ৩০ শতাংশ হসপিটাল ফার্মেসিতে, ৫ শতাংশ সরকারি প্রতিষ্ঠানে, ৫ শতাংশ শিক্ষাব্যবস্থায় এবং বাকি ৫ শতাংশ ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানে কাজ করার কথা। কিন্তু বাস্তবে প্রায় ৯৫ শতাংশ ফার্মাসিস্ট বাধ্য হয়ে ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন। যা স্বাস্থ্যসেবার একটি বড় ঘাটতি সৃষ্টি করছে। ডাক্তারদের কাজ মূলত রোগ নির্ণয় করা। রোগীকে কী ওষুধ দিতে হবে, কতটুকু পরিমাণে খেতে হবে, খাবারের আগে না পরে খেতে হবে এবং ওষুধ কীভাবে কাজ করবে, এসব বিষয় একজন ফার্মাসিস্টের অধীনে থাকে। উন্নত দেশগুলোতে ফার্মাসিস্টরা প্রেসক্রিপশনও করতে পারেন, যা এখানে কল্পনার বাইরে। ২০১৮ সালের বাংলাদেশ গেজেটে পরিষ্কারভাবে মেডিকেল কলেজ এবং হাসপাতালগুলোয় গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্টের পদ সৃষ্টির বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু প্রয়োগের ক্ষেত্রে ‘কাজির গরু কেতাবে আছে গোয়ালে নেই’ অবস্থা।
উন্নত বিশ্বের হাসপাতালগুলোয় গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্টরা বহির্বিভাগ, জরুরি বিভাগসহ সব বিভাগে, এমনকি ওয়ার্ডেও চিকিৎসক ও নার্সদের সমন্বয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। অথচ ১৯৬৫ সালে ফার্মেসি শিক্ষা চালু হওয়ার পরও আজ পর্যন্ত আমাদের দেশে প্রকৃত অর্থে গ্র্যাজুয়েট হসপিটাল ফার্মাসিস্টের কার্যক্রম শুরু হয়নি। ফলে রোগীরা ওষুধ পেলেও ভুল ব্যবহার, সঠিক ডোজের অভাবসহ নানান সমস্যায় পড়ছেন। এমনকি ভুল ওষুধ সেবনের কারণে মৃত্যুর মতো ঘটনা ঘটছে, যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। আমরা ১৬০টি দেশে ওষুধ রপ্তানি করে থাকি, কিন্তু আমাদের রোগীরা উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে যান। এ বৈপরীত্য দেশের স্বাস্থ্যসেবার ভঙ্গুর অবস্থার দৃষ্টান্ত। ফার্মাসিস্টদের স্বাস্থ্যসেবা খাতে অনুপস্থিতিও এর একটি কারণ। তাই দেশের স্বাস্থ্যসেবাব্যবস্থা পুনর্গঠন করে, হাসপাতালগুলোয় পর্যাপ্তসংখ্যক ফার্মাসিস্ট নিয়োগের মাধ্যমে হসপিটাল ও ক্লিনিক্যাল ফার্মেসির ব্যবস্থা অতি দ্রুত চালু করা উচিত।
স্বীকার করতেই হবে, ব্যাপক চাহিদা থাকলেও স্বাস্থ্যসেবার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্টদের কর্মক্ষেত্র বিস্তৃত হচ্ছে না। আমরা মনে করি, এ ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষীয় উদাসীনতা অনেকাংশে দায়ী। ফলে সাধারণ মানুষ বঞ্চিত হচ্ছে পরিপূর্ণ স্বাস্থ্যসেবা থেকে। এতে দেশের ওষুধশিল্প এগিয়ে গেলেও স্বাস্থ্য খাত বিশ্বায়নের দিকে এগিয়ে যেতে পারছে না। আগামীর বিশ্বমানের বাংলাদেশ গড়তে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো চিকিৎসক, ফার্মাসিস্টসহ অন্য স্বাস্থ্যকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে স্বাস্থ্য খাতকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নেওয়াই হবে সময়ের সিদ্ধান্ত। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছা ও সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। আমরা মনে করি, ফার্মাসিস্টদের সঠিকভাবে কাজে লাগানো গেলে দেশ ও জাতি উভয়েই ব্যাপকভাবে উপকৃত হবে।