সম্পাদকীয়
প্রকাশ : ০৩ মে ২০২৫ ১৭:১১ পিএম
দেশের প্রতিটি শহর, গ্রাম ও ওয়ার্ডে এক ঠিকানায় সব ধরনের সরকারি সেবা পৌঁছে দিতে চালু হলো ‘নাগরিক সেবা’ নামে একটি নতুন সেবা আউটলেট। প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের উদ্যোগে নতুন এ সেবা কার্যক্রম শুরু হয় গত বৃহস্পতিবার। জানা গেছে, নাগরিকের সেবাগ্রহণের পদ্ধতি সহজ, সুলভ ও যুগোপযোগী করতে এবং জনভোগান্তির পাশাপাশি অনিয়ম-দুর্নীতি কমাতে এ সেবা চালু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। আরও জানা গেছে, ‘এক ঠিকানায় সকল সেবা’ স্লোগানের মাধ্যমে দেশের নাগরিকরা একই স্থান থেকে একাধিক সরকারি ও বেসরকারি সেবা গ্রহণ করতে পারবেন। চলমান ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারগুলোকেও এখানে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। বুধবার প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে পাঠানো বিজ্ঞপ্তিতে এসব তথ্য জানানো হয়। সিদ্ধান্তটি স্থানীয় সরকার সংস্থাকে শক্তিশালী করতে সরকারের আগ্রহের বহিঃপ্রকাশ তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু বাস্তবতা হলো, দেশের স্থানীয় সরকার সংস্থাগুলো প্রায় অকেজো। ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের পর ইউনিয়ন পরিষদ ছাড়া সব স্থানীয় সরকার সংস্থা তথা উপজেলা পরিষদ, জেলা পরিষদ, সিটি করপোরেশন ভেঙে দেওয়া হয়েছে। বেশিরভাগ ইউনিয়ন পরিষদের জনপ্রতিনিধিরা অনুপস্থিত বা পলাতক। চলছে প্রশাসক বা ভারপ্রাপ্ত দিয়ে। এ অবস্থায় সরকারের উদ্যোগটির গতিপথ কতদূর সে প্রশ্নটি থেকেই যায়।
১ মে প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এ ‘এক ঠিকানায় মিলবে সব নাগরিক সেবা’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নাগরিক সেবার আওতায় থাকছে নাগরিক পরিচয়পত্র, জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধনবিষয়ক আবেদন, পরিচয়পত্র সংশোধন ও পুনর্মুদ্রণ, ভূমিসংক্রান্ত তথ্য ও আবেদন, সিঙ্গেল ল্যান্ড সার্ভিস গেটওয়ে, নতুন পাসপোর্টের আবেদন, পাসপোর্ট নবায়ন, অনলাইন জিডি, আয়কর রিটার্ন আবেদন, ভ্যাট চালান জমাদান আবেদন, ট্রেড লাইসেন্স ও ট্রেড মার্ক আবেদন, বিভিন্ন সামাজিক সুরক্ষা ভাতা ও অনুদানের আবেদন, বিদ্যুৎ-পানি-গ্যাসসহ সব ইউটিলিটি, ড্রাইভিং লাইসেন্স, যানবাহন রেজিস্ট্রেশন নবায়ন, শিক্ষা-স্বাস্থ্য ও কৃষিসেবা ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ডিজিটাল সেবা।
বলা হচ্ছে, দেশের যেকোনো এলাকায় আগ্রহী উদ্যোক্তারা খুব সহজেই নাগরিক সেবা এজেন্ট হিসেবে নিবন্ধন করতে পারবেন। এর জন্য নাগরিক সেবা ওয়েবসাইটে গিয়ে অনলাইন আবেদন ফরম পূরণ করলেই হবে। আবেদনপ্রক্রিয়া দ্রুত, সহজ এবং সম্পূর্ণ ডিজিটাল। এ ক্ষেত্রে নাগরিক সেবা ইউজার ইন্টারফেস হিসেবে একটি সিঙ্গেল সার্ভিস পোর্টাল বা ওয়েবসাইট তৈরি করবে এবং সঙ্গে সঙ্গে থাকবে সুপার অ্যাপ। এই পোর্টাল ও ওয়েবে থাকবে সব সেবার সিঙ্গেল গেটওয়ে, বিলিং অ্যাগ্রিগেটর এবং পেমেন্ট গেটওয়ে। উল্লেখ্য, নাগরিক সেবা কেন্দ্রে আবেদনের পরে নাগরিকের ‘প্রিন্টেড পেপার’ নিয়ে কোনো সরকারি বা আধাসরকারি অফিসে যেতে হবে না। বরং সেবাকেন্দ্রের সাইট থেকে অনলাইনে জমা দেওয়া অবেদন সরাসরি ট্র্যাকিং নম্বরসহ সংশ্লিষ্ট অফিসে পৌঁছে দেওয়া হবে। প্রস্তাবিত ডেটা গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ইন্টার-অপারেবিলিটি অথরিটি তথ্য লেনদেনের মান, উপযোগিতা, গোপনীয়তা এবং সাইবার সিকিউরিটি দেখভাল করবে। শুরুতে প্রায় ১০০ সেবা দিয়ে এ কার্যক্রম শুরু হবে জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব। তিনি আরও জানান, ন্যাশনাল ইন্টার-অপারেবিলিটি ফ্রেমওয়ার্ক এবং ডেটা গভর্ন্যান্স কাঠামো গঠন ও কার্যকরের পাশাপাশি এ উদ্যোগে ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশনে গতি বাড়বে। একই সঙ্গে সেবাসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাবে; যা স্বাধীন উদ্যোক্তাদের মাধ্যমে নাগরিক সেবা কেন্দ্র পৌঁছে যাবে বাংলাদেশের সব শহরে, সব গ্রামে এবং প্রান্তিক জনপদে।
আসলে নাগরিক সেবার বেশিরভাগ কার্যক্রমই পরিচালিত হয় স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অধীনে সিটি করপোরেশন, জেলা, উপজেলা, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদের মাধ্যমে; যা পরিচালনা করেন মূলত জনপ্রতিনিধিরা। এক কথায় সরকারের নাগরিক সেবার আওতায় প্রস্তাবিত প্রায় সব কাজই করে থাকেন জনপ্রতিনিধিরা। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বর্তমানে এর সবকিছুই চলছে জোড়াতালি দিয়ে। সহজ করে বললে পুরো প্রক্রিয়াটি এখন জটিল হয়ে পড়েছে। সেবাপ্রার্থীদের বেড়েছে নিত্য ভোগান্তি। উল্লেখ করতেই হয়, চট্টগ্রাম ছাড়া বাকি সব সিটি করপোরেশন চলছে প্রশাসক দ্বারা। এ সিটি করপোরেশনে মেয়র থাকলেও কাউন্সিলর নেই। দেশের ইউনিয়ন পরিষদগুলোও চলছে প্রশাসক বা ভারপ্রাপ্ত দিয়ে। এ কথা সত্য, অতীতে প্রতিটি রাজনৈতিক সরকারই স্থানীয় সরকার সংস্থাগুলোকে ‘দলীয় অফিসে’ পরিণত করেছিল। এ অবস্থার অবসান যেমন জরুরি, তেমনি বিকল্প বিষয়টিও ভাবতে হবে। তবে নির্বাচন যত দিন না হয়, অন্তর্বর্তী সরকারকে অন্তর্বর্তী সমাধানের উপায় খুঁজতে হবে। যাতে সেবাপ্রার্থীদের দুর্ভোগ কমে। নাগরিক সেবার সহজ পথ খুঁজলেই হবে না, তা সহজভাবে পরিচালনেরও সুব্যবস্থা চাই।
সরকারের এ উদ্যোগকে আমরা স্বাগত জানাই। আমরা এর সাফল্যও কামনা করি। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না আমরা একটা ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছি। তাই সেবাপ্রার্থী নাগরিকের কোনো ধরনের ভোগান্তি গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। সরকারের কাজ হবে লোকবলের সংকট সাময়িক হলেও তা দূর করে প্রস্তাবিত নাগরিক সেবা দ্রুততম সময়ের মধ্যে নিশ্চিত করা। আমরা চাই, নাগরিক সেবা ভোগান্তির দ্রুত অবসান হোক।