সড়কে মৃত্যু
সাহাদাৎ রানা
প্রকাশ : ২৯ এপ্রিল ২০২৫ ১৭:০০ পিএম
গত ঈদুল ফিতরে দেশের সড়ক-মহাসড়কে ৩১৫টি দুর্ঘটনায় ৩২২ জন নিহত ও ৮২৬ জন আহত হয়েছে। সম্প্রতি এসব তথ্য প্রকাশ করেছে যাত্রী কল্যাণ সমিতি। শুধু ঈদুল ফিতর নয়, প্রায় প্রতিদিনই সড়কে বাড়ছে দুর্ঘটনা। বাড়ছে দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা। ঘুরেফিরে বারবার আসছে একটি প্রশ্ন- সড়কে কবে ফিরবে শৃঙ্খলা? দেশে সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা বৃদ্ধি পায় আর প্রতিবারই এমন প্রশ্নটি সামনে চলে আসে। বাস্তব অর্থে সমাধান আর হয় না। সড়কে শৃঙ্খলার বিষয়টিকে সামনে রেখে সমাধানের বিষয়েও ব্যাপক আলোচনা হয়। নতুন নতুন আইন হয়। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না।
এবার একটু পেছন ফিরে তাকানো যাক। ২০১৯ সালের ১ নভেম্বর বহুল আলোচিত সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ কার্যকর হয়। যে আইনে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানির দায়ে সর্বোচ্চ পাঁচ বছর শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ‘দণ্ডবিধির ৩০৪-বি ধারায় যা-ই থাকুক না কেন, কোনো ব্যক্তির বেপরোয়া বা অবহেলাজনিত মোটরযান চালনার কারণে সংঘটিত কোনো দুর্ঘটনায় কোনো ব্যক্তি গুরুতরভাবে আহত বা নিহত হলে চালক সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ৫ লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবে’। একই সঙ্গে এটি জামিন-অযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হবে। আইনে পেশাদার-অপেশাদার চালকের ড্রাইভিং লাইসেন্স না থাকলে অনধিক ছয় মাসের জেল বা ৫০ হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ড দেওয়ারও বিধান রাখা হয়েছে। এ ছাড়া আরও বেশ কিছু জরিমানার নতুন বিধানও যুক্ত হয়েছে। বিশেষ করে মদ পান করে বা নেশাজাতীয় দ্রব্য খেয়ে গাড়ি চালালে, সহকারীকে দিয়ে গাড়ি চালালে, উল্টো দিকে গাড়ি চালালে, নির্ধারিত স্থান ছাড়া অন্য স্থানে গাড়ি থামিয়ে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি, চালক ছাড়া মোটরসাইকেলে একজনের বেশি সহযাত্রী ওঠালে, মোটরসাইকেলের চালক ও সহযাত্রীর হেলমেট না থাকলে, ছাদে যাত্রী বা পণ্য বহন, সড়ক বা ফুটপাতে গাড়ি সারানোর নামে যানবাহন রেখে পথচারীদের চলাচলে বাধা সৃষ্টি, ফুটপাতের ওপর দিয়ে কোনো মোটরযান চলাচল করলে সর্বোচ্চ তিন মাস কারাদণ্ড বা ৩৫ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের প্রস্তাব করা হয়েছে।
দীর্ঘ ছয় বছর ধরে আইন হলেও বাস্তবে এর কোনো কার্যকারিতা নেই। এখন প্রশ্ন হলো, সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ কি শুধু কাগজপত্রের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে, নাকি কার্যক্ষেত্রে যথাযথ প্রয়োগ হবে? সাম্প্রতিক সময়ে সড়কে মৃত্যুর সংখ্যা বৃদ্ধি আইন যথাযথ কার্যকর হয়েছে তা প্রমাণ করে না। দেশে সড়কে নিরাপত্তা সময়ের সবচেয়ে আলোচিত বিষয়গুলোর একটি। প্রায় দুই দশক ধরে বারবার আলোচিত হলেও এর সমাধান যেন আমাদের কাছে সব সময় সুদূর অতীত। দেশে নিত্যদিনের যাত্রায় মানুষের নির্ভরতা সড়কপথেই বেশি। দেশের প্রধান যোগাযোগমাধ্যমও সড়কপথ। কিন্তু সে সড়কপথ অনিরাপদ। যাত্রীপরিবহন থেকে শুরু করে পণ্য পরিবহন সব ক্ষেত্রে সড়কপথের গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি। তাই সড়কপথে সবচেয়ে বেশি শৃঙ্খলা ও নিরাপদ থাকবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু দেশে বাস্তব চিত্র যেন উল্টো। সড়কপথে নিরাপত্তা নেই, নেই শৃঙ্খলা। এর প্রভাবে সড়কে প্রতিদিনই বাড়ছে মৃত্যু। দেশে প্রায় প্রতিদিন সড়কে প্রাণহানি ঘটছে এবং এর সংখ্যা দিনদিন বাড়ছে। বিভিন্ন সংস্থার জরিপ অনুযায়ী প্রতি বছর সড়ক দুর্ঘটনায় এ দেশে ৭ থেকে ৮ হাজারের বেশি মানুষ মারা যায়। অর্থাৎ গড়ে প্রতিদিন সারা দেশে প্রায় ১৭ জনের প্রাণহানি ঘটে সড়ক দুর্ঘটনায়। কারও কারও মতে অবশ্য সংখ্যাটা আরও বেশি। তবে শঙ্কার জায়গা হলো দিনদিন এর সংখ্যা শুধুই বাড়ছে।
তবে বিভিন্ন সংস্থার জড়িপে মৃতের সংখ্যা নিয়ে তারতম্য থাকলেও এটা সত্যি, সড়ক দুর্ঘটনার কারণে দেশজ উৎপাদনে ব্যাপকভাবে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতি বছর সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতের বেশিরভাগই শিশু, তরুণ ও কর্মক্ষম ব্যক্তি। বিশেষ করে তরুণ ও কর্মক্ষম এ দুই শ্রেণিকে দেশের ভবিষ্যৎ ও অর্থনীতির মূল শক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তাদের মধ্যে ৬০ ভাগের চেয়ে বেশি মানুষই কর্মক্ষম। যাদের বয়স ২০ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে। পরিবার এসব কর্মক্ষম মানুষকে হারিয়ে অনেকটা দিশাহারা হয়ে পড়ে। তাদের মৃত্যুর কারণে পুরো পরিবারে দেখা দেয় অনিশ্চয়তা। শুধু পরিবার নয়, তাদের হারিয়ে দেশও হয় ক্ষতিগ্রস্ত। কর্মক্ষম মানুষ যেমন পরিবারের জন্য সম্পদ, তেমন দেশেরও। সড়ক দুর্ঘটনা এবং এর প্রভাবে ক্ষয়ক্ষতির আর্থিক পরিমাণের অঙ্কটাও নেহাত কম নয়। কারণ যারা অকালে প্রাণ হারাচ্ছে তারা তাদের নিজের কর্মটা দেশকে আর দিতে পারে না। ফলে দেশের অর্থনীতিতে পড়ে নেতিবাচক প্রভাব। সড়ক দুর্ঘটনার কারণে বছরে কয়েক হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে অনেকটা নীরবে; যা নিয়ে সেভাবে কেউ ভেবে দেখেন না। অথচ বিষয়টা নিয়ে ভাবার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।
বাস্তবতা হলো, সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে শুধু আইন কার্যকর করলেই হবে না, পাশাপাশি কিছু উদ্যোগও নিতে হবে। এ দেশে সড়ক দুর্ঘটনার পেছনে অনেক কারণ রয়েছে। সড়ক দুর্ঘটনার মূল কারণ সড়কে চলাচলের পরিবেশ, অদক্ষ চালক, ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন, চালকের অসর্তকতা, সড়ক নির্মাণে প্রকৌশলগত ত্রুটি, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও অধীন সংস্থার মধ্যে দায়িত্ব পালনে অনীহা, যানবাহন ও সড়ক ব্যবহারকারী তথা চালক, যাত্রী, পথচারীসহ সবার অসচেতনতা, সড়কের পাশে বসবাসরত জনগণের অসচেতনতার বিষয়গুলো প্রধান। এ ছাড়া দেখা যায় দেশের সব মহানগরে যত পথচারী সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়, তার দ্বিগুণের বেশি মারা যায় শুধু ঢাকা মহানগরীতে। এর পেছনেও রয়েছে অনেক কারণ। প্রধান কারণ ঢাকায় মানুষ ও যানবাহন দুটোর সংখ্যাই বেশি। পাশাপাশি সব স্থানে জেব্রা ক্রসিং না থাকা, ফুটপাত না থাকা কিংবা অবৈধ দখলে চলে যাওয়া, স্বয়ংক্রিয় সংকেতব্যবস্থার অনুপস্থিতি, পথচারী পারাপারে অব্যবস্থাপনাও অন্যতম প্রকৌশলগত ত্রুটি সড়ক দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে। এসব কারণে মূলত প্রতিদিন সড়কে ঘটছে দুর্ঘটনা। এখন প্রশ্ন হলোÑ এ থেকে উত্তরণের কি কোনো উপায় নেই? উত্তরণ সম্ভব। তবে সবার আগে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে আন্তরিক হতে হবে এ ক্ষেত্রে। সর্বোপরি আইনের প্রয়োগ সবার আগে জরুরি। যদি খামখেয়ালির কারণে দুর্ঘটনায় মানুষ মারার অপরাধে চালকের শাস্তি হয় তবে সব চালকের মধ্যে কাজ করবে ভয়। তখন সব চালক গাড়ি সাবধানে চালাতে বাধ্য হবেন। খামখেয়ালির প্রবণতাও কমে যাবে। কমবে সড়ক দুর্ঘটনাও। এ ছাড়া আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রয়েছে সেটা চালকদের ডোপ টেস্ট। কারণ অভিযোগ রয়েছে অনেক চালক নেশা করে গাড়ি চালান। এখন যদি চালকদের ডোপ টেস্টের আওতায় আনা সম্ভব হয় তবে অনেকাংশে সড়ক দুর্ঘটনা কমিয়ে আনা যাবে।
সড়ক দুর্ঘটনার কারণে বছরে কয়েক হাজার কোটি টাকার ক্ষতি আমাদের মতো দেশের জন্য সত্যিই অস্বস্তির খবর; যা মেনে নেওয়ার নয়। কিন্তু তা-ই যেন আমরা মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছি। দুর্ঘটনায় জনসাধারণেরও অনেকটা দায় রয়েছে। আমরাও অনেক সময় ট্রাফিক আইন মানি না। তাই জনগণের মধ্যেও সচেতনতা আসতে হবে। সরকারের একার পক্ষে সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। সবাইকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে সড়ক দুর্ঘটনা রোধে যথাযথ ভূমিকা রাখতে হবে। তবে এও সত্য, এ ক্ষেত্রে সবার আগে এগিয়ে আসতে হবে সরকার, মালিক ও শ্রমিকদের। সবার আন্তরিকতায় সম্ভব দেশব্যাপী নিরাপদ সড়কপথ গড়ে তোলা।