অর্থনীতি
ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী
প্রকাশ : ২৯ এপ্রিল ২০২৫ ১৬:৫৭ পিএম
ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী
টালমাটাল বৈশ্বিক অর্থনৈতিক দুরবস্থায় বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম প্রধান উৎস রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয় গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হিসেবে প্রতিভাত। আত্মকর্মসংস্থান, অধিক বেতন, উন্নত কর্মপরিবেশে জীবনযাপনের লক্ষ্যে দেশ থেকে প্রতি বছর বিপুলসংখ্যক মানুষ বিদেশে পাড়ি জমান। তারা হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে রেমিট্যান্স পাঠিয়ে দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রেখে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ উত্তরোত্তর সমৃদ্ধ করছেন। প্রবাসীদের অতি কষ্টার্জিত রেমিট্যান্সের ওপর ভর করে দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নসহ মজবুত হয়েছে অর্থনীতির ভিত। দেশের শিল্পোন্নয়ন, জাতীয় উৎপাদন-বিনিয়োগ বৃদ্ধি, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অজর্নসহ বৈদেশিক নির্ভরশীলতা হ্রাসে রেমিট্যান্সের অবদান অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। অর্থনীতির পাশাপাশি জনজীবনের মানোন্নয়নে এর ভূমিকা অনস্বীকার্য। দেশের জিডিপিতে ৬ থেকে ৭ শতাংশ অবদান রাখা এ রেমিট্যান্স পরিণত হয়েছে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের উল্লেখযোগ্য অংশীদারে। দেশের বাজেটের প্রায় এক তৃতীয়াংশ জোগান দেয় রেমিট্যান্স। করোনাকালে অর্থনীতিতেও সমধিক উচ্চকিত ছিল এ প্রবাসী আয়। দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আহরণের প্রধান উৎস রপ্তানি খাত হলেও রেমিট্যান্স আয়ই সবচেয়ে বেশি কার্যকর বলে অর্থনীতিবিদদের ধারণা। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে রেমিট্যান্স প্রবাহের নবতর অধ্যায় নির্মিত হয়েছে।
অন্তর্বর্তী সরকার প্রবাসীদের পাঠানো টাকায় গত আট মাসে বিভিন্ন দেনা পরিশোধ করতে সক্ষম হয়েছে। বিগত সরকারের রেখে যাওয়া বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতে এলএনজি ও তেলের বকেয়া ৩ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার ৬০০ মিলিয়নে নেমে এসেছে। সর্বশেষ প্রধান উপদেষ্টার কাতার সফরের আগে দেশটি থেকে আমদানি করা এলএনজি বাবদ পাওনা ২৫৪ মিলিয়ন ডলার পরিশোধ করা হয়েছে। প্রাসঙ্গিকতায় কাতারে বাংলাদেশ কমিউনিটির সদস্যদের সঙ্গে আয়োজিত মতবিনিময় সভায় প্রধান উপদেষ্টা দেশের জন্য প্রবাসী বাংলাদেশিদের গুরুত্বপূর্ণ অবদানের ভূয়সী প্রশংসা করেন। তিনি বলেন, ‘আপনারা বড় রকমের সহযোগিতা করেছেন, বিশেষ করে এ বিপদের দিনে আপনারা না থাকলে বাংলাদেশ সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারত না। আপনারাই তাকে শক্ত করে রেখেছেন এ পর্যন্ত।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমাকে কাতারের এনার্জি মিনিস্টার ধন্যবাদ জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন ওরা এত তাড়াতাড়ি টাকা পরিশোধ করবে, এটা আমরা আশা করিনি। এটা আপনাদের সহায়তার জন্য সম্ভব হয়েছে। আপনাদের অসংখ্য ধন্যবাদ দেশের পক্ষ থেকে, জাতির পক্ষ থেকে।’
আমাদের সবার জানা, ছাত্র-জনতার অভাবনীয় অভ্যুত্থানের সময় রেমিট্যান্স যোদ্ধারা ছিলেন অত্যন্ত সক্রিয়। প্রচণ্ড পরিশ্রমে উপার্জিত অর্থ দেশে না পাঠানোর জন্য তাদের আহ্বান ছিল যুগান্তকারী। ছাত্রদের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে দমনপীড়নের প্রতিবাদে বিগত সরকারের প্রতি অনাস্থা প্রকাশ করেন প্রবাসীরা। তারা বৈধ পথে রেমিট্যান্স না পাঠিয়ে হুন্ডিতে পাঠানোর ঘোষণা দেন। মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ, আমেরিকার কয়েকটি দেশে ছাত্রদের আন্দোলনের প্রতি সংহতি জানিয়ে প্রবাসীরা সমাবেশ ও বিক্ষোভ প্রদর্শনে সোচ্চার ছিলেন। বিক্ষোভের অভিযোগে সংযুক্ত আরব আমিরাতে ৫৭ বাংলাদেশিকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়ার বিষয়টিও রেমিট্যান্সে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রচিত হয়েছিল। ফলে রেমিট্যান্স প্রবাহের নিম্নগতি পরিলক্ষিত হয়। গণমাধ্যম সূত্রমতে, ২৪ জুলাই পর্যন্ত দেশে রেমিট্যান্স আসে মাত্র ১৫০ কোটি ডলার। এর মধ্যে প্রথম ১৩ দিনে এসেছিল প্রায় ৯৮ কোটি এবং ১৪ থেকে ২৪ জুলাই পর্যন্ত এসেছে প্রায় ৫৩ কোটি ডলার। ধারাবাহিকতায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণও কমতে থাকে। সফলতার সঙ্গে বিগত সরকারের পতন ঘটিয়ে নতুন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় এদের ভূমিকা ছিল প্রশংসনীয়।
দেশে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হলে নতুন সরকারকে শক্তিশালী করতে প্রবাসীরা আরও বেশি রেমিট্যান্স পাঠানোর ঘোষণা দেন। রেমিট্যান্স যোদ্ধারা অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়ে অবৈধ হুন্ডি প্রথা অবজ্ঞা করে তাদের কষ্টার্জিত অর্থ বিভিন্ন বৈধ চ্যানেলে সরাসরি দেশে পাঠান। দেশ গঠনে বৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠানোর বিষয়ে অনেক প্রবাসী ক্যাম্পেইন শুরু করেন। এর ফলে আবারও প্রবাসী আয় বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর ২০২৪-২৫ অর্থবছরের আগস্ট থেকে ধারাবাহিকভাবে রেমিট্যান্স প্রবাহ ২ বিলিয়ন ডলারের ওপরে রয়েছে। আগস্ট ২০২৪ থেকে ফেব্রুয়ারি ২০২৫ পর্যন্ত প্রতি মাসে আসা রেমিট্যান্সের পরিমাণ যথাক্রমে ২.২২, ২.৪০, ২.৩৯, ২.২০, ২.৬৪, ২.১৯ ও ২.৫৩ বিলিয়ন ডলার। মার্চে আসে দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স। যার পরিমাণ ৩ দশমিক ২৯ বিলিয়ন ডলার। চলতি এপ্রিলের ২১ দিনে এসেছে ১ দশমিক ৯৭ বিলিয়ন ডলার; যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৪০ দশমিক ৭ শতাংশ বেশি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, মধ্যপ্রাচ্য ও পশ্চিমের সেরা ১০টি দেশ থেকে আসা রেমিট্যান্সের পরিমাণ ৮৮ দশমিক ৫২ শতাংশ। আরও ১৫টি দেশ থেকে আসে ১০ শতাংশ এবং অন্য দেশগুলো থেকে আসে ২ শতাংশ রেমিট্যান্স। রেমিট্যান্স আসা শীর্ষ দেশগুলো হচ্ছে আরব আমিরাত, যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরব, যুক্তরাজ্য, মালয়েশিয়া, ওমান, কুয়েত, ইতালি, কাতার ও সিঙ্গাপুর। মধ্যপ্রাচ্যের দেশসমূহের মধ্যে সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স পাঠান সৌদি আরবের প্রবাসীরা। দেশটিতে সবচেয়ে বেশি প্রবাসী থাকলেও ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরে হুন্ডির মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠানোর প্রবণতা বেশি হওয়ায় বর্তমানে সৌদি আরব ৩ নম্বর অবস্থানে চলে আসে। রেমিট্যান্স প্রেরণে শীর্ষস্থানে উঠে আসে মধ্যপ্রাচ্যের আরেক দেশ আরব আমিরাত। যুক্তরাষ্ট্রের প্রবাসীরা রয়েছেন দ্বিতীয় স্থানে। জনশক্তি রপ্তানি ব্যুরোর তথ্যমতে সৌদি আরবে বাংলাদেশি কর্মী নিয়োগে কোটা বৃদ্ধি এবং মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার পুনরায় খুলে দেওয়ার ফলে ২০২৩ সালে বাংলাদেশ আগের বছরের তুলনায় ১৫ শতাংশ বেশি জনশক্তি রপ্তানি করেছে। উল্লেখ্য সময়ে বিশ্বের ১৬৮ দেশে বাংলাদেশের ১৩ লাখ কর্মীর কর্মসংস্থান হয়েছে। আগের বছরে এ সংখ্যা ছিল ১১ লাখ ৩৫ হাজার।
সরকারসংশ্লিষ্টদের মন্তব্য, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর নানান কারণে রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়েছে। এর মধ্যে ডলারের দাম বৃদ্ধি অন্যতম। রেমিট্যান্সের বিপরীতে সরকারি খাতের আড়াই শতাংশ এবং ব্যাংকগুলোর নিজস্ব উৎস থেকে আড়াই শতাংশÑ এ মোট ৫ শতাংশ প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে। বিগত সরকারের সময়ে হুন্ডির মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠানোর প্রবণতা বাড়লেও বর্তমানে তা কমেছে। মূলত এসব কারণে রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধি পেয়েছে। রেমিট্যান্স প্রবাহের ইতিবাচক ধারা অব্যাহত থাকায় বেড়েছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। ২০ এপ্রিল গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যানুসারে, ১৭ এপ্রিল পর্যন্ত দেশে মোট রিজার্ভের পরিমাণ ২৬ দশমিক ৭৩ বিলিয়ন ডলার। তবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাবপদ্ধতি বিপিএম-৬ অনুযায়ী রিজার্ভের পরিমাণ ২১ দশমিক ৩৯ বিলিয়ন ডলার।
দুঃখজনক হলেও সত্য, এ ধরিত্রীর বিভিন্ন দেশে অক্লান্ত পরিশ্রম করে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে অর্জিত অর্থ-রেমিট্যান্স যারা দেশে পাঠাচ্ছেন তাদের দেশে ও বিদেশে বিভিন্ন হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। তাদের প্রতি বিদেশে বাংলাদেশি দূতাবাসগুলোর অসহযোগিতা-অভিযোগের অন্ত নেই। দালালের দৌরাত্ম্য, পাসপোর্ট জটিলতা, কর্মপরিবেশ ও নিরাপত্তা নিয়ে অস্বস্তিকর পরিবেশ নতুন কোনো বিষয় না হলেও তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মৃত্যুর পর প্রবাসীদের প্রতি অবহেলাও। প্রবাসীদের অস্বাভাবিক মৃত্যু বৃদ্ধি পেলেও তা প্রতিরোধে বা ঘটনা তদন্তে উদ্যোগী নয় দূতাবাসগুলো।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন প্রতিবেদন অনুসারে সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স প্রেরণকারী মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমিকরা দেশে অধিকতর নিগৃহীত হচ্ছেন। বিমানবন্দরে নেমেই তারা অরাজক আচরণ-ভোগান্তিতে নিপতিত হন। অভিবাসন খাতের বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিটের (বামারু) প্রতিবেদনেও প্রবাসী কর্মীদের নানান দুর্দশার চিত্র উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে উপস্থাপিত তথ্যমতে উপসাগরীয় দেশগুলোতেই বেশি মৃত্যু হচ্ছে প্রবাসী কর্মীদের। বিদেশের মাটিতে অনেক প্রবাসীর দাফন হচ্ছে। কিন্তু এসব মৃত্যুর কারণ নিয়েও কখনও অনুসন্ধান করেনি মন্ত্রণালয়। মৃত্যুসনদে গণহারে ‘স্বাভাবিক মৃত্যু’ বা ‘হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধে মৃত্যু’ লিখে দেওয়ায় অর্ধেকের বেশি মৃত্যুর কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। এতসব উত্থাপিত অভিযোগ সংশ্লিষ্ট মহলের আমলে নেওয়া জরুরি। এ ছাড়া বিপুলসংখ্যক প্রবাসী সর্বস্ব হারিয়ে, পুলিশের হাতে আটক হয়ে শূন্য হাতে এক প্রকার ব্যর্থ হয়ে দেশে ফেরার দৃষ্টান্তও অনেক।
অভিবাসন খাত বিশেষজ্ঞদের দাবি, যে ধরনের কাজে বাংলাদেশি কর্মীরা বিদেশে যাচ্ছেন, সেসব কাজের জন্য অন্যান্য দেশ থেকে দক্ষ কর্মীরা যাচ্ছেন। তাই বিদেশের কর্মক্ষেত্রে বাংলাদেশের কর্মীদের চাহিদা কমছে। এ ক্ষেত্রে এটি সুস্পষ্ট যে রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের অধিকতর অনুপ্রাণিত করার জন্য প্রচলিত সুবিধাদি পর্যাপ্ত নয়। তাদের দেশে থাকা মা-বাবা, স্ত্রী-সন্তানসন্ততিসহ পরিবার-পরিজনদের জন্য শিক্ষা-স্বাস্থ্য-পর্যটন-ব্যাংক-বীমাসহ সরকারি-বেসরকারি সেবা খাতসমূহে কৌশলগত পরিকল্পনা গ্রহণ করে সুবিধাদির সুযোগ বৃদ্ধি করতে হবে। অন্যথায় বৈধ পথে নয়; বরং অবৈধ পথে বা হুন্ডি ও টাকা পাচারের কদর্য পন্থায় তাদের সৎ উদ্যোগ ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার সমূহ আশঙ্কা প্রবল। মোদ্দা কথা, প্রবাসীদের জন্য যত বেশি সুযোগসুবিধা বাড়ানো হবে দেশে তত বেশি রেমিট্যান্স আসবে। আর রেমিট্যান্স প্রবাহ সচল থাকলে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সমৃদ্ধিতে সহায়ক হবে। রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের অনুপ্রাণিত করার লক্ষ্যে নানামুখী উদ্যোগ নেওয়া একান্ত জরুরি। দেশে তাদের পরিবার-পরিজনের সুবিধার্থে নানান ক্ষেত্রে অধিকতর পদক্ষেপ গ্রহণ প্রত্যাশিত।