সংস্কৃতি
রহমান মৃধা
প্রকাশ : ২৭ এপ্রিল ২০২৫ ১৬:১২ পিএম
রহমান মৃধা
দেশ এবং ভাষা একে অন্যের সঙ্গে গভীরভাবে গাঁথা, যেন দুই প্রাচীন রেশমি সুতা এক সুতায় বাঁধা। বাংলা ভাষা, এ মাটি, এ জনগণের অভ্যন্তরীণ আত্মা- এগুলো সবই একযোগে জড়িয়ে থাকে, যেখানে একে অন্যের মধ্যে কোনো বিভেদ নেই। এ দেশের মানুষ যে ভাষায় কথা বলে, যে সংস্কৃতির মধ্যে বেড়ে ওঠে সে ভাষা ও সংস্কৃতি তার অস্তিত্বের অঙ্গ। প্রকৃতি ও সংস্কৃতি একে অন্যের পরিপূরক। পহেলা বৈশাখ কিংবা বৈশাখ মাসটি আমাদের ক্যালেন্ডারের একটি নতুন পৃষ্ঠা নয়, বরং এটি আমাদের চারপাশের প্রকৃতির এক অনবদ্য রূপ। ঝোড়ো হাওয়ার মধ্যে বৈশাখী বৃষ্টি এসে প্রকৃতির গা ভিজিয়ে দেয়, যেমন আমাদের হৃদয়ের গভীরে বয়ে আনে এক নতুন আনন্দের তরঙ্গ। বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে মিষ্টি গন্ধ। কলমি শাক, পাটুলি ফুল, পলাশের রঙে মোড়া নববর্ষের ফুল। এ দিনটি যেন প্রকৃতির নিজস্ব এক শ্রদ্ধাঞ্জলি, যে ফুলগুলো শোভা পায় আমাদের ছোটবড়, শহর-বাংলাদেশের প্রতিটি কোনায়।
গ্রামের পলিতে কিংবা শহরের কোনো পার্কে বৈশাখের এ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য যেন বাড়িয়ে দেয় আনন্দের অনুভূতি। পুরোনো বাংলার গ্রামের প্রান্তরে পাকা ফসলের সুবাস, সেই প্রাচীন ঝিলগুলোর শান্ত জল, খালি মাঠে এক অপূর্ব প্রাকৃতিক দৃশ্যÑ এগুলো শুধু চোখে নয়, আমাদের মনে প্রতিধ্বনিত হয়। বৈশাখের প্রতিটি মুহূর্ত প্রকৃতি নিজ হাতে আমাদের জন্য সাজিয়ে রেখেছে।
সারা দেশের মানুষের আনন্দে মেতে ওঠা, গ্রামীণ পরিবেশে গুচ্ছগুচ্ছ পটোল, কাঁচকলা, কচুরিপানা এসব প্রকৃতির উপাদান, একে অন্যকে সহযোগিতা করে নতুন বছরের দারুণ সূচনা করতে। বৈশাখী বাতাস, মাটির গন্ধ এবং নতুন জীবনের এক সতেজ শ্বাস এ উপাদানগুলো একত্র হয়ে বৈশাখ একটি নয়া দিগন্তের সূচনা, যেখানে প্রকৃতি এবং সংস্কৃতি হাতে হাত রেখে একত্রে উদ্যাপন করে।
ভোরবেলা, যখন প্রথম সূর্য ওঠে, রাস্তায় রাস্তায় মানুষের পদচারণ শুরু হয়। শহরের বাজারে, ফুলের দোকানে ভিড় জমে যায়। প্রতিটি দোকানে সাজানো থাকে নানা রঙের ফুল। গোলাপের লাল, গাঁদার হলুদ, শাপলার সাদা, আর পলাশের তীব্র কমলা রঙের ফুলের গুচ্ছ, যেন প্রকৃতির নিজস্ব শুভেচ্ছা। সেখানে একেকটি ছোটগল্প প্রতিধ্বনিত হয়, এক বিক্রেতা তার দোকানে সাজানো ফুলগুলো তুলে তুলে বিক্রি করছেন, আর এক বৃদ্ধা আনন্দের সঙ্গে একটি ছোট পুতুলের ফুল কেনেন, যেন পুরোনো দিনের রঙিন স্মৃতি ফিরে পাচ্ছেন।
গ্রামের সরু পথে, হালকা রোদে, লাল-সাদা শাড়ি পরা মেয়েরা চমক দিয়ে হেঁটে যায়, তাদের গায়ে ফুলের মালা, হাতে সজাগ চুড়ি, মুখে হাসিÑ বৈশাখের আনন্দের প্রতীক। ছোট ছেলেমেয়ে, তারা ঝরে পড়া পাতা ও ফুলের সঙ্গে খেলছে, মুখে মিষ্টি খাবারের খুশিহাসি, যেন পুরো গ্রামটি এক নতুন রঙে রাঙানো। পথে, গ্রামের পুকুরে, নৌকায় চড়ে মাঝির গান শুনতে পাওয়া যায়, সেই গান যা বাঙালি ঐতিহ্যের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ, একটি দৃশ্য যা শুধু বাঙালির কাছে নয়, সারা বিশ্বে নস্টালজিয়া তৈরি করে।
আর শহরের বড় পার্ক, রমনা বটতলায়, যেখানে হাজার হাজার মানুষের ভিড়। উজ্জ্বল রঙের পাঞ্জাবি ও শাড়ি পরিহিত মানুষ একসঙ্গে দাঁড়িয়ে সুর মেলাচ্ছে, সবাই যেন একসঙ্গে গাইছেÑ ‘এসো হে বৈশাখ এসো এসো…’। এ যেন এক উত্সব, এক সমবেত সংগীত, যেখানে সবার হৃদয় একসঙ্গে মিলছে। বটগাছের নিচে, পুরোনো দারুণ ঐতিহ্যের গুনগুন, আর চিরন্তন প্রাকৃতিক সুরের মাঝে, পহেলা বৈশাখকে অভ্যর্থনা জানাতে সবাই মিলিত। এটি একটি মুহূর্ত, যেখানে অতীত ও বর্তমান একসঙ্গে মিশে যায়, যেখানে প্রতিটি সুর, প্রতিটি ফুল, প্রতিটি হাসি এক নতুন কাহিনী রচনা করে। বৈশাখের দিনগুলো আমাদের জীবনে সেই সোনালি দিনগুলোর কথা মনে করিয়ে দেয়।
বাংলা নববর্ষের উৎসবটি শুধু একটি রাতের অনুষ্ঠান নয়, এটি একটি পুরো দিনের, পুরো মাসের, পুরো সমাজের একটি অনন্য ঐতিহ্য। এখানে দিন শুরু হয় প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সঙ্গে, যেখানে সূর্যোদয়ের সঙ্গে এক অনাবিল শান্তির পরিবেশ সৃষ্টি হয়।
ভারতেও নানা অঞ্চলে নববর্ষ উদ্যাপন করা হয়, যেমন বাংলা নববর্ষ, পাঞ্জাবের বৈশাখী এবং গুজরাটের উত্তরায়ণ। যদিও এগুলোর মধ্যে সাদৃশ্য রয়েছে। ফসল কাটার সময়, কৃষকের জীবনের শুরু; তবে প্রতিটি অঞ্চলের নববর্ষের রীতি, সংস্কৃতি এবং আচার-অনুষ্ঠান আলাদা। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নববর্ষ উদ্যাপন হয় ভিন্নভাবে। যেমন চীনা নববর্ষে থাকে লাল রঙের উত্সব, যা পৃথিবীজুড়ে প্রাচীন ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে পরিচিত, যেখানে বিশেষ খাবার, সাংস্কৃতিক নৃত্য ও ড্রাগন র্যালি থাকে। আর জাপানি নববর্ষে, বরফাচ্ছন্ন পর্বতমালা এবং সাদা প্রাকৃতিক দৃশ্যে পালিত হয় উৎসব, যেখানে পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানোর গুরুত্ব দেওয়া হয়। তবে এসব সবার মধ্যে একটি সাধারণ মিল রয়েছে, নতুন বছরের সূচনায় পুরোনো সব পেছনে ফেলে এগিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা ও আশা।
বাংলাদেশে যে কোন উৎসব উদ্যাপনের অনন্য বৈশিষ্ট্য হলো এর মানুষের মাঝে একাত্মতা তৈরি করা। এখানে বিভিন্ন ধর্ম, বর্ণ, সম্প্রদায়ের মানুষ একত্র হয়ে নৃত্য, সংগীত এবং ঐতিহ্যবাহী খাবারের মাধ্যমে দিনটি উদ্যাপন করে, যা বাংলাদেশের এক অসাধারণ বৈশিষ্ট্য। এ দিনটি শুধু একটি কালেন্ডারীয় পরিবর্তন নয়, বরং আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং শেকড়ের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন। এটা যেন মানুষের মনের মধ্যে এক নতুন প্রেরণা দেয়, যেখানে সবাই মিলে সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক বিরোধ ভুলে এক হয়ে জীবন উদ্যাপন করে। বিশ্বের অন্যান্য দেশ যেমন সুইডেন, নেদারল্যান্ডস কিংবা স্পেনে নববর্ষ উদ্যাপন হয় অঙ্গীকার, আশাবাদ এবং বন্ধুত্বের ভিত্তিতে।
বাংলাদেশের নববর্ষ কেবল উদ্যাপন নয়, এটি একটি বৈশ্বিক উত্সবের অংশ, যা আমাদের সংস্কৃতির গুরুত্ব, শান্তি ও ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে সহায়তা করে। এটি একটি দৃঢ় আহ্বানÑ বিশ্বের প্রতি যে ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এবং মানুষের শেকড়কে সম্মান জানিয়ে, আমরা যেন নিজেদের বিশ্বাসে অটুট থেকে, সব ধরনের বিভেদ ও বৈষম্য ভুলে মানবতা, ভালোবাসা ও একাত্মতায় বিশ্বাস রাখি। দিনটি যেন এক অমূল্য স্মৃতি, যা হৃদয়ে চিরকাল রয়ে যায়। ছোটবেলায়, আমার গ্রামের পথে বৈশাখের আনন্দ ছিল এক অপূর্ব দৃশ্য। দুপুরবেলা, পান্তা-ইলিশ আর পেঁয়াজ, চিঁড়া-দইয়ের এক অপূর্ব পর্বে বসে, আমার সঙ্গীরা একে অন্যকে জানাত বছরের শুভেচ্ছা। আর সবচেয়ে স্মরণীয় ছিল পহেলা বৈশাখের দিনটিতে রমনার বটতলায় যাওয়া। একসঙ্গে গানের তালে তালে নাচ, গল্প বলা; যেখানে শুধু ঐতিহ্যই নয়, ছিল একাত্মতা, ভালোবাসা আর বিশ্বাসের শক্তি। আমি যেন তখন উপলব্ধি করতাম পহেলা বৈশাখ শুধু একটি নতুন বছরের সূচনা নয়, বরং একটি নতুন জীবনের সূচনা, যেখানে আশা ও সম্ভাবনার আলো জ্বলতে থাকে।
তখনকার সেই দিনগুলোর কথা মনে পড়লে মনে হয়, আজও যদি সেই ঐতিহ্য অটুট রাখতে পারতাম, যদি সেদিনের মতোই আমরা সবাই এক হয়ে নতুন বছরের শুরুটা উদ্যাপন করতে পারতাম, তবে হয়তো আমাদের সমাজের সবার মধ্যে সত্যিকার অর্থে ঐক্য এবং শান্তি প্রতিষ্ঠা হতো। এ স্মৃতিগুলো যেন এখনও মনকে উজ্জীবিত করে। যতই সময় এগিয়ে যাক, বৈশাখের সেই স্নিগ্ধ রোদ, সেই পান্তা-ইলিশ, সেই গানের সুর সবকিছু মনে হয় কখনও মুছে যাবে না, বরং প্রতিটি সঙ্গে নতুন করে জীবন্ত হয়ে উঠবে।
আমরা যেন ভুলে না যাই আমাদের সংস্কৃতি এবং বিশ্বাসকে সম্মান করতে হবে এবং কোনো কিছুই আমাদের জাতিগত পরিচয়ের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হতে পারে না। তাই আসুন আমরা যেন বিশ্বে এক শক্তিশালী, উদার জাতি হয়ে উঠি। দূর হোক কুসংস্কার, জয় হোক মানবতার, গড়ে উঠুক বাঙালির ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতি। যা ভবিষ্যৎ নির্মাণের চাবিকাঠি, যা সবার জন্য ভালোবাসা, শান্তি এবং সমৃদ্ধি বয়ে আনবে।