সম্পাদকীয়
প্রকাশ : ২৪ এপ্রিল ২০২৫ ১৬:০১ পিএম
বাসযোগ্যতার সূচকে চরম ঝুঁকিতে থাকা চট্টগ্রাম মহানগরের আবাসনব্যবস্থার চিত্র খুবই নাজুক ও ঝুঁকিপূর্ণ। ফলে এখানকার বেশিরভাগ ভবন আবাসিক, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কার্যালয়, হাসপাতাল ইত্যাদি হিসেবে ব্যবহার হওয়ায় প্রাণহানির শঙ্কাও প্রকট। ঝুঁকিমুক্ত ও নিরাপদ আবাসন গড়তে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) যখন সক্রিয় ও জোরালো ভূমিকার রাখার কথা ছিল, তখন সংস্থাটি হেঁটেছে উল্টোপথে। জানা গেছে, চট্টগ্রাম মহানগরের জামালখানের আসকার দীঘির পারের সংরক্ষিত পাহাড়টি সমতলভূমি দেখিয়ে অনুমোদন নেওয়া হয়েছিল ১৪ তলার চারটি টাওয়ার গড়তে। এর বাইরে রয়েছে তিনটি বেসমেন্ট। সে হিসেবে প্রায় ১৭ তলা উচ্চতার ভবন নির্মিত হচ্ছিল পাহাড় কেটে। আর পাহাড়টি রেকর্ডে ছিল সমতলভূমি। সিডিএ এ ভবনের অনুমোদনও দিয়েছিল। অভিযোগ রয়েছে, বিগত সরকারের সময়ে সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতনদের ম্যানেজ করে নানা অনিয়মের মধ্যেই এসব অনুমোদন নেওয়া হতো। আরও উদ্বেগের বিষয় পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চট্টগ্রামে ভূমিকম্পের শঙ্কায় রয়েছে ৭০ শতাংশ ভবন।
২৩ এপ্রিল প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এ ‘নকশা না মেনে গড়ে ওঠা ভবনে বাড়ছে ঝুঁকি’ শীর্ষক প্রতিবেদনে জানা যায়, ২০২৩ সালের ১৩ এপ্রিল চট্টগ্রামের পাহাড়ঘেরা আসকার দীঘির উত্তর পারে তিনটি বেসমেন্টসহ ১৪ তলা ভবন নির্মাণের অনুমোদন দেয় চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)। পরে দেখা যায়, পাহাড় কেটে সেখানে ভবন নির্মাণ করছে স্বপ্নীল ফ্যামিলি ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন নামে একটি প্রতিষ্ঠান। যেখানে সিডিএ’র দেওয়া শর্তের ৬০ শতাংশ খালি রাখা এবং পাহাড় না কাটার বাধ্যবাধকতা মানা হয়নি। বরং টিন দিয়ে উঁচু প্রাচীর তুলে লোকচক্ষুর আড়ালে রাখা হয় পুরো নির্মাণকাজ। এর মধ্যেই পাহাড় কেটে ছয় তলা পর্যন্ত নির্মাণও শেষ হয়েছে। সিডিএ সরেজমিন পরিদর্শনের পর নির্মাণ বন্ধের নির্দেশ দেয়। নির্দেশনা অমান্য করে ভবন মালিকরা উচ্চ আদালতের শরণাপন্ন হন এবং স্থগিতাদেশ নিয়ে আসেন। স্থগিতাদেশ পুঁজি করে ফের কাজ চালিয়ে যান। সর্বশেষ ২০ এপ্রিল সিডিএর করা আপিলে উচ্চ আদালত আগের স্থগিতাদেশ আট সপ্তাহের জন্য স্থগিত করেন। পরদিন ২১ এপ্রিল সকালে সিডিএ অভিযান চালিয়ে ভবন ভাঙার কাজ শুরু করে। এ বিষয়ে সিডিএ চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মো. নুরুল কবির বলেছেন, ‘আগে অনুমোদনের ফাইল চেয়ারম্যান হয়ে যেত না। এখন থেকে সব প্ল্যান চেয়ারম্যান দপ্তর হয়ে যাবে। এতে অনিয়ম কমবে।’ তিনি আরও বলেন, ভবন নির্মাণ করতে হলে অবশ্যই ইমারত আইন মানতে হবে। সিডিএর তথ্যমতে, বর্তমানে এ মহানগরে ৩ লাখ ৮২ হাজার ১১টি ভবনের মধ্যে প্রায় ২ লাখ ৬৭ হাজারই ঝুঁকিপূর্ণ। বেশিরভাগ ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে আইন-বিধি না মানা, নকশা না মেনে ভবন করা এবং মানসম্পন্ন নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহার না করা ঝুঁকির কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য, খোদ রাজধানী ঢাকায় নকশা না মেনে নির্মাণাধীন ৩ হাজার ৩৮২টি ভবনের অবৈধ অংশ চিহ্নিত করেছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। বেশিরভাগই চরম ঝুঁকিপূর্ণ। এ তালিকায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও রয়েছে। পরিসংখ্যান বলছে, ৬০ ভাগ ভূমিকম্প এবং ৫৫ ভাগ আগুনের ঝুঁকিতে রয়েছে এসব ভবন। এমনকি ঢাকা সিটির বাইরে ৯০ ভাগ ভবনই অনুমোদনবিহীন। রাজউক চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার মো. রিয়াজুল ইসলাম বলেছেন, নকশা অনুযায়ী ভবন নির্মাণ না করলে সেবাসংযোগ বিচ্ছিন্ন, উচ্চ জরিমানাসহ কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। আমরা আশা করি, অনুমোদন ছাড়া গড়ে ওঠা এসব অবৈধ ভবনের ঝুঁকির বিষয়ে কর্তৃপক্ষ দ্রুত পদক্ষেপ নেবেন।
আমরা মনে করি, সিডিএর যে আইন রয়েছে, সক্ষমতা রয়েছে তা দিয়ে যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করা গেলে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো না। অভিযোগ রয়েছে, সংস্থাটি প্লট ও ফ্ল্যাট নির্মাণের মতো আবাসন প্রকল্প বাস্তবায়নে অধিক মনোযোগী, যা কাঙ্ক্ষিত নয়। বরং তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব সঠিকভাবে পালনে মনোযোগী হতে হবে। একই সঙ্গে প্রতিষ্ঠানটির সদিচ্ছার অভাবে নাকি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অবৈধ সুবিধালাভের কারণে এভাবে নগরজুড়ে শত শত অবৈধ ভবন নির্মিত হয়েছে, তারও তদন্ত প্রয়োজন। সে ক্ষেত্রে যথাযথ তদন্তের মাধ্যমে অসাধু ব্যক্তিদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। মোট কথা, এসব অনিয়মের শেকড় কোথায়, তা খুঁজে বের করতে হবে।
আসলে অপরিকল্পিত ও অবৈধ এসব ভবন নগরবাসীকে শুধু বসবাসের অযোগ্যই নয়, প্রাণহানির শঙ্কায়ও ভোগাচ্ছে। বেশিরভাগ ভবনে ভূমিকম্প, অগ্নিদুর্ঘটনা প্রতিরোধ ও নিরাপত্তার বিষয়গুলো সাধারণত উপেক্ষিত থাকে। তাই প্রয়োজন দেখা দিয়েছে সঠিক নগর পরিকল্পনা প্রণয়ন ও উন্নয়ন বিষয়টি তদারকি করা। তবে সিডিএ চেয়ারম্যান যে পদক্ষেপ নিয়েছেন তা সময়োপযোগী। আরও বলা বাহুল্য, সিডিএর নির্ধারিত আইন ও বিধিবিধান উপেক্ষা করে অবৈধ কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের কিংবা তাদের পৃষ্ঠপোষকদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ গ্রহণে ব্যর্থ হলে বিদ্যমান আইনের প্রতি দেশের মানুষের আস্থা হারাবে। তাই অনুমোদনবিহীন ভবন নির্মাণের এ বেআইনি কর্মকাণ্ড দ্রুত বন্ধের পাশাপাশি জড়িতদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিশ্চিত করার মাধ্যমে সিডিএ তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথ পালন করবে, এটাই আমাদের প্রত্যাশা।