ঘূর্ণিঝড়
নিয়াজ মো. ফারহাত রহমান
প্রকাশ : ২৪ এপ্রিল ২০২৫ ১৫:৫৬ পিএম
নিয়াজ মো. ফারহাত রহমান
আমাদের চারপাশে সড়ক ও নৌ দুর্ঘটনা, অগ্নিকাণ্ডসহ নানান দুর্যোগের ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটছে। এগুলো এত বেশি ঘটছে যে, নাগরিক জীবনে প্রায় স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে উঠেছে। তবে যতক্ষণ না এ বিপর্যয় আমাদের ব্যক্তিজীবনে নেমে আসে, ততক্ষণ আমরা এগুলো নিয়ে ভাবি না। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বিশেষ করে ঘূর্ণিঝড় বর্তমানে ভয়াবহ বাস্তবতা। বিশেষ করে উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের জন্য যা এক আতঙ্কের নাম। আকাশে কালো মেঘ দেখলেই উপকূলের মানুষ মনে করেন ঘূর্ণিঝড় আসছে। তাদের মনে অজানা শঙ্কা ভর করে, কারণ তারা জানেন এর ভয়াবহতা কতটা মারাত্মক!
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বায়ুমণ্ডলের গড় তাপমাত্রা ক্রমে বৃদ্ধি পাচ্ছে। সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, ১৯৭৬ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে বাংলাদেশের গড় তাপমাত্রা প্রায় ১ দশমিক ২৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের আরেকটি বড় প্রমাণ উষ্ণতম দিনের চরিত্রবদল। আগে মনে করা হতো, দেশের উষ্ণতম মাস এপ্রিল। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, গ্রীষ্মকালের দৈর্ঘ্য বেড়ে যাওয়া থেকে শুরু করে বর্ষাকালেও তাপপ্রবাহ সংঘটিত হচ্ছে। তিন দশক ধরে বাংলাদেশের গড় তাপমাত্রা আগের তিন দশকের চেয়ে তীব্রভাবে বেড়েছে। অনিয়মিত বৃষ্টিপাতও এর একটি বড় কারণ। এ বছর শীতকালে বৃষ্টি হয়নি বললেই চলে; যা সাম্প্রতিক বছরে দেখা যায়নি। আবার তার আগের বছরগুলোতেও একই ধারা লক্ষ করা গেছে। সরকারের জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনার (ন্যাপ) তথ্যমতে শীতকাল ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি ও বর্ষাপূর্ববর্তী মার্চ থেকে মেতে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমছে। কিন্তু বর্ষার সময় জুন থেকে সেপ্টেম্বর ও বর্ষাপরবর্তী অক্টোবর থেকে নভেম্বরে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ স্বাভাবিকের চেয়ে বেড়ে গেছে; যা অনেকটা অস্বাভাবিক।
ওয়ার্ল্ড ক্লাইমেট রিস্ক ইনডেক্সের তথ্যানুযায়ী, পৃথিবীর যেসব দেশ সবচেয়ে বেশি জলবায়ু ঝুঁকিতে আছে, তার মধ্যে শীর্ষ ১০-এ রয়েছে বাংলাদেশ। ন্যাপের তথ্য বলছে, দেশে ১৫টি দুর্যোগের হার সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাড়বে। এর মধ্যে জলবায়ু ঝুঁকি ছাড়াও রয়েছে অনিয়মিত বৃষ্টিপাত, নদ-নদীতে বন্যা, খরা, নদীভাঙন, আকস্মিক বন্যা ও শহরাঞ্চলের বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, লবণাক্ততা বৃদ্ধি, তীব্র তাপপ্রবাহ, তীব্র শীত, বজ্রপাত, ভূমিধস, সমুদ্রপৃষ্ঠের উষ্ণতা বৃদ্ধি ও অম্লতা। সময়ের পরিক্রমায় আবারও আসছে ঘূর্ণিঝড় মৌসুম, কিন্তু আমরা এ নিয়ে কতটা সচেতন? তা মোকাবিলায় কতটা প্রস্তুত? তাই প্রশ্ন থেকে যায়, আমরা কি যথাযথ প্রস্তুতি নিচ্ছি?
বঙ্গোপসাগরে নিম্নচাপ সৃষ্ট হলে বাতাসের প্রচণ্ড ঘূর্ণায়মান গতি এবং বায়ুমণ্ডলীয় উত্তাল অবস্থার ফলে ঘূর্ণিঝড়ের সৃষ্টি হয়। ঘূর্ণিঝড় সাধারণত মার্চ থেকে জুলাই এবং সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশে হয়ে থাকে। এর মধ্যে মে এবং নভেম্বরে সবচেয়ে বেশি ঝড় আঘাত হানে। একটি গবেষণায় বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর ১৯৪৮ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ৭৫ বছরে বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড়, প্রবল ঘূর্ণিঝড় এবং নিম্নচাপ বিশ্লেষণ করেছে। গবেষণার ফলাফলে দেখা যায়, এ সময়ে বঙ্গোপসাগরে ১৫১টি প্রবল ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হয়েছে। এর মধ্যে নভেম্বরে সর্বোচ্চ ৫১টি, মে মাসে ৩০টি এবং অক্টোবরে ২৯টি ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছে।
এ ছাড়া ১৯৭০ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন উৎস থেকে সংগৃহীত ঘূর্ণিঝড়ের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গত ৫৫ বছরে বাংলাদেশে মোট ৪২টি ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছে। সময় অনুযায়ী ঘূর্ণিঝড়ের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায়, ১৯৭০ থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত ৩০ বছরে ২১টি ঘূর্ণিঝড়, বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল গড়ে ১৩৮ কিমি ঘণ্টা এবং ২০০০ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত গত ২৫ বছরে ২২টি ঘূর্ণিঝড় সংঘটিত হয়েছে, যেখানে বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল গড়ে ১৪১ কিমি ঘণ্টা। উপরোক্ত পরিসংখ্যান থেকে স্পষ্ট, সময় বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ঘূর্ণিঝড়ের সংখ্যা এবং তীব্রতা দুটোই বেড়েছে। বিশেষ করে ২০২৩ সালে সর্বোচ্চ ৪টি ঘূর্ণিঝড় সংঘটিত হয়েছে, যা অন্য যে কোনো বছরের তুলনায় বেশি। এ ছাড়া ১৯৭১, ২০০৭ এবং ২০২৪ সালে তিনটি করে ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছে।
বাংলাদেশ একাধিক তীব্র ঘূর্ণিঝড়ের সম্মুখীন হয়েছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো : ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়, ২০০৭ সালের সিডর, ২০১৯ সালের ফণি এবং ২০২৩ সালের ঘূর্ণিঝড় মোচা এবং ২০২৪-এর রেমাল; যেগুলো ছিল অত্যন্ত বিধ্বংসী। বিশেষ করে ২০১৭ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে ঘূর্ণিঝড়ের তীব্রতা বৃদ্ধি পেয়েছে, যা জলবায়ু পরিবর্তনের স্পষ্ট প্রভাব নির্দেশ করে। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে বিশ্বের অন্যান্য সাগরের পাশাপাশি বঙ্গোপসাগরের তাপমাত্রাও বৃদ্ধি পাচ্ছে, ফলে ঘূর্ণিঝড়গুলো আগের তুলনায় আরও শক্তিশালী হয়ে উঠছে এবং ভূপৃষ্ঠ আঘাত হানার পর ক্ষতির মাত্রাও বেড়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে সমুদ্রপৃষ্ঠ এবং ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা একসঙ্গে বৃদ্ধি পাওয়ায় ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন আসছে, যা ভবিষ্যতে আরও বিধ্বংসী ঝড়ের ইঙ্গিত দিচ্ছে। বিশেষত উপকূলীয় অঞ্চলের জন্য এ ক্রমবর্ধমান শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় একটি বড় হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে। এ কারণে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, দুর্যোগ প্রশমন এবং অভিযোজনের জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের গুরুত্ব প্রতিনিয়ত বাড়ছে।
স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশ একাধিক বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড়ের সম্মুখীন হয়েছে, যা জানমালের পাশাপাশি অর্থনীতিতেও ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। ১৯৭১ সালের ঘূর্ণিঝড়গুলো চট্টগ্রাম ও সুন্দরবন অঞ্চলে আঘাত হানে, যার ফলে উচ্চ জলোচ্ছ্বাস সৃষ্টি হয় এবং নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়। ১৯৭৪ সালের ঘূর্ণিঝড়ে খুলনায় ৬০০ জনের প্রাণহানি ঘটে, আর ১৯৭০ সালের ভোলা ঘূর্ণিঝড়ও ব্যাপক ক্ষতি সাধন করে। ১৯৮৫ সালে ১৫৪ কিমি ঘণ্টা বেগের শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় চট্টগ্রাম, নোয়াখালী এবং কক্সবাজারে আঘাত হানে, যার ফলে ১১ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়। ১৯৮৮ সালে সুন্দরবনে প্রবল ঘূর্ণিঝড় ১৬২ কিমি বেগে আঘাত করে। জলোচ্ছ্বাস হয় সাড়ে ৪ মিটার পর্যন্ত। এতে প্রাণ যায় ৫ হাজার ৭০৮ জনের। ১৯৯১ সালের চট্টগ্রাম অঞ্চলে দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় যা ২৩৫ কিমি ঘণ্টা গতির বাতাস নিয়ে আঘাত হানে, এতে মৃত্যু হয় ১ লাখ ৩৮ হাজারের বেশি মানুষের এবং ক্ষতি হয় দেড় বিলিয়ন ডলারের বেশি। ২০০৭ সালের ঘূর্ণিঝড় সিডর, যার বাতাসের গতিবেগ ২৬০ কিমি ঘণ্টা পর্যন্ত পৌঁছায়, ৩ হাজার ৫০০ জনের বেশি মানুষের প্রাণহানি ঘটায় এবং ব্যাপক ধ্বংস সাধন করে যার চিহ্ন এখনও আছে। পরবর্তী বছরগুলোতে নার্গিস (২০০৮), আইলা (২০০৯), ফণি (২০১৯), আম্ফান (২০২০), মোচা (২০২৩), রেমালসহ (২০২৪) আরও বেশ কয়েকটি বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড় বাংলাদেশ উপকূলীয় অঞ্চলে আঘাত হানে।
প্রতিটি ঘূর্ণিঝড়ই আমাদের সামনে এক বিপর্যয়ের চিত্র তুলে ধরে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা কি আগের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিচ্ছি? প্রতি বছর ঘূর্ণিঝড় আমাদের অর্থনীতি, পরিবেশ ও জনজীবনকে বড় ধরনের ক্ষতির মুখে ফেলে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এ দুর্যোগের মাত্রা আরও ভয়াবহ হয়ে উঠছে। আমরা যদি এখন থেকেই যথাযথ ব্যবস্থা না নিই, তাহলে ভবিষ্যতে ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়বে। এখন আমাদের সামনে দুটি পথ খোলাÑ ১. আমরা কি প্রতিবার দুর্যোগের পরে ক্ষতি সামলাতে ব্যস্ত থাকব? ২. নাকি পূর্বপ্রস্তুতি নিয়ে জানমাল রক্ষার কার্যকর উদ্যোগ নেব? বুদ্ধিমানের কাজ হবে পূর্বপ্রস্তুতি নিয়ে দুর্যোগের মোকাবিলা করা।
তাহলে আমাদের প্রস্তুতি কেমন হবে, সেটাই এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ বাংলাদেশের অর্থনীতি, পরিবেশ এবং কৃষিব্যবস্থার ওপর প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রভাব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে ঘূর্ণিঝড় দেশের উপকূলীয় ও কৃষিনির্ভর জনগোষ্ঠীর জন্য সবচেয়ে বড় হুমকিগুলোর একটি। দেশের কৃষির ওপর ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাব এতটাই ব্যাপক যে এটি খাদ্যনিরাপত্তা, কৃষি উৎপাদন, কৃষকের জীবনযাত্রা এবং অর্থনীতির স্থিতিশীলতা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। দারিদ্র্যমোচনসহ সামাজিক নিরাপত্তা অর্জনে জলবায়ু পরিবর্তন ও দুর্যোগ মোকাবিলায় বাংলাদেশের গৃহীত পদক্ষেপ সারা বিশ্বে প্রশংসিত হয়েছে। তবে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে আমাদের দায় না যতটা তার চেয়ে বেশি বৈশ্বিক। আমাদের মতো স্বল্পোন্নত দেশগুলো বাঁচাতে উন্নত দেশগুলোকেই এগিয়ে আসতে হবে। তেমন ঘূর্ণিঝড় মৌসুম শুরু হওয়ার আগেই জানমাল রক্ষায় সরকার থেকে প্রস্তুতি গ্রহণ জরুরি। এতে দেশের মানুষ যেমন নিরাপদ থাকবে, তেমন অর্থনীতিও সুরক্ষিত থাকবে।