কানাডার নির্বাচন
নিরঞ্জন রায়
প্রকাশ : ২৪ এপ্রিল ২০২৫ ১৫:৫০ পিএম
নিরঞ্জন রায়
কানাডার নির্বাচনী প্রতিযোগিতা বেশ জমে উঠেছে। নতুন নেতৃত্ব পাওয়া মার্ক কার্নি ডুবে যাওয়া লিবারেল পার্টিকে শুধু ঘুরে দাঁড় করাতেই সক্ষম হননি, সেই সঙ্গে নির্বাচনী প্রতিযোগিতায় বেশ এগিয়ে রাখতে পেরেছেন। জনমত জরিপ অন্তত তা-ই বলে। পক্ষান্তরে কনজারভেটিভ পার্টির নেতা পিয়ারে পলিয়েভার এক কঠিন চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়ে গেছেন। প্রথমত এক দশক ধরে এ দেশের বৃহত্তম এক রাজনৈতিক দল ক্ষমতার বাইরে। এ দলকে ক্ষমতায় নেওয়ার গুরুদায়িত্ব পড়েছে পলিয়েভারের ওপর। দ্বিতীয়ত দলকে বিজয়ী করার ওপর দলের ভবিষ্যৎ এবং তার নিজের ব্যক্তিগত রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের সফলতা নির্ভর করে। তৃণমূল থেকে উঠে আসা একজন দক্ষ রাজনীতিবিদের সামনে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এ সুযোগ তিনি যেভাবে কাজে লাগিয়েছেন, তাতে যদি কানাডার ভোটাররা তার দলের পক্ষে ভোট প্রদান করেন, তাহলে তিনি রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের শীর্ষে পৌঁছাতে পারবেন। কিন্তু ভোটাররা যদি এবারও তার দলের পক্ষে ভোট না দেন, তাহলে কানাডার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন তার অধরাই থেকে যাবে।
পলিয়েভার কানাডার কনজারভেটিভ পার্টির নেতৃত্ব পাওয়ার পর থেকে বেশ ভালোই করছিলেন। দলকে অনেক এগিয়ে এনেছেন। মধ্য জানুয়ারি পর্যন্ত সকল প্রকার নির্বাচনী জরিপে কনজারভেটিভ পার্টি ক্ষমতাসীন লিবারেল পার্টির চেয়ে ২০ পয়েন্টে এগিয়ে ছিল। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছিল যে, আগামী নির্বাচনে কনজারভেটিভ পার্টির ভূমিধস বিজয় নিশ্চিত। দক্ষ দাবাড়ুর মতো পলিয়েভার সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও লিবারেল পার্টির নেতা জাস্টিন ট্রুডোকে চতুর্মুখী চাল দিয়ে শক্তভাবে আটকে ধরেছিলেন। কার্বন ট্যাক্স, উচ্চ জীবনযাত্রা ব্যয়, চরম আবাসনসংকট, ভ্রান্ত অভিবাসননীতি এবং বাজেট ঘাটতির মতো বিষয় দিয়ে জাস্টিন ট্রুডোকে নাস্তানাবুদ করে ফেলেছিলেন। পলিয়েভারের চতুর্মুখী তির্যক আক্রমণে ট্রুডো নিজে যেমন দিশাহারা অবস্থা, তেমনি দলেরও লেজেগোবরে অবস্থা হয়ে যায়। একপর্যায় ট্রুডোর মন্ত্রিপরিষদ থেকে একাধিক মন্ত্রী পদত্যাগ করেন। এক বিপর্যয়কর অবস্থার মধ্যে ট্রুডো পদত্যাগ করেন। ঠিক সেই মুহূর্তে রাজনীতির বাইরে থাকা পেশায় ব্যাংকার মার্ক কার্নি আবির্ভূত হন লিবারেল পার্টির ত্রাণকর্তা হিসেবে। কার্নি যেভাবে আকস্মিক রাজনৈতিক ময়দানে হাজির হয়ে একেবারে দলের শীর্ষ নেতৃত্ব এবং দেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দ্বারপ্রান্তে, তা মূলত কানাডার রাজনীতিতে এক নতুন ধারার প্রচলন। বিষয়টি ভালোভাবে বুঝিয়ে লিখতে গেলে বিস্তারিত আলোচনার প্রয়োজন, যার সুযোগ এখানে সীমিত।
রাজনীতির বাইরে থাকা এবং রাজনৈতিক অঙ্গনে একেবারেই অপরিচিত মুখ মার্ক কার্নিকে যে কৌশল নিয়ে লিবারেল পার্টির ত্রাণকর্তা হিসেবে হাজির করা হয়েছে, সে কৌশল বেশ ভালোই কাজ করেছে। কার্নি লিবারেল পার্টির দায়িত্ব নিয়ে শুরুতেই ভালো চমক সৃষ্টি করতে পেরেছেন। তিনি ডুবন্ত দলকে ঘুরে দাঁড় করিয়েছেন এবং ক্ষমতায় নেওয়া প্রায় নিশ্চিত করে ফেলেছেন। এক ধরনের চমক সৃষ্টির মাধ্যমে তিনি এক চালে বেশ কয়েকটি উদ্দেশ্য হাসিল করতে পেরেছেন। প্রথমত তিনি কনজারভেটিভ পার্টির নেতা পিয়ারে পলিয়েভারকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে যথেষ্টই ব্যাকফুটে ঠেলে দিতে পেরেছেন। জনমত জরিপের সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও কার্নি লিবারেল পার্টির হাল ধরার পর থেকে জনমত জরিপে লিবারেল পার্টিকে প্রতিপক্ষ কনজারভটিভ পার্টি থেকে ৫-৭ পয়েন্টে এগিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছেন। দ্বিতীয়ত তিনি দায়িত্ব নিয়ে স্বল্পসময়ের মধ্যে ডুবে যাওয়া একটি দলকে শক্ত অবস্থানে নিয়ে আসায় কিছু ভোটারের মধ্যে এমন ধারণা হয়েছে যে, তিনিই কানাডার প্রধানমন্ত্রীর জন্য সবচেয়ে যোগ্য উপযুক্ত প্রার্থী। কেননা অনেকের ধারণা, যিনি দুর্বল অবস্থায় থাকা একটি দলকে ঘুরে দাঁড় করাতে পারেন, তিনি দেশকেও ভালো নেতৃত্ব দিতে পারবেন।
তৃতীয়ত তিনি তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়ে এবং ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’, এমন বক্তব্যের মাধ্যমে একশ্রেণির ভোটারের মন জয় করতে সক্ষম হয়েছেন। এসব কারণে বিগত এক বছরের অধিক সময় ধরে নির্বাচনী দৌড়ে এগিয়ে থেকেও কনজারভেটিভ পার্টি বেশ চ্যালেঞ্জ এবং চাপের মধ্যে পড়ে গেছে।
অনেকের ধারণা, মার্ক কার্নির নেতৃত্বের কারণেই পিয়ারে পলিয়েভার চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়েছেন এবং প্রচণ্ড চাপের মধ্যেই আছেন। আসলে মোটেই তা নয়। যে কারণে পলিয়েভার তার দলকে নির্বাচনে জেতানোর ক্ষেত্রে কঠিন প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হচ্ছেন, তা কেউই সেভাবে আলোচনা করছেন না এবং মিডিয়ায়ও আসছে না। মূলত মার্ক কার্নি নন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প পলিয়েভারকে মারাত্মক চ্যালেঞ্জের মধ্যে ফেলে দিয়েছেন। ২০ জানুয়ারি ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেওয়ার পরই দৃশ্যপট বদলে যেতে শুরু করেছে। ট্রাম্প নির্বাচনী প্রচারের সময় উচ্চহারে শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়েছেন এবং সে উচ্চ শুল্ক ধার্য করার কথা ছিল চীন এবং অন্যান্য দেশের ওপর। কানাডা সেভাবে আলোচনায়ই ছিল না। অথচ ট্রাম্প হোয়াইট হাউসে প্রবেশ করেই প্রথম আক্রমণ করলেন কানাডাকে। প্রথমে কানাডাকে যুক্তরাষ্ট্রের ৫১তম স্টেট হিসেবে সংযুক্ত করার হুমকি দিলেন। তার পরই কানাডার পণ্যের ওপর ২৫% শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়ে কানাডার অর্থনীতি মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিলেন। এর ফলে কানাডিয়ানদের মধ্যে কানাডা রক্ষা করার জন্য এক নতুন জাতীয়তাবাদের জন্ম হয়। কানাডার নাগরিক ভাবতে শুরু করলেন, এ বৈরী পরিবেশে সব ভেদাভেদ ভুলে সবাইকে একতাবদ্ধ হতে হবে। সংকট মোকাবিলায় পারদর্শী মার্ক কার্নি জনগণের এমন অনুভূতি তার দিকে টেনে নিতে কিছুটা সফলই হয়েছেন। অন্যপক্ষে একই রকম অনুভূতির কথা চিন্তা করে পলিয়েভার অনেক অপ্রিয় সত্য কথা অকপটে বলতে পারেননি। বরং অনেক কিছুই তাকে ভেবেচিন্তে বলতে হয়েছে, যা অনেকের কাছে দুর্বলতা বলে মনে হয়েছে। আসলে সবকিছু গুছিয়ে আনার পরও পলিয়েভারের জন্য সময়টা খারাপ হয়ে গেছে।
অনেকেই পলিয়েভারকে ট্রাম্পের সঙ্গে তুলনা করতে চেষ্টা করেন। কারণ তিনিও ট্রাম্পের মতোই স্পষ্ট বক্তব্য দেন এবং সেভাবেই নির্বাচনী প্রচার চালান। ট্রাম্প যেমন বলেন যুক্তরাষ্ট্র ফাস্ট, তেমন পলিয়েভারও বলেন কানাডা ফাস্ট। ট্রাম্পের মতোই বলার চেষ্টা করেন যে লিবারেলের শাসনামলে অনেক চাকরি কানাডার বাইরে, এমনকি যুক্তরাষ্ট্রে চলে গেছে। কর কর্তন বা ট্যাক্স কাট এবং কার্বন ট্যাক্সের কথাও একইভাবে বলে থাকেন। এমনকি বিশাল বাজেট ঘাটতি এবং ভ্রান্ত অভিবাসী নীতির বিরুদ্ধেও তিনি ট্রাম্পের মতোই সোচ্চার। ট্রাম্পের সঙ্গে তুলনার কথাটি বাদ দিয়ে ট্রাম্পের কথার মতো শোনালেও কথাগুলো তো বাস্তব সত্য। ট্রুডোর লিবারেল পার্টির শাসনামলে কানাডার ইমিগ্রেশন কতটা খারাপ হয়েছে তা একটি দৃষ্টান্ত দিলেই স্পষ্ট হয়ে যাবে। এখানকার ইমিগ্রেশন আইন এমন যে আমরা এখানে নাগরিক হিসেবে দীর্ঘদিন বসবাস করলেও আমাদের জীবদ্দশায় ভাইবোনকে অভিবাসন দিয়ে আনতে পারব না। এমনকি আমাদের বাবা-মাকেও আনার সুযোগ নেই। লটারির মাধ্যমে সামান্য কয়েকজন বাবা-মাকে আনার সুযোগ দিয়ে তা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। অথচ লাখ লাখ মানুষ যেনতেন উপায়ে কানাডার ভিজিট ভিসা সংগ্রহ করে এখানে এসে অ্যাসাইলাম দাবি করে বশে আছেন এবং এভাবে থেকেও যাবেন। অ্যাসাইলাম গৃহীত হওয়া তো অনেক পরের কথা, অ্যাসাইলামের আবেদনপত্র গ্রহণের দিন থেকে প্রতি মাসে ভালো অঙ্কের ভাতাও পেয়ে থাকেন, যা মূলত আমাদের মতো সাধারণ মানুষের ট্যাক্সের টাকা থেকেই দেওয়া হয়। এ রকম অভিবাসন নীতি সমর্থন করার কারণ থাকতে পারে না। এসব বিষয়ে স্পষ্ট বক্তব্যের কারণেই পলিয়েভারকে একটি শ্রেণি ট্রাম্পের সঙ্গে তুলনার চেষ্টা করে, যাতে ট্রাম্পবিরোধী ভোটারদের কার্নির লিবারেল দলের পক্ষে টানা যায়।
আসলে ট্রাম্পের সঙ্গে পলিয়েভারের তুলনা করার সুযোগ নেই। ট্রাম্প ধনাঢ্য পরিবারে অত্যন্ত সচ্ছলতার মধ্যে বেড়ে উঠেছেন। পক্ষান্তরে পলিয়েভার একজন স্কুলশিক্ষকের পালিত সন্তান হিসেবে বেড়ে উঠেছেন। ট্রাম্প পেশায় ব্যবসায়ী থেকে রাজনীতিতে এসেছেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন, যা মূলত কার্নির ক্যারিয়ারের সঙ্গে কিছুটা মিল আছে। কিন্তু পলিয়েভার তৃণমূল থেকে উঠে আসা একজন দক্ষ রাজনীতিবিদ। ট্রাম্প সব সময় মিডিয়ায় সরব থাকতে পছন্দ করেন। এ কারণেই তিনি অনেক সিদ্ধান্ত নেন বা অনেক কিছু বলেন শুধু মিডিয়ায় আলোচিত থাকার জন্য। পক্ষান্তরে পলিয়েভার মোটেই মিডিয়ায় সরব থাকতে পছন্দ করেন না এবং এমন কিছু বলা থেকে বিরত থাকেন যাতে মিডিয়া তার ব্যাপারে সরব হওয়ার সুযোগ পায়।
এ সবকিছু বিবেচনায় নিলেও নির্বাচন নিয়ে কোনোরকম চূড়ান্ত মন্তব্য বা উপসংহার টানার সময় আসেনি। শক্ত প্রতিযোগিতা হবে এমনটাই অনেকের ধারণা। যারা নির্বাচনী দৌড়ে কার্নির লিবারেল পার্টিকে এগিয়ে রাখছেন, তারা মূলত জনমত জরিপের ফলাফল বিবেচনায় নিচ্ছেন। কেননা এসব জনমত জরিপের ফলাফলে লিবারেলকে ৪৫% এবং কনজারভেটিভ পার্টিকে ৩৭% সম্ভাব্যতার মধ্যে রেখেছে। এ জনমত জরিপের বিশ্বাসযোগ্যতা যে কতটুকু তা ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন এবং অন্টারিওর প্রিমিয়ার নির্বাচনের সময় কিছুটা বোঝা গেছে। তা ছাড়া যে বছর স্টিফেন হারপার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছিলেন, তখনও জনমত জরিপে কনজারভেটিভ পার্টির সমর্থন দেখানো হয়েছিল ৩৭%। আসলে জনমত জরিপে কিছুই যাবে আসবে না। কানাডার ভোটাররা যে দলকে ভোট দেবেন, সে দলই বিজয়ী হবে। কে হবেন কানাডার প্রধানমন্ত্রী, মার্ক কার্নি নাকি পিয়ারে পলিয়েভার, তা নির্ধারিত হবে ২৮ এপ্রিলের নির্বাচনে।