সম্পাদকীয়
প্রকাশ : ২৩ এপ্রিল ২০২৫ ১৭:২০ পিএম
সুন্দরবনের ১০ কিলোমিটার প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকার মধ্যে নতুন কোনো শিল্পপ্রতিষ্ঠান বা প্রকল্প স্থাপন নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। শিগগির এ-সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করবে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়। সোমবার সচিবালয়ে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সভায় উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান এ সিদ্ধান্তের কথা জানান। সভায় সুন্দরবনের পরিবেশগত সুরক্ষায় ২০১৭ সালের জাতীয় পরিবেশ কমিটির সিদ্ধান্ত এবং ২০২১ সালের নির্বাহী কমিটির সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের কথাও উল্লেখ করা হয়। জানানো হয়, নিরপেক্ষ বিশেষজ্ঞদের দ্বারা সুন্দরবনের ১০ কিলোমিটার ইসিএ এলাকার মধ্যে স্থাপিত শিল্পপ্রতিষ্ঠানসমূহের পরিবেশগত প্রভাব নিরূপণ করা হবে। এ কথা সত্য, দিনদিন হুমকির মুখে পড়ছে সুন্দরবন। প্রতিনিয়ত প্রাকৃতিক এবং মানবসৃষ্ট হুমকি মোকাবিলা করছে। অপরিকল্পিত শিল্পায়নসহ নানা কারণে অস্তিত্ব হারাতে বসেছে এ ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট। তাই এর সুরক্ষায় সরকারের সিদ্ধান্ত অত্যন্ত সময়োপযোগী এবং সাধুবাদের যোগ্য।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপূর্ব লীলাভূমি আমাদের সুন্দরবন। বৈশ্বিক পর্যায়ে সুন্দরবনের গুরুত্ব বিবেচনায় ১৯৯৭ সালে এ বনকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট ঘোষণা করেছে জাতিসংঘের ইউনেসকো। এখানে সুন্দরী, গেওয়া, গরান, কেওড়াসহ ৩৩৪ প্রজাতির উদ্ভিদরাজি রয়েছে। আরও রয়েছে ৩৭৫ প্রজাতির বন্য প্রাণীর মধ্যে রয়েল বেঙ্গল টাইগার, হরিণসহ ৪২ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, লোনা পানির কুমির, গুইসাপ, কচ্ছপ, ডলফিন, অজগর, কিংকোবরাসহ ৩৫ প্রজাতির সরীসৃপ ও ৩১৫ প্রজাতির পাখি। সুন্দরবন বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে আমাদের রক্ষা করে আসছে। কিন্তু আমরা এর জীববৈচিত্র্য রক্ষা করতে পারছি না। নির্বিচার বৃক্ষনিধন থেকে শুরু করে বাঘ এবং হরিণ শিকার করে সুন্দরবনের প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট করছি আইন অমান্য করে। মানুষের আগ্রাসনে প্রতিনিয়ত দূষণ বাড়ছে। বনসংলগ্ন এলাকায় অপরিকল্পিত শিল্পকারখানা স্থাপন, বনের মধ্য দিয়ে ভারী নৌযান চলাচল, বিষ দিয়ে মাছ শিকার এবং নিয়ন্ত্রণহীন পর্যটনের কারণে ঘটছে এসব দূষণ। এতে পশুপাখির বিচরণে অনেক সমস্যা হচ্ছে। সুন্দরবন থেকে অনিয়ন্ত্রিত বনজ সম্পদ আহরণসহ নানা ধরনের অবৈধ তৎপরতা চলছে; যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে বনের গাছপালা, বন্য প্রাণী ও জলজ প্রাণীর ওপর। বিশ্ব-ঐতিহ্য সুন্দরবনের জন্য আটটি হুমকি চিহ্নিত করেছে জাতিসংঘের বিজ্ঞান, শিক্ষা, প্রযুক্তি ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা (ইউনেসকো)। সুন্দরবনের অমূল্য সম্পদ রক্ষা করতে হলে এসব হুমকি মোকাবিলায় জরুরি পদক্ষেপ নিতে হবে।
বিগত সরকারের আমলে সুন্দরবনের চারপাশ প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা ঘোষণা করলেও সে এলাকায় প্রভাবশালীদের পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে উঠছে বহু শিল্পপ্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে রয়েছে সিমেন্ট ফ্যাক্টরি, এলপি গ্যাস প্লান্ট, অয়েল রিফাইনারি, বিটুমিন, সি ফুড প্রসেসিং ফ্যাক্টরি প্রভৃতি। বনের খুব কাছেই বিশালাকৃতির খাদ্যগুদাম নির্মাণ করেছে খাদ্য বিভাগ। বেশকটি শিল্পকারখানার অপরিশোধিত তরল বর্জ্য ফেলা হচ্ছে পশুর নদে, যা চলে যাচ্ছে বনের মধ্যে নদী ও মাটিতে। সুন্দরবনের বিভিন্ন নদী ও খালে দীর্ঘদিন ধরে বিষ দিয়ে মাছ শিকার করছে একটি চক্র। এর ফলে বিভিন্ন মাছের পোনা, কাঁকড়া, সাপসহ জলজপ্রাণী মারা যাচ্ছে। মাঝেমধ্যে পাচারের উদ্দেশ্যে বিষ দিয়ে হত্যা করা হচ্ছে বাঘ ও কুমিরসহ পশুপাখি।
সুন্দরবনের প্রাকৃতিক পরিবেশ যেমন বৈচিত্র্যময়, তেমনি সেসব প্রাকৃতিক সম্পদ দেশের অর্থনীতির চাকা গতিশীল রাখতে অবদান রাখে। সুন্দরবন যে কেবল কয়েক লাখ মানুষের জীবিকার ব্যবস্থা করে তা-ই নয়, বরং এটি নানান প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে দেশের দক্ষিণাঞ্চলকে সুরক্ষা দেয়। এত কিছু জানার পরও মানুষ নির্বিচার এ বন উজাড় করে চলেছে। ফলে দ্রুত কমে আসছে সংরক্ষিত বনের আয়তন। অষ্টাদশ শতাব্দীর শুরুতে সুন্দরবনের আয়তন ছিল বর্তমানের দ্বিগুণ। কমতে কমতে সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশের আয়তন এখন দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার ১৭ বর্গকিলোমিটারে, যা দেশের সংরক্ষিত বনভূমির সর্বমোট ৫১ শতাংশ। এ অবশিষ্ট বনাঞ্চল সুরক্ষায় জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ আবশ্যক। সুন্দরবন যত ঝুঁকির মুখে পড়বে, আমাদের বহুমাত্রিক সংকট ততই প্রকট হবে। এ বন যেহেতু বিশ্ব-ঐতিহ্যের অংশ, সেহেতু এর সুরক্ষার ব্যর্থতায় আন্তর্জাতিকভাবেও নানান প্রশ্নে বিদ্ধ হতে হবে।
সুন্দরবনকে দক্ষিণ এশিয়ার ফুসফুস বলা হয়। সব দূষিত বায়ু নিয়ে সুন্দরবন আমাদের নির্মল বায়ু উপহার দেয়। তাই বিগত সময়ে সুন্দরবনকেন্দ্রিক যেসব অর্বাচীন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, এসবের বিরুদ্ধে কথা বলতে হবে। ভারী স্থাপনাসহ যেসব শিল্প-স্থাপনা গড়ে উঠছে এসবের বিরুদ্ধে এখনই অবস্থান নিতে হবে। সুন্দরবন রক্ষায় প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা। কারণ রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া অপরিকল্পিত শিল্পায়ন বন্ধ করা সম্ভব নয়। আরেকটা বিষয়, মানুষের জীবন নির্ভর করে প্রকৃতির ওপর। তাই প্রকৃতির প্রতি সবার সুন্দর আচরণই কাম্য। সুন্দরবন সুরক্ষায় বর্তমান সরকারের গভীর পর্যবেক্ষণ ও সুদৃষ্টি রয়েছে তা সহজে অনুমেয়। কেবল নিষিদ্ধই নয়, সুন্দরবন রক্ষায় আরও কার্যকর পদক্ষেপ চাই।