আইন
রাইসুল সৌরভ
প্রকাশ : ২৩ এপ্রিল ২০২৫ ১৭:১৬ পিএম
বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থা সম্পর্কে কথা উঠলে বিভিন্ন নেতিবাচক বিষয় উঠে আসে। যার মধ্যে রয়েছে তীব্র মামলাজট, মারাত্মক বিলম্ব, বিশাল ব্যয়, দুর্নীতি, স্বচ্ছতার অভাব, আদালতের কাজে প্রযুক্তির সীমিত, অনিরাপদ এবং অপরিকল্পিত ব্যবহার; আদালতে মামলা এবং নথি ব্যবস্থাপনায় সীমাবদ্ধতা, মামলাসংশ্লিষ্ট পক্ষের নানাবিধ ভোগান্তি ও হয়রানি, অপরাধ প্রমাণে অপর্যাপ্ততা প্রভৃতি। দেশের বিচারব্যবস্থায় আইনি প্রযুক্তির অপর্যাপ্ত এবং অপরিকল্পিত ব্যবহার পরিস্থিতি আরও নাজুক করে তুলেছে। ফলস্বরূপ, বর্তমান বিচারব্যবস্থাকে জনমুখী ও সেবাধর্মী করতে প্রয়োজন প্রাচীন ঔপনিবেশিক ধাঁচের বিচারব্যবস্থা রূপান্তর করে আদালতের সব স্তরে ও কার্যক্রমে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সংমিশ্রণ ঘটিয়ে নাগরিকের আদালতকেন্দ্রিক পরিষেবাসমূহ সুলভে, স্বল্প সময়ে ও শ্রমে, স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহি নিশ্চিত করে প্রদান করা। ইন্টারনেট ব্যবহারে বিস্তৃতি, আদালতকেন্দ্রিক আধুনিক প্রযুক্তির উন্নতি ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসংবলিত প্রযুক্তি সরঞ্জামাদি ইত্যাদির চরম অগ্রগতি বিশ্বজুড়ে এখন আদালতব্যবস্থা আগের তুলনায় দক্ষ এবং দ্রুত বিচারিক সেবা প্রদান করতে সহায়তা করছে।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার বিচার বিভাগ সংস্কারের জন্য একটি কমিশন গঠন করেছে এবং কমিশন ইতোমধ্যে সরকারের কাছে তাদের সংস্কার প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। যদিও সংস্কার প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়ন এখন রাজনৈতিক দল এবং অন্যান্য অংশীজনের মধ্যে জাতীয় ঐকমত্যের ওপর নির্ভর করছে। তবে বাংলাদেশে বিচারসংক্রান্ত পরিষেবাসমূহ জনগণের কাছে সহজপ্রাপ্য করার জন্য অবিলম্বে মামলা-মোকদ্দমার সকল পর্যায়ে আইনি প্রযুক্তির ব্যাপক সংমিশ্রণ ও আশু প্রচলন প্রয়োজন।
সব আদালতে এবং মামলার সকল পর্যায়ে আইনি প্রযুক্তির ব্যবহার একদিকে যেমন মানুষের মধ্যস্থতা ও হস্তক্ষেপ হ্রাস করে দুর্নীতি কমিয়ে স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহি বৃদ্ধি করতে সহায়তা করবে; অন্যদিকে মামলা-মোকদ্দমার জটিল প্রক্রিয়া জনগণের জন্য অপেক্ষাকৃত সহজ, দ্রুত ও সাশ্রয়ী করে তুলবে। ফলে আপামর জনগণের কাছে আদালতের সামগ্রিক পরিষেবাসমূহ সহজতর হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হবে এবং বিচার বিভাগের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করবে। আদালতের কাজে আইনি প্রযুক্তির উপযোগিতা ইতোমধ্যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিচারব্যবস্থায় সফলভাবে প্রমাণিত হয়েছে এবং প্রযুক্তির ব্যবহার এখন আধুনিক বিচারব্যবস্থার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে।
২০২০ সালে দুনিয়াব্যাপী কোভিড-১৯ লকডাউনের কারণে যখন আদালতব্যবস্থা প্রায় অচল হয়ে পড়েছিল; তখন মহামারিসংক্রান্ত বিধিনিষেধ মোকাবিলায় প্রযুক্তির ব্যাপক প্রয়োগ ন্যায়বিচার নিশ্চিতে এবং আদালতে মামলা পরিচালনার প্রতিবন্ধকতাসমূহ উত্তরণে নতুন দরজা উন্মোচিত করেছিল। ঠিক একইভাবে বাংলাদেশও সে মুহূর্তে আদালতপ্রাঙ্গণে আইনি প্রযুক্তির আশীর্বাদ প্রত্যক্ষ করেছিল। আদালতে তথ্য ও প্রযুক্তির ব্যবহার অধ্যাদেশ, ২০২০ (পরবর্তীকালে সংসদের অনুমোদন পাওয়া আদালত কর্তৃক তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার আইন, ২০২০) জারি করে আদালতের দৈনন্দিন কাজে আইনি প্রযুক্তি একীভূতকরণে এক ধাপ এগিয়ে ছিল। পরবর্তী সময়ে এটুআই প্রকল্পের আওতায় সরকারি অন্যান্য সেবা যেমন ব্যাংকিং সেবা, ভূমিসংক্রান্ত, পাসপোর্ট বিবিধ ক্ষেত্রে বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও প্রযুক্তি ব্যবহারের সুফল দৃশ্যমান। সে তুলনায় বিচার বিভাগে প্রযুক্তির ব্যবহার সীমিত।
বর্তমানে বিচার বিভাগে আইনি প্রযুক্তির সীমিত ব্যবহার রয়েছে; যেমন সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে (https://www.supremecourt.gov.bd) উচ্চ আদালতের মামলার প্রাত্যহিক কার্যতালিকা (কজলিস্ট), মামলার রায় ও আদেশ, বিভিন্ন প্রশাসনিক বিজ্ঞপ্তি, আদেশ ও সার্কুলার নিয়মিত প্রকাশ, মামলা অনুসন্ধান, আদালতের অবস্থান সন্ধান ইত্যাদি ব্যবস্থা রয়েছে। তবে সুপ্রিম কোর্টের কজলিস্ট কাগজেও নিয়মিত ছাপা হচ্ছে এবং আইনজীবীরা অভ্যাসগত কারণে ই-কজলিস্টের তুলনায় কাগজে ছাপানো কজলিস্ট বেশি পছন্দ ও ব্যবহার করছেন। এর আগে একবার সুপ্রিম কোর্ট থেকে শুধু ই-কজলিস্ট রেখে কাগজে ছাপানো কজলিস্ট বন্ধ করার উদ্যোগ নেওয়া হলে আইনজীবীদের প্রতিবাদে তা সম্ভব হয়নি।
আদালতের অন্য প্রায় সব কাজে যেমন আর্জি, জবাব, আপিল বা আবেদন দাখিল, সমন/পরোয়ানা জারি, সাক্ষীর সাক্ষ্য লিপিবদ্ধকরণ, রায় বা আদেশ প্রদান, বিভিন্ন প্রতিবেদন তৈরি প্রভৃতি কাজে কাগজের প্রচুর ব্যবহার রয়েছে। তাই জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন ও পরিবেশ রক্ষায় সংবেদনশীল হতে চাইলে আদালতে কাগজের ব্যবহার সীমিত করে ই-কজলিস্ট, ই-ফাইলিং, ইলেকট্রনিক পদ্ধতিতে সমন প্রেরণের ব্যবস্থা গ্রহণ ও অন্যান্য কাজে ই-নথির বাধ্যতামূলক ব্যবহারের দিকে দ্রুত মনোযোগ বাড়াতে হবে। নতুবা আদালতের কাজে ব্যবহৃত বিশাল পরিমাণ কাগজের স্তূপ/ফাইল একদিকে যেমন বছরের পর বছর ধরে রক্ষণাবেক্ষণ করতে ব্যাপক পরিমাণ অবকাঠামো ও আসবাব প্রয়োজন; এ ছাড়া রয়েছে অগ্নিকাণ্ডে নষ্ট হওয়ার ঝুঁকি এবং ব্যয়বহুল ও ঝামেলাপূর্ণ ব্যবস্থাপনা; অন্যদিকে এ কাগজের পাহাড় থেকে নির্দিষ্ট নথি খুঁজে বের করা অত্যন্ত সময় ও শ্রম সাপেক্ষ এবং নানাবিধ দুর্নীতি উৎপাদনের উৎস। তা ছাড়া ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে বিচারিক (যেমন সাক্ষ্য লিপিবদ্ধকরণ, রায় লেখা) ও প্রশাসনিক (মোকদ্দমা দায়ের, বণ্টন) কার্য সম্পাদনের ফলে আদালতের মূল্যবান কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে এবং মামলাজট বাড়ছে।
এ ছাড়া আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীন আইন ও বিচার বিভাগের ওয়েবসাইটে (https://lawjusticediv.gov.bd) অধস্তন আদালতের বিচারকদের পদলি, পদোন্নতি, ভাতা, বিদেশ ভ্রমণের অনুমতি, বিভিন্ন নির্দেশনাসংবলিত বিজ্ঞপ্তি, মামলা প্রত্যাহারের তথ্য, জরুরি হেলপলাইন নম্বরসমূহ (যেমন নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ ১০৯, লিগ্যাল এইড হেলপলাইন ১৬৪৩০) প্রভৃতি প্রকাশ করা হয়।
তবে বিচার বিভাগকে আধুনিক ও ডিজিটাইজ করার লক্ষ্যে আরও কিছু প্রচেষ্টাসমূহ প্রশংসনীয় হলেও এর বেশ কিছু উদ্যোগ এখন নানাবিধ সীমাবদ্ধতা নিয়ে চলছে, কিছু উদ্যোগ প্রকল্পভিত্তিক হওয়ায় প্রকল্পের মেয়াদ শেষে এখন আর কার্যকর নেই এবং কিছু উদ্যোগ বিরাজমান বাধাসমূহ থেকে উত্তরণ ঘটাতে পর্যাপ্ত নয়। যেমন জনবল এবং পর্যবেক্ষণের অভাবে ই-কজলিস্ট কার্যক্রম বর্তমানে স্থবির। এ ছাড়া জুডিসিয়াল ড্যাশবোর্ড এবং ই-সার্টিফায়েড কপি প্রোগ্রামও বর্তমানে কার্যকর নেই। আবার বিচারপ্রার্থী এবং আইনজীবীদের জন্য মামলা ই-ফাইলিং বাধ্যতামূলক নয়। যার দরুন মামলাসংশ্লিষ্ট পক্ষ ও আইনজীবীরা ঐতিহ্য এবং অভ্যাসবশত কাগজনির্ভর ব্যবস্থায় ম্যানুয়ালি মামলা দায়ের ও অন্যান্য কার্য সম্পাদন করতে পছন্দ করেন। অথচ ইলেকট্রনিক পদ্ধতিতে মামলা-মোকদ্দমা ফাইলিং নিশ্চিত করা গেলে বিচারক ও আইনজীবীর পরিশ্রম অনেকাংশে লাঘব হতো, আদালতের কাজে গতি আসার পাশাপাশি দুর্নীতি কমে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি আনয়ন করা যেত।
বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতির আদালতের কাজে গতিশীলতা ও আধুনিকায়নের উদ্যোগের ফলে ২০২৫ সালে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের একটি বেঞ্চ হোয়াটসঅ্যাপভিত্তিক স্লিপ গ্রহণ ব্যবস্থা চালু করেছে। এ নতুন ব্যবস্থার আওতায় আপাতত মোশন ও সময় বৃদ্ধিসংক্রান্ত শুনানির আবেদনপত্র স্ক্যান করে একটি হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে পাঠাতে হবে এবং সেখান থেকে আইনজীবীদের আবেদনসমূহ গৃহীত হবে। তবে আদালতের কাজের মতো আনুষ্ঠানিক আইনি প্রক্রিয়ায় হোয়াটসঅ্যাপের মতো অনানুষ্ঠানিক পদ্ধতি ব্যবহারে নিরাপত্তাসহ নানাবিধ ঝুঁকি রয়েছে। তাই সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে অথবা ভিন্ন প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে অনলাইনভিত্তিক বাধ্যতামূলক ফাইলিং সিস্টেম চালু করতে পারলে আদালতের নথি ব্যবস্থাপনা, মামলা পরিচালনা, রায় লেখা ও প্রদান, মামলাসংক্রান্ত তথ্য আদানপ্রদান, বিচারপ্রার্থীকে মামলার তথ্য অবগতকরণসহ নানা ক্ষেত্রে জনবান্ধব এবং আমূল পরিবর্তন আনা সম্ভব। অন্যদিকে এ বছরের প্রারম্ভে হাইকোর্টের ভিন্ন আরেকটি বেঞ্চ মামলা পরিচালনায় কাগজবিহীন ব্যবস্থা প্রচলন করেছেন। যদিও এ ব্যবস্থাও এখন পর্যন্ত পুরোপুরি কাগজমুক্ত নয়।
দেশের বিচারব্যবস্থা ডিজিটাইজ করার জন্য স্বল্প বাজেট, অপর্যাপ্ত বিনিয়োগ এবং টেকসই পরিকল্পনার অভাব অন্যতম প্রধান বাধা। অধিকন্তু আইনি প্রযুক্তি সরঞ্জাম পরিচালনা করার জন্য যথাযথভাবে প্রশিক্ষিত ও দক্ষ আদালত কর্মীর স্বল্পতা; সুপ্রিম কোর্টের সরাসরি তত্ত্বাবধান ও পর্যবেক্ষণের অভাব; বিচারক, আইনজীবী এবং আদালত কর্মীদের আধুনিক প্রযুক্তিসংবলিত নতুন ব্যবস্থা সম্পর্কে অপরিচিততা ও অনভ্যাস; আইনজীবী, বিচারক এবং আদালত কর্মীদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ এবং প্রযুক্তিগত জ্ঞানের ঘাটতি; আইন শিক্ষা আধুনিকায়ন না হওয়া ও কারিকুলামে আইনি প্রযুক্তির ওপর জোরারোপ না করা; আদালতের কাজ শত বছর যাবৎ ম্যানুয়ালি পরিচালনা করার অভ্যাসগত প্রবণতা, দেশের সব প্রান্তে সার্বক্ষণিক বিদ্যুৎ ও শক্তিশালী ইন্টারনেট সংযোগের অনিশ্চয়তা, আধুনিক ডিভাইস ও উদ্যোগের অপর্যাপ্ততা, প্রযুক্তিনির্ভর দীর্ঘমেয়াদি ও টেকসই পরিকল্পনার অভাব, দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার মাধ্যমে পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন কাজে প্রযুক্তির ব্যবহার বাধ্যতামূলক না করাসহ প্রভৃতি কারণে বিচার বিভাগের ডিজিটাইজেশন দীর্ঘায়িত হচ্ছে এবং বিচারপ্রার্থীদের ভোগান্তির পরিসমাপ্তি হচ্ছে না।
আমরা মনে করি, বাধ্যতামূলক ই-ফাইলিং সিস্টেম চালু, ই-সমন/পরোয়ানা জারির ব্যবস্থা, ভিডিও/ভার্চুয়াল কোর্টরুম, তদন্তব্যবস্থায় আধুনিকায়ন, পর্যাপ্ত আধুনিক ল্যাব স্থাপন, ই-মামলা ও আদালত ব্যবস্থাপনা, কারাগার থেকে আসামিদের ভিডিও/দূরবর্তী উপস্থিতি, আসামিদের ই-প্রোফাইল তৈরি, কোভিড সময়ের মতো দূরবর্তী শুনানির ব্যবস্থা চালু রাখা, সাক্ষীদের সাক্ষ্য ডিজিটাল রেকর্ডের মাধ্যমে গ্রহণ, আদালতের নির্দিষ্ট কার্যক্রমে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রয়োগ, ডিজিটাল ডেটা শেয়ারিং, রেকর্ড অ্যাকসেস এবং বিনিময় প্রকল্পের মাধ্যমে অন্যান্য সংস্থা যেমন ভূমি প্রশাসনের সঙ্গে ইলেকট্রনিকভাবে নথি আদানপ্রদান ও সহযোগিতা, তথ্য যাচাই, অনলাইন বিরোধ নিষ্পত্তি প্রভৃতি উদ্যোগ ডিজিটাইজেশন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত এবং ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের পর বিচার বিভাগ সত্যিকার অর্থে জনগণের প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে পারে।