সম্পাদকীয়
প্রকাশ : ২১ এপ্রিল ২০২৫ ১৬:০২ পিএম
চট্টগ্রামের মানুষের এখন নিয়তিই যেন বৃষ্টি হলেই নালায় পড়ে মৃত্যু। ছয় মাসের শিশু সেহলিজের মৃত্যু খাল-নালা নিরাপদ করার প্রসঙ্গটি আবার সামনে এসেছে। নিখোঁজ হওয়ার ১৪ ঘণ্টা পর গত শনিবার সকালে চাক্তাই খাল থেকে উদ্ধার হয় তার নিথর দেহ। প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এ প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, গত শুক্রবার রাত ৮টার দিকে কাপাসগোলার হিজড়া খালে তলিয়ে যায় সে। উদ্ধারযজ্ঞ হলেও তাকে খালে জমে থাকা ময়লার স্তূপ সরিয়ে ডুবুরিরা খুঁজে পাননি। পরে প্রায় চার কিলোমিটার দূরের চাক্তাই খালে ভেসে ওঠে তার মরদেহ।
প্রশ্ন হলো নিখোঁজ ছয় মাস বয়সি শিশুর মৃত্যুর পরও কি আমাদের সংবিৎ ফিরবে না? নগরীর খাল-নালা নিরাপদ করার দায়িত্ব যাদের বা যেসব সংস্থারÑ আমাদের প্রশ্ন তারা কি তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করছে? এভাবে আর কত দিন? খাল-নালায় পড়ে আর কত প্রাণ ঝরবে? খালের পাশে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তাবেষ্টনী লাগানো হবে না কেন। এভাবে প্রতিটি মৃত্যুর পর একই দাবিইবা তুলতে হবে কেন? বন্দরনগরীর খাল-নালায় পড়ে এমন করুণ মৃত্যুর ঘটনা তো এই প্রথম নয়। ২০ এপ্রিল প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এ প্রকাশিত প্রতিবেদন বলছে, গত তিন বছরে এভাবে ১১ জনের মৃত্যু হয়েছে। অন্য একটি পরিসংখ্যান বলছে, গত ছয় বছরে বন্দরনগরে খাল-নালায় পড়ে অন্তত ১৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। যাদের মাঝে ২০২০ সালে দুজন, ২০২১ সালে পাঁচ, ২০২৩ সালে তিন, ২০২৪ সালে তিন ও চলতি বছর একজন। নগরীর মহেশখালে পড়ে মুন্নি আক্তার ও ঝুমা আক্তার নামের দুই কিশোরীর মৃত্যু হয় ২০২০ সালে। ২০২১ সালে মেয়রগলি এলাকায় চশমা খালে পড়ে অটোরিকশাচালক ও এক যাত্রীর মৃত্যু হয়। ওই বছরেই চশমা খালে পা পিছলে পড়ে তলিয়ে যান সবজি বিক্রেতা ছালেহ আহমেদ। আজও তার মরদেহ পাওয়া যায়নি। এরপর একই খালে তলিয়ে যাওয়া শিশু মো. কামাল উদ্দিনের মহদেহ উদ্ধার হয় তিন দিন পর। এ ছাড়া একই বছর নগরের আগ্রাবাদের মাজারগেট এলাকায় ফুটপাত থেকে পা পিছলে নালায় পড়ে মারা যান বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী শেহেরীন মাহমুদ সাদিয়া। সর্বশেষ চলতি বছরের ১৮ এপ্রিল প্রাণ হারাল শিশু সেহলিজ।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের হিসাব অনুযায়ী, নগরের ৪১ ওয়ার্ডে খাল-নালা রয়েছে ১ হাজার ১৩৭ কিলোমিটার। এর মধ্যে নিরাপত্তাবেষ্টনী ছাড়া খালের পাড় রয়েছে প্রায় ১৯ কিলোমিটার। উন্মুক্ত নালা রয়েছে ৫ হাজার ৫২৭টি স্থানে। এসবের বেশিরভাগ নালাতে নিরাপত্তাবেষ্টনীর কাজ হয়নি। ফলে দুর্ঘটনার আতঙ্ক নিয়েই চলাফেরা করতে হয় এলাকাবাসীকে।
নালায় নিরাপত্তাবেষ্টনী না থাকা, বৃষ্টি হলে জলাবদ্ধতার কারণে রাস্তা-নালা আলাদা করতে না পারা ও নালায় আবর্জনার স্তূপ জমে থাকাই এমন ট্র্যাজেডির কারণ। খালের পাড়ে নিরাপত্তাবেষ্টনী নিয়ে বিভিন্ন সময় কথা হলেও এটি বাস্তবায়িত হচ্ছে না। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন কিংবা চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ কেউ এর দায়ও নিচ্ছে না। কিন্তু আমরা মনে করি, এমন করুণ মৃত্যুর দায় চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন এবং চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ এড়াতে পারে না।
প্রত্যেকটি মৃত্যুর পর কিছুদিন আলোচনা চলে। সংবাদমাধ্যমে লেখালেখি হয়। কোথাও কোথাও স্ল্যাব ও নিরাপত্তাবেষ্টনী বসানোর কাজও চলে। তারপরই যেন থেমে যায় সব। কারণ প্রতি বছর এভাবে মৃত্যুর ঘটনা ঘটলেও নগরীর খাল ও নালার বড় অংশই এখনও উন্মুক্ত। সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, যদি কোথাও নিরাপত্তাবেষ্টনী, স্ল্যাব বসানো হয়েছে। তার পরও অধিকাংশ স্থানই খালি পড়ে আছে, সেসব স্থানে নেই স্ল্যাব বা নিরাপত্তাবেষ্টনী। এটি শুধু বন্দরনগরীরই সমস্যা নয়। রাজধানীতেও অনেক খালে নেই স্ল্যাব ও নিরাপত্তাবেষ্টনী। ফলে ভারী বৃষ্টিতে খাল-নালাগুলো ফুলে-ফেঁপে ওঠে। সড়ক ও খাল পানিতে একাকার হয়ে যায়। এতে কোনটি খাল, কোনটি সড়ক, তা বোঝার উপায় থাকে না। এতে ঘটে দুর্ঘটনা।
আমরা মনে করি, অবিলম্বে খাল-নালার অরক্ষিত অংশগুলো চিহ্নিত করে নিরাপত্তাবেষ্টনী ও স্ল্যাব বসানোর উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। যেসব স্থানে স্ল্যাব ও নিরাপত্তাবেষ্টনী রয়েছে, সেগুলোর যথাযথ সংরক্ষণের পাশাপাশি কোথাও স্ল্যাব সরে গেলে সেগুলোও পুনঃস্থাপনের উদ্যোগ নিতে হবে। খাল-নালা নিরাপদ করতে প্রয়োজনে আলাদা প্রকল্পও আমরা হাতে নিতে বলি, যাতে নালা-খালে পড়ে আর যেন কারেও মৃত্যু না হয়।