পরিবেশ
শেলী সেনগুপ্তা
প্রকাশ : ২১ এপ্রিল ২০২৫ ১৫:৫৮ পিএম
শেলী সেনগুপ্তা
যখন আমরা দেশের মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধির হিসাব করছি, ঠিক তখনই আমাদের সামনে হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে বায়ুদূষণের ভয়াবহ পরিণতি। শুধু বাংলাদেশই নয়, বিশ্বের অনেক দেশেই এমন দূষণের মাত্রা বেড়েছে। প্রতিদিন ময়লা, ধুলোবালি, কালো ধোঁয়া, নির্মাণাধীন ভবন থেকে নিঃসৃত ধুলো আমাদের জনজীবন ক্ষতিগ্রস্ত করছে। বাড়ছে শ্বাসকষ্টসহ নানা জটিল রোগ এবং মানসিক সমস্যাও। এর ফলে হতে পারে মরণব্যাধি ক্যানসার, হাঁপানি এবং মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ। এর ফলে প্রজননস্বাস্থ্যেরও ক্ষতি হচ্ছে। জন্মের পর শিশুরাও ভোগে নানা দুরারোগ্য ব্যাধিতে।
আমরা জানি, বায়ুদূষণের প্রধান তিনটি উৎস ইটভাটা, যানবাহনের কালো ধোঁয়া ও নির্মাণকাজের আবর্জনা। এর সঙ্গে আরও রয়েছে কলকারখানা এবং মানবসৃষ্ট নানা ধরনের বায়ুদূষণ। আমাদের প্রিয় শহর ঢাকা এখন ভুগছে কিছু মানবসৃষ্ট দূষণে। দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের তিলোত্তমা ঢাকাকে নিয়ে বিভিন্ন সময় আন্তর্জাতিক সমীক্ষা ও গবেষণায় নেতিবাচক চিত্র উঠে এসেছে। তকমা পেয়েছে বসবাস-অযোগ্য শহরের। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পরিবেশগত নানা ধরনের বিপদের আশঙ্কা। ঢাকা এখন ভূমিকম্প আশঙ্কার শহর হয়ে উঠেছে। এর মধ্যে অনেকবার স্বল্পমাত্রার ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। যদি এ মাত্রা আরও বেশি হয় তাহলে ঢাকা শহর ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া থেকে কেউ রোধ করতে পারবে না। অথচ ভূমিকম্পজনিত দুর্ঘটনায় অতি জনঅধ্যুষিত আবাসনের বাহুল্যের কারণে ঠিকমতো উদ্ধারকাজও করা যাবে না। তাই বিষয়টি নিয়ে এখনই ভাবা প্রয়োজন।
শহরের সৌন্দর্য বাগান। যে শহরে যত বেশি বাগান থাকে সে শহর তত বেশি সুন্দর এবং পরিবেশগত দিক থেকে সমৃদ্ধ। ঢাকা শহরে প্রচুর বহুতল ভবন আছে। ভয়াবহ তাপের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য এসব ভবনের ছাদে বাগান করা যায়। ছাদবাগানের কারণে ভবনে স্বল্পপরিমাণ তাপ প্রবেশ করে, বিদ্যুৎ ব্যবহার কমে এবং ভবনের বাসিন্দাদের জন্য আরামদায়ক পরিবেশ তৈরি হয়। ছাদবাগানের গাছপালা নিকটবর্তী এলাকার তাপমাত্রাও কমাতে বেশ বড় ভূমিকা পালন করতে পারে। এটি অনেক শান্তির ও আনন্দের। এ বিষয়ে মানুষ যথেষ্ট উৎসাহিত হচ্ছে। তাই আজকাল ঢাকার অধিকাংশ বাড়িতে ছাদবাগান দেখা যাচ্ছে। এটি পরিবেশ সুন্দর করার সঙ্গে সঙ্গে পারিবারিক সবজি উৎপাদনের ক্ষেত্র হিসেবেও ব্যবহৃত হচ্ছে। বিকালের বেশ কিছু সময় বাগানের মালিকরা এখানে আনন্দময় সময় কাটায়। বাড়ির অনেকেই সকাল-বিকাল এখানে হাঁটাহাঁটি করে। বাড়ির অনেক অনুষ্ঠান এ মনোরম পরিবেশে উদ্যাপন করা হয়।
তবে আনন্দের পাশাপাশি নতুন করে গজিয়ে উঠেছে কিছু দুশ্চিন্তা। যেখানে থাকা দরকার ছিল ফুল ও ফলের মনোমুগ্ধকর বাগান, সেখানে বাগান নেই, আছে মেকি সৌন্দর্য ও আনন্দের বাতাবরণ। আজকাল রাজধানীর বহুতল ভবনগুলোর ছাদে বেশ কিছু রেস্তোরাঁও স্থাপিত হয়েছে। এর মধ্যে বেশিরভাগই অননুমোদিত। এসব রেস্তোরাঁয় প্রতিদিন উচ্চতাপে রান্না করা হয়। তা ছাড়া সাজানোও হয় প্লাস্টিক জাতীয় দাহ্য বস্তু, কাচ ও বাঁশ-কাঠ ইত্যাদি দিয়ে। তাতে তীব্র বায়ুপ্রবাহ হলে যেকোনো সময় নানা দিকে আগুন ছড়িয়ে পড়তে পারে। অনেক সময় অগ্নিনির্বাপকব্যবস্থা নেওয়ারও উপায় নেই। যানজটসহ নানা প্রতিবন্ধকতায় ফায়ার ব্রিগেড যথাসময়ে দুর্ঘটনাস্থলে পৌঁছাতেও পারে না। কারণ দেশে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ইমারত নির্মাণ বিধিমালা অনুসরণ করে নির্মিত হয় না। তার ওপর গোদের ওপর বিষফোড়ার মতো ছাদরেস্তোরাঁ। এসব ছাদরেস্তোরাঁ পরিচালনা করা হয় সম্পূর্ণ অনিরাপদভাবে। ফলে এগুলো ভয়াবহ অগ্নিঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। অথচ নানা কারণে প্রতিটি ভবনের ছাদ উন্মুক্ত রাখা উচিত। ঢাকার বহুতল ভবনের উন্মুক্ত ছাদে আপদকালে মানুষ আশ্রয় নিতে পারে। প্রয়োজনে ছাদে হেলিকপ্টার নামিয়ে বিপদগ্রস্ত মানুষ উদ্ধার করা যায়। কিন্তু রেস্তোরাঁ হয়ে গেলে তা আর সম্ভব হবে না। তা ছাড়া ছাদে নির্মিত রেস্তোরাঁ থেকে যেকোনো সময় আগ্নিকাণ্ডের সূচনা হতে পারে, এসব রেস্তোরাঁর রান্নাঘরগুলো অগ্নিনিরাপত্তাহীন।
আমরা জানি, ঢাকায় অনেক ছাদরেস্তোরাঁয় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় মৃত্যুসহ অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। সময় এসেছে এসব দুর্ঘটনার কথা সামনে নিয়ে আসা, যেন অন্যরা সচেতন হতে পারে। ঢাকা শহরে এ পর্যন্ত অনুমোদিত ও অননুমোদিত ২০০টির অধিক ছাদরেস্তোরাঁর কথা সংবাদমাধ্যমে এসেছে। এ কথাও ঠিক, বর্ধিত জনগোষ্ঠীর চাহিদা অনুযায়ী এর সংখ্যা দিনে দিনে আরও বাড়ছে। আজকাল মানুষ বিনোদনের জন্য এসব রেস্তোরাঁয় যায়। কিন্তু এ কথাও মনে রাখা দরকার, নিরাপত্তার বিকল্প কখনোই বিনোদন হতে পারে না। সবার দরকার ভালো থাকা, আনন্দে থাকা তবে তা যেন হয় নিরাপদ ও নিষ্কণ্টক। মনে রাখতে হবে, এক একটি ভুলের সঙ্গে জড়িয়ে আছে অনেকের জীবন, একটি মৃত্যু একটি পরিবার ধ্বংস করে দিতে পারে। তাই দেশের মানুষকে সাময়িক বিনোদন দেওয়ার জন্য বিপজ্জনক এসব রেস্তোরাঁ প্রতিষ্ঠা এবং পরিচালনার বিষয়টি নিয়ে দ্বিতীয়বার ভাবা দরকার। সঠিক সিন্ধান্ত ও পরিকল্পনার মাধ্যমে বিকল্প ও নিরাপদ বিনোদনের ব্যবস্থাও করা যায়। দরকার শুধু প্রত্যাশা এবং প্রচেষ্টা।
এ দেশ আমাদের, এ দেশের প্রতিটি অংশের গর্বিত অধিকারী আমরা অর্থাৎ নাগরিকরা। তাই প্রত্যেক নাগরিকের দায়িত্ব আমাদের প্রিয় এ শহর, প্রিয় দেশ দূষণমুক্ত ও নিরাপদ রাখতে ভূমিকা রাখা এবং অন্যদেরও এ প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত করতে হবে। এ দায়িত্ব সবার।
প্রাচীন মেসোপটেমিয়ার জিগুরাটদের জমির উপরের ছাদে গাছ এবং গুল্ম রোপণের পর থেকে মানুষ কাঠামোর উপরে গাছপালা জন্মাচ্ছে। রোমান আমলে এর একটি উদাহরণ ছিল পম্পেইতে অবস্থিত ভিলা অফ দ্য মিস্ট্রিজ , যেখানে একটি উঁচু ছাদ ছিল যেখানে গাছপালা জন্মানো হত। রোমান-বাইজেন্টাইন সিজারিয়ায় একটি দর্শক হলের চারপাশে একটি ছাদের বাগানও আবিষ্কৃত হয়েছে। মধ্যযুগীয় মিশরীয় শহর ফুস্তাতে বেশ কয়েকটি উঁচু ভবন ছিল যার উপরের তলায় ছাদের বাগান ছিল সেচের জন্য বলদ-টানা জলের চাকা দিয়ে পূর্ণ।
কানাডার জাতীয় গবেষণা পরিষদের একটি গবেষণায় তাপমাত্রার তুলনায় বাগানযুক্ত ছাদ এবং বাগানবিহীন ছাদের মধ্যে পার্থক্য দেখানো হয়েছে। গবেষণায় দিনের বিভিন্ন সময়ে প্রতিটি ছাদের বিভিন্ন স্তরের উপর তাপমাত্রার প্রভাব দেখানো হয়েছে। বাগানবিহীন ছাদের উপর তাপমাত্রার প্রভাব কমাতে ছাদের বাগান স্পষ্টতই খুবই উপকারী। গবেষণায় বলা হয়, যদি ব্যাপকভাবে গৃহীত হয়, তাহলে ছাদের বাগানগুলি নগর তাপ কমাতে সহায়ক হবে। এজন্য সরকারিভাবে এবং বেসরকারিভাবে জনগণের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। সাধারণকে বোঝাতে হবে নিরাপত্তার গুরুত্ব বিষয়ে। বোঝাতে হবে ছাদে রেস্তোরাঁ নয়, ফুল ও ফলের গাছ বেশি শোভা বাড়ায়। এ কাজটি সবাই মিলেমিশে করতে হবে, সবাইকে আনন্দের সঙ্গে এগিয়ে আসতে হবে।
এজন্য প্রয়োজনে নতুন আইন তৈরি করতে হবে এবং ব্যক্তিগত ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর কঠোরভাবে এ আইন প্রয়োগ করতে হবে। এ বিষয়ে আমাদের দেশের স্কুল-কলেজ এবং মহল্লায় প্রচারের ব্যবস্থা রাখতে হবে। গণমাধ্যমেও এ বিষয়ে প্রচারের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রত্যেকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে নিজ নিজ কাজে সচেতন হলে আমরা পেতে পারি দূষণমুক্ত ও নিরাপদ বাংলাদেশ।
তাই এ দেশের আনাচকানাচে প্রতিটি বহুতল ভবনের ছাদে ছাদে ফুল ও ফলের বাগান করার জন্য সচেতনতা বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। তবেই আমরা পেতে পারি সুখী ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ।