বাণিজ্য
নিরঞ্জন রায়
প্রকাশ : ১৮ এপ্রিল ২০২৫ ১৯:১৪ পিএম
নিরঞ্জন রায়
গত সপ্তাহে দেশে বেশ ঘটা করে বিনিয়োগ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। বর্তমান সময়ে এ বিনিয়োগ সম্মেলন অনেক দিক থেকেই তাৎপর্যপূর্ণ। কেননা দেশে সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে গেছে এমন দাবি করার সময় এখনও আসেনি। সবচেয়ে বড় কথা দেশের ব্যবসাবাণিজ্য এক ধরনের চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়েই চলেছে। ব্যবসায়ী সম্প্রদায় এবং উদ্যোক্তা শ্রেণি এখনও অনিশ্চয়তার মধ্যে আছেন এবং কোনোরকম বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না। দেশের ব্যাংকিং খাতও বেশ খারাপ অবস্থার মধ্য দিয়ে চলেছে। সার্বিকভাবে অর্থনৈতিক খাতে এখনও গতি আসেনি। এ রকম অবস্থায় বিনিয়োগ সম্মেলন হয়তো কিছুটা হলেও আশার সঞ্চার করতে পারে। সরকার যে দেশের ব্যবসাবাণিজ্য, ব্যাংকিং ও আর্থিক খাত এবং অর্থনীতির বিষয়গুলো নিয়ে ভাবছে এবং কিছু একটা করতে চায়, এমন ইঙ্গিত অন্তত এ বিনিয়োগ সম্মেলন থেকে পাওয়া যাবে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য কি ঘটা করে বিনিয়োগ সম্মেলনের প্রয়োজন আছে? এ প্রশ্নের উত্তর হয়তো দুই ভাবেই হতে পারে। প্রথমত ‘প্রচারে প্রসার’ যেমন বর্তমান যুগের প্রধান স্লোগান, সেখানে এ ধরনের ব্যাপক আয়োজনের প্রয়োজন নিশ্চয়ই আছে বলে অনেকে মনে করেন। আমরা যদি বিনিয়োগের সুবিধাদি সঠিকভাবে তুলে ধরতে না পারি, তাহলে বিশ্বের বিনিয়োগকারীরা জানবেনই বা কীভাবে এবং সে ক্ষেত্রে বিনিয়োগ আসবে কোথা থেকে? তাছাড়া বিনিয়োগ সম্মেলনে তাৎক্ষণিক কিছু বিনিয়োগ প্রস্তাব পাওয়া যায়। এবারের বিনিয়োগ সম্মেলনেও ৩ হাজার ১০০ কোটি টাকার মতো বিনিয়োগ প্রস্তাব পাওয়া গেছে বলে সংবাদমাধ্যম থেকে জানা গেছে। ঘটা করে বিনিয়োগ সম্মেলনের এটাই আপাতত বড় প্রাপ্তি।
সমাজে আরও একটি অংশ আছেন যারা মনে করেন বর্তমান বিশ্ব একটি গ্লোবাল ভিলেজে পরিণত হয়েছে, যেখানে অবাধ তথ্যের প্রবাহ আছে। এখন সবার কাছেই সবরকম তথ্য আছে। মুহূর্তের মধ্যে জানা যায় বিশ্বের কোথায় কী ঘটছে। একইভাবে বিশ্বের কোন কোন দেশে কী ধরনের বিনিয়োগ সুবিধা আছে এবং সেখানে বিনিয়োগ করতে গেলে কী ধরনের চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়তে হবে, তার সবকিছু এখন মানুষের হাতের মুঠায়। সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে যেসব ঝুঁকি থাকে, তার মাত্রা কোন দেশে কী রকম সেগুলোও আজ মানুষের, বিশেষ করে যারা বিনিয়োগ নিয়ে কাজ করেন, তাদের একেবারে নখদর্পণে। এই যেখানে বিশ্বব্যবস্থা, সেখানে ঘটা করে বিনিয়োগ সম্মেলন করে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে খুব বেশি সুবিধা করার সুযোগ আছে বলে মনে হয় না। উল্টো অনেক ক্ষেত্রে হিতে বিপরীত হতে পারে। কেননা অবাধ তথ্যপ্রবাহের যুগে সবার কাছে সব তথ্য সঠিকভাবেই আছে। এখন এ বিনিয়োগ সম্মেলন থেকে যদি এমন কোনো তথ্য প্রদান করা হয়, যা বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, তাহলে বিনিয়োগকারীরা উদ্বিগ্ন হতে পারেন। তখন স্বচ্ছতা ও সততার অভাবে বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত নেওয়া থেকে দূরে থাকতে পারেন। যেমন আমরা যদি উল্লেখ করি যে, আগামী ১০ বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার ট্রিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে। কিন্তু অর্থনীতির বিভিন্ন উপাদন এবং সূচক, যা বিশ্বের বিনিয়োগকারীদের কাছে আছে, তা যদি ট্রিলিয়ন ডলারের দাবি সমর্থন না করে, তাহলে বিনিয়োগকারীরা এ তথ্যে বিচলিত হবেন এবং এ ধরনের পরিবেশে বিনিয়োগ করা ঝুঁকিপূর্ণ মনে করবেন। এ রকম তথ্যবিভ্রাটের কারণেই লাতিন আমেরিকার অন্যান্য দেশের তুলনায় আর্জেন্টিনায় বিদেশি বিনিয়োগ সেভাবে নেই বললেই চলে।
তাছাড়া বর্তমান বিশ্বে বিনিয়োগকারীরা উপযুক্ত বিনিয়োগ স্থান খুঁজে বেড়ান। ইমারজিং মার্কেটের (চীন, ভারতসহ এশিয়ার বিশাল অঞ্চল) বিনিয়োগকারীরা খুব সহজেই বিনিয়োগ করেন লাতিন আমেরিকার অনেক দেশে, যেমন চিলি, পেরু, উরুগুয়ে, কলম্বো, মেক্সিকো। কারণ এসব দেশ বিদেশি বিনিয়োগের জন্য ভালো ক্ষেত্র প্রস্তুত করে রেখেছে। আবার পশ্চিমা বিশ্বের অনেক দেশ, যেমন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা এবং ইউরোপের অনেক দেশের বিনিয়োগকারী এশিয়ার বিভিন্ন দেশে বিনিয়োগ করেছেন এবং এখনও করেন। এমনকি জাপানের গাড়ির কোম্পানি মেক্সিকো ও কলম্বোতে বিনিয়োগ করে সেখানে গাড়ি উৎপাদনের প্লান্ট গড়ে তুলেছে। সেসব প্লান্টে উৎপাদিত গাড়ি লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশে বাজারজাত করে। এভাবেই এখন বিশ্বে বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগের জন্য উপযুক্ত স্থান খুঁজে নিয়ে বিনিয়োগ করে থাকেন। এ কারণেই ভালো বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে হলে বিনিয়োগের জন্য উপযুক্ত ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে হবে সবার আগে। সেই সঙ্গে বিনিয়োগের যে ঝুঁকি থাকে, তা যথাযথভাবে লাঘবের ব্যবস্থা করতে হবে।
যেকোনো বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সব সময়ই কিছু ঝুঁকি থাকে। আর এ ঝুঁকির ধরন এবং মাত্রা একেক অঞ্চলে একেক রকম হয়। আমেরিকা, কানাডা এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে যে ধরনের ঝুঁকি থাকে, তা ইমারজিং মার্কেটে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে থাকে না। আবার ইমারজিং মার্কেটে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে যে মাত্রার ঝুঁকি থাকে, তা উন্নত দেশে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে থাকে না। যেমন আমেরিকা, কানাডা এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশে কমপ্লায়েন্স বা আইন ও বিধিবিধান মেনে চলার বাধ্যবাধকতার যে ঝুঁকি, তা সর্বোচ্চ মাত্রার। এখানে বিনিয়োগ করার ক্ষেত্রে নিয়ম মেনে চলার ব্যাপারে শতভাগ নিশ্চয়তা থাকতে হবে। সানান্য ব্যত্যয় ঘটলেও বড় অঙ্কের জরিমানা গুনতে হবে। বিশ্বের অনেক নামিদামি কোম্পানির এ রকম বিশ্বাল অঙ্কের জরিমানা গুনতে গিয়ে ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। কমপ্লায়েন্স ব্যর্থতায় বিশাল অঙ্কের জরিমানা প্রদানের ঝুঁকি ইমারজিং মার্কেটে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সেভাবে নেই। কিন্তু সেখানে আছে মারাত্মক রাজনৈতিক এবং আর্থিক খাতের ঝুঁকি।
আমাদের দেশেও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এ দুটি ঝুঁকি, অর্থাৎ রাজনৈতিক এবং আর্থিক খাতের ঝুঁকি সব সময়ই বেশি। আমরা স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দীর বেশি সময় পার করলেও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা সেভাবে নিশ্চিত করতে পারিনি। অন্তত ব্যবসাবাণিজ্য রাজনীতির প্রভাবমুক্ত রাখা এবং সরকার প্রবর্তনের প্রভাব থেকে দেশের ব্যবসাবাণিজ্য সেভাবে দূরে রাখতে পারিনি। ফলে আমাদের দেশে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ঝুঁকি সব সময়ই অনেক বেশি থাকে। এ ঝুঁকি অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বর্তমানে অনেক বেশি। অন্তর্বর্তী সরকার দেশের শাসনক্ষমতায়। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদকাল কতদিন হবে, সেটি এখন পর্যন্ত পরিষ্কার নয়। নির্বাচন করে নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের বিষয়টি একেবারেই পরিষ্কার নয়। দেশের বিনিয়োগ বাড়াতে হলে এ বিষয়টি পরিষ্কার করতে হবে।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার যদি মনে করে তাদের মতে দেশের সবকিছু ঠিকঠাক করতে হলে তাদের পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকতে হবে, তাহলে সেটিও নির্দিষ্ট করে দেশবাসীকে জানানো প্রয়োজন। আবার বর্তমান সরকার যদি মনে করে যে খুব শিগগিরই দেশে নির্বাচন দিয়ে নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে। তাহলে সেটিও নির্দিষ্ট করে বলা প্রয়োজন। সেই সঙ্গে এও পরিষ্কার করা প্রয়োজন যে কীভাবে সে নির্বাচন হবে। এসব বিষয় যখন পরিষ্কার করে জানানো হবে, তখন বিনিয়োগের রাজনৈতিক ঝুঁকি অনেকটাই লাঘব হবে। কেননা বিনিয়োগকারীরা এসব বিষয় জানার কারণে রাজনৈতিক ঝুঁকির মাত্রা সঠিকভাবে নিরূপণ করতে পারবেন এবং সে অনুযায়ী বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত নেবেন।
রাজনৈতিক ঝুঁকির পরেই যে ঝুঁকিটা বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হিসেবে দেখা হয়, তা হচ্ছে আর্থিক খাতের ঝুঁকি। বলার অপেক্ষা রাখে না যে আমাদের দেশে আর্থিক খাতের ঝুঁকির মাত্রা সর্বোচ্চ। আর্থিক খাতের মাত্রাতিরিক্ত ঝুঁকির কারণেই আমাদের দেশে বিনিয়োগে গতি আসে না। বিদেশি বিনিয়োগ তো অনেক পরের কথা, দেশি বিনিয়োগও সেভাবে হচ্ছে না শুধু আর্থিক খাতের দুর্বলতার কারণে। আমাদের দেশে ব্যাংকিং খাতের খুবই খারাপ অবস্থা। যদিও ব্যাপকভিত্তিক বিনিয়োগ কখনই ব্যাংকের মাধ্যমে সম্ভব নয়, তার পরও যতটুকু সমর্থন ব্যাংকিং খাত থেকে পাওয়ার কথা সেটাও পাওয়া যায় না শুধু দুর্বল ব্যাংকিং খাতের কারণে। দেশে এখনও কার্যকর বন্ড মার্কেট গড়ে ওঠেনি। বন্ডের প্রাথমিক বা প্রাইমারি মার্কেট এবং দ্বিতীয় স্তরের বা সেকেন্ডারি মার্কেট, কোনোটাই সেভাবে গড়ে ওঠেনি। অথচ বিনিয়োগের জন্য প্রয়োজন কার্যকর বন্ড মার্কেট। দেশের পুঁজিবাজারের অবস্থা আরও করুণ। অর্থাৎ বিনিয়োগের উদ্দেশ্যে অর্থ সংগ্রহের জন্য যতগুলো উৎস হতে পারে, তার সবই আমাদের দেশে খুব খারাপ অবস্থায় আছে।
আমাদের দেশের অধিকাংশ ব্যাংকের সঙ্গে উন্নত বিশ্ব, যেমন আমেরিকা, কানাডা এবং ইউরোপের অধিকাংশ ব্যাংকের কাউন্টারপার্টি লিমিট নেই। এমনকি কোনোরকম করেসপনডেন্ট রিলেশনশিপ পর্যন্ত নেই। এ মানের ব্যাংকিংব্যবস্থা নিয়ে বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার কাজটি মোটেই সহজ নয়। অনেকেই বলতে পারেন যে বিদেশি বিনিয়োগ আসার সঙ্গে দেশের ব্যাংকিং খাতের কী এমন সম্পর্ক থাকতে পারে। সম্পর্ক অবশ্যই আছে। বিশ্বে যেভাবে বৈদেশিক বিনিয়োগ সম্পন্ন হয়, সে ব্যাপারে যারা কিছুটা খোঁজখবর রাখেন, তারা খুব সহজেই বুঝতে পারবেন যে ব্যাংকিং খাতের মান একটি পর্যায়ে না থাকলে বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা মোটেই সহজ হবে না। এসব বিষয়ের সন্তোষজনক সুরাহা করে দেশে একটি বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করতে পারলেই এ বিনিয়োগ সম্মেলনের সফলতা ঘরে তোলা সহজ হবে। নচেৎ কাজটা বেশ কঠিন হবে এবং বিদেশি বিনিয়োগ দূরের কথা, দেশি বিনিয়োগও সেভাবে এগোবে না।