সম্পাদকীয়
প্রকাশ : ১৬ এপ্রিল ২০২৫ ১৭:০৯ পিএম
দেশের সামুদ্রিক মৎস্যসম্পদ সংরক্ষণ এবং টেকসই মৎস্য আহরণের জন্য মোট ৫৮ দিন সকল প্রকার মৎস্য আহরণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে সরকার। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে এ-সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপনে এ নিষেধাজ্ঞার কথা জানানো হয়েছে। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ‘সামুদ্রিক মৎস্য বিধিমালা, ২০২৩-এর বিধি ৩-এর উপবিধি (১)-এর দফা (ক) তে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে সরকার বাংলাদেশের সামুদ্রিক জলসীমায় মাছের সুষ্ঠু প্রজনন, উৎপাদন, সামুদ্রিক মৎস্যসম্পদ সংরক্ষণ এবং টেকসই মৎস্য আহরণের জন্য প্রতি বছর ১৫ এপ্রিল থেকে ১১ জুন পর্যন্ত মোট ৫৮ দিন সকল প্রকার মৎস্য নৌযান কর্তৃক যেকোনো প্রজাতির মৎস্য আহরণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে।’ আরও উল্লেখ করা হয়, নিষেধাজ্ঞা চলাকালে সমুদ্রে কোস্টগার্ড, নৌবাহিনী ও মৎস্য বিভাগের টাস্কফোর্স তাদের টহল কার্যক্রম পরিচালনা করবে। এ সময় সরকারের পক্ষ থেকে প্রত্যেক জেলেকে ৭৮ কেজি করে চাল দেওয়া হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
সংবাদটি ১৫ এপ্রিল মঙ্গলবার প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এর অনলাইনসহ বিভিন্ন অনলাইন মাধ্যমে উঠে এসেছে। ফলে সমুদ্র উপকূলের জেলেদের এ সময় ঘরে বসেই কাটাতে হবে। জানা গেছে, সরকারি নিষেধাজ্ঞা শুরুর আগেই গভীর সমুদ্র থেকে সব ট্রলার ঘাটে ফিরে আসে। এবারও এর ব্যত্যয় হয়নি। সমুদ্রে সাগরে মাছ ধরা ট্রলারের প্রকৃত সংখ্যা কত তার পরিসংখ্যান নিয়েও রয়েছে জটিলতা। সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তর, বিআইডব্লিউটিসি এবং মৎস্য উন্নয়ন করপোরেশনের সর্বশেষ তথ্যমতে উপকূলীয় এলাকায় লক্ষাধিক ট্রলার মাছ ধরার কাজে নিয়োজিত। ২০২১ সালে রেজিস্ট্রেশন নিয়েছে ফিশিং জাহাজ ২৬৪ ও ফিশিং বোট ১১ হাজার ৯২৪টি। ২০২২ সালে ফিশিং জাহাজ ২৬৬ ও ফিশিং বোট ১২ হাজার ১০৮টি রেজিস্ট্রেশন নিয়েছে। কেবল কক্সবাজার জেলায় মাছ ধরার ছোটবড় বৈধ ট্রলার রয়েছে ৫ হাজার ৬০০টি, সরকারিভাবে নিবন্ধিত জেলের সংখ্যা ৬৩ হাজার ১৯৩। প্রকৃতপক্ষে জেলের সংখ্যা প্রায় ১ লাখ। আরেক উপকূলীয় জেলা পটুয়াখালীর চিত্রও একই। জেলাটিতে মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করেন অন্তত দেড় লাখ জেলে। তবে নিবন্ধন তালিকায় নাম রয়েছে মাত্র ৭৯ হাজার জেলের।
এ কথা সত্য, দেশে সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চলে কোনো নিয়মকানুন না মেনেই নির্বিচার মাছ শিকার চলে। সমুদ্রের কতটুকু সীমানায়, কতটি ট্রলার কী পরিমাণ মাছ ধরতে পারবে সে নির্দেশনা মানা হচ্ছে না। অথচ জীবিকার তাগিদে ক্রমে বাড়ছে ট্রলার ও জেলের সংখ্যাও। এসব ট্রলার নিজেদের ইচ্ছামতো ঢুকে যাচ্ছে যেকোনো সীমানায়। নির্বিচার ধরছে মাছ। ফলে সমুদ্রে মাছের মজুদ যেমন কমছে, তেমন বিলুপ্ত হতে বসেছে অনেক প্রজাতির মাছ। গবেষকরা বলছেন, প্রতিদিন কী পরিমাণ মাছ শিকার করা হচ্ছে, তার কোনো সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান নেই। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ট্রলার যতই বাড়ছে মাছের আগ্রাসি শিকারও তত বাড়ছে।
আমরা মনে করি, শুধু নির্দিষ্ট সময়ের জন্য মাছ শিকার বন্ধ রাখলেই সরকারের লক্ষ্যপূরণ হবে না।
জেলেদের কাছে উদ্বেগের বিষয় হলো, নিষেধাজ্ঞার সময় ভারতীয় জেলেরা বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় ঢুকে মাছ ধরে নিয়ে যায়। ফলে নিষেধাজ্ঞার সুফল নিয়ে সন্দিহান তারা। তবে আশার কথা, এবার দুই দেশে একই সময়ে নিষেধাজ্ঞা হওয়ায় আশঙ্কার মাত্রাটা কম। মাছ রক্ষা করতে হলে বিদেশি জাহাজগুলো আমাদের সমুদ্রসীমায় ঢুকে মাছের কি পরিমাণ ক্ষতি করছে তারও তদারকি দরকার। তেলবাহী জাহাজগুলো থেকে তেলসহ ক্ষতিকারক রাসায়নিক দ্রব্য সমুদ্রের পানিতে পড়ে। এসব কারণে মৎস্যসম্পদের ক্ষতির পাশাপাশি সমুদ্রের জীববৈচিত্র্য নষ্ট হচ্ছে। এগুলো বন্ধ করতে হবে। পাশাপাশি ‘ওভারফিশিং’ বা অতিরিক্ত মাছ ধরা বন্ধ করা চাই।
সরকারি সহায়তা দেওয়ার যে বিষয়টি উল্লেখ রয়েছে তা কেবল নিবন্ধিত জেলেদেরই। তাহলে নিবন্ধন তালিকায় বাইরে থেকে যাওয়া জেলেরা এ ৫৮ দিন কীভাবে চলবেন পরিবার নিয়ে? প্রতি বছর নিষেধাজ্ঞার আগমুহূর্তে যে মাছ ধরা পড়ে, তা বিক্রি করে সঞ্চয় হিসেবে রাখা হয়। কিন্তু এবার অতিরিক্ত তাপপ্রবাহ ও অনাবৃষ্টির কারণে অনেক দিন মাছই মেলেনি সমুদ্রে।
আমরা মনে করি, নিষেধাজ্ঞার সময়ে সরকারি সহায়তা বরাদ্দ থাকলেও তা পর্যাপ্ত নয়। অতীতে এ বরাদ্দ, বিতরণ ও বণ্টন নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে। এবারও জেলেদের মধ্যে দেখা দিয়েছে দুশ্চিন্তা। তাই পেটের দায়ে নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে সমুদ্রে নামারও উপায় নেই তাদের। কারণ নিষেধাজ্ঞার সময় মৎস্য বিভাগ, নৌপুলিশের পাশাপাশি সাগরে নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ড তৎপর থাকবে। আমরা চাই না নিষেধাজ্ঞা ভেঙে কোনো জেলে সমুদ্রে নামুক, এর জন্য তাকে জেলেও যেতে হোক। তাই নিবন্ধিত এবং অনিবন্ধিত সব জেলে যাতে যথাযথভাবে ও সঠিক সময়ে সহায়তা পান, তা নিশ্চিত করা হোক। আমাদের বক্তব্য হচ্ছে, এ ৫৮ দিন উপকূলের মৎস্যজীবী এবং সংশ্লিষ্ট নৌযান শ্রমিকরা যাতে তাদের জীবনজীবিকার প্রশ্নে প্রাপ্যটা বুঝে পান সে ব্যাপারে সংশ্লিষ্টদের আন্তরিক হতে হবে। সর্বাগ্রে জেলেদের মানবিক দিকটি বিবেচনায় রাখা জরুরি।