× ই-পেপার প্রচ্ছদ সর্বশেষ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি শিক্ষা ধর্ম ফিচার ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

রাষ্ট্র সংস্কার

প্রশাসন ও সেবার গণমুখী বিকেন্দ্রীকরণ

আবদুল মুকতাদির মামুন

প্রকাশ : ১৬ এপ্রিল ২০২৫ ১৬:৫৯ পিএম

আবদুল মুকতাদির মামুন

আবদুল মুকতাদির মামুন

বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী বাংলাদেশে একটি এককেন্দ্রিক সংসদীয় গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থা বিদ্যমান। সরকারের প্রধান তিনটি বিভাগ ক. শাসন বা নির্বাহী বিভাগ, খ. আইন বিভাগ ও গ. বিচার বিভাগ। বাংলাদেশ সরকারের শাসন বা নির্বাহী বিভাগের মূলকেন্দ্র ঢাকায়। তবে সরকারের সব বিভাগের নির্বাহী কাজগুলো তৃণমূল পর্যায়ে বাস্তবায়ন করার জন্য দেশে ৬৪টি জেলা রয়েছে এবং প্রত্যেক জেলায় স্ব-স্ব বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আছেন। প্রতি জেলায় একজন করে জেলা প্রশাসক আছেন, যিনি সরকারি নীতিমালা অনুসরণ করে সব বিভাগ ও কাজের মধ্যে সমন্বয় সাধন করেন। তবে জেলা প্রশাসন ও কেন্দ্রীয় সরকারের মাঝে ‘বিভাগীয় প্রশাসন’ নামে আরেকটি স্তর আছে, যা একাধিক জেলার সমন্বয়ে গঠিত। বর্তমানে বাংলাদেশে মোট আটটি প্রশাসনিক বিভাগ রয়েছে। প্রশাসনিক বিভাগের প্রধান হচ্ছেন বিভাগীয় কমিশনার। যিনি বিভাগের আওতাধীন সব জেলার কার্যক্রম তদারক করেন।

সরকারের সেবাসমূহ জনগণের কাছে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে আশির দশকে বাংলাদেশে দুবার প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ হয়েছিল। প্রথমটি ছিল মেট্রোপলিটন থানা এলাকা ছাড়া দেশের সব থানা এলাকা উপজেলায় উন্নীত করা এবং নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা উপজেলা পরিষদ গঠন করে স্থানীয় সরকার বিভাগের আরেকটি স্তর তৈরি করা। প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের দ্বিতীয় ধাপটি ছিল সাবেক জেলাগুলোর আওতাধীন সব মহকুমা প্রশাসন বিলুপ্ত করে মহকুমাগুলো জেলায় উন্নীত করা। বিকেন্দ্রীকরণের এ পর্যায়ে ১৯৮৪ সালে দেশে নতুন ৪৪টি জেলা স্থাপন করা হয় এবং মোট জেলার সংখ্যা দাঁড়ায় ৬৪টিতে। বাংলাদেশের বিচার বিভাগ বিকেন্দ্রীকরণের লক্ষ্যে ১৯৮২ সালে ঢাকার বাইরে কুমিল্লা, যশোর, রংপুর, সিলেট, চট্টগ্রাম ও বরিশালে ছয়টি হাইকার্টের স্থায়ী বেঞ্চ স্থাপন করা হলেও বিচারক ও আইনজীবীদের অসহযোগিতা এবং কিছু আইনি জটিলতার কারণে বিকেন্দ্রীকরণের এ প্রক্রিয়াটি সফল হয়নি এবং কিছুদিনের মধ্যেই এগুলো বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়।

কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া দেশের প্রায় সব সরকারি বিভাগ, সরকারি সেবা, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, সুযোগসুবিধাসহ, ব্যবসাবাণিজ্য ও বণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধান কার্যালয় ঢাকায়। ফলে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ কাজ, চাকরি, ব্যবসাবাণিজ্য, স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাসেবা, শিক্ষা, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডসহ প্রায় সবকিছুর জন্য বাংলাদেশের মানুষ রাজধানী তথা ঢাকার ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল।

চব্বিশের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর সরকার পরিচালনা এবং রাষ্ট্র সংস্কারের এক মহান ও গুরুদায়িত্ব নিয়ে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার ইতোমধ্যে অনেক সংস্কার কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। রাষ্ট্র সংস্কারের অংশ হিসেবে সরকারি সেবাসমূহ মানুষের দোড়গোড়ায় পৌঁছানো এবং ঢাকার ওপর নির্ভরশীলতা কমানোর লক্ষ্যে প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ এখন সময়ের অন্যতম দাবি। এ দাবি সামনে রেখে দেশের একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমি অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে কিছু সুপারিশ পেশ করছি।

দেশের এককেন্দ্রিক সাংবিধানিক সরকার কাঠামোটি ঠিক রেখে বিদ্যমান আটটি প্রশাসনিক বিভাগ বিলুপ্ত করে ওই আট বিভাগ ও বৃহত্তর ১২ সাবেক জেলার প্রশাসনিক এলাকাগুলো কেন্দ্র করে সারা দেশকে মোট ২০টি প্রশাসনিক অঞ্চলে বিভক্ত করা, যা প্রেসিডেন্সি/কাউন্টি বা চাকলা/মণ্ডল নামে কিংবা সাংবিধানিকভাবে গ্রহণযোগ্য যে কোনো পরিচয়ে পরিচিত হবে। দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য, কৃষ্টি-সংস্কৃতি, শিল্প-সাহিত্য ও ভৌগোলিক বৈচিত্র্য বিবেচনায় নিয়ে প্রশাসনিক অঞ্চলগুলোর নতুন নামকরণ হতে পারে ঢাকা (বিক্রমপুর/সোনারগাঁ/মসলিন), চট্টগ্রাম (চাটগাঁ/উপকূল/সাগরিকা), পার্বত্য চট্টগ্রাম (নীলগিরি/পাহাড়িকা), নোয়াখালী (মোহনা), কুমিল্লা (সমতট/ কমলাঙ্ক), সিলেট (জালালাবাদ/শ্রীহট্ট), রাজশাহী (বরেন্দ্র), পাবনা (চলনবিল), দিনাজপুর (উত্তরাঞ্চল/মহানন্দা), রংপুর (উত্তরবঙ্গ/শতরঞ্জি), বগুড়া (পুণ্ড্র/মহাস্থান), ময়মনসিংহ (ব্রহ্মপুত্র), জামালপুর (যমুনা), টাঙ্গাইল (জামদানি), কুষ্টিয়া (আরশিনগর), যশোর (কপোতাক্ষ), খুলনা (সুন্দরবন/জাহানাবাদ), বরিশাল (চন্দ্রদ্বীপ), পটুয়াখালী (সাগরকন্যা) এবং ফরিদপুর (নকশিকাঁথা)। এ ছাড়া জনসংখ্যা ও ভৌগোলিক অবস্থান বিবেচনায় দেশের ১৬টি গুরুত্বপুর্ণ উপজেলাকে জেলায় উন্নীত করা। প্রস্তাবিত এ প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের মূল লক্ষ্য হবে জনসংখ্যা, ভৌগোলিক অবস্থান, যোগাযোগ, প্রশাসনিক সুবিধা, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, কৃষি সম্প্রসারণ, কৃষিপণ্য বাজারজাতকরণ, শিল্পজাত দ্রব্যের সহজ বিপণন, শিক্ষা, তথ্যসেবা, স্বাস্থ্যসেবা, আইন ও বিচার, কাঁচামালের জোগান সাপেক্ষে শিল্পকারখানা স্থাপন, পর্যটন, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, ব্যবসাবাণিজ্যের প্রসার, স্থানীয় উন্নয়নে জনঅংশগ্রহণ ও জনগণের প্রতি জবাবদিহি নিশ্চিত করা। শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ অন্য সেবাসমূহ জনগণের কাছাকাছি নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে প্রতিটি অঞ্চলের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, আদালত ও হাসপাতালগুলোর সুযোগসুবিধা বৃদ্ধি করা এবং সমাজের নিম্নবিত্ত শ্রেণির মানুষের জন্য নামমাত্র কিংবা বিনামূল্যে সেবার ব্যবস্থা রেখে সমাজের অন্যান্য শ্রেণির মানুষের কাছ থেকে সরকার নির্ধারিত ফি গ্রহণের মাধ্যমে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হবে।

প্রশাসনিক অঞ্চলগুলো প্রশাসনিক বিভাগ ও স্থানীয় সংসদ সদস্যদের সমন্বয়ে এমন একটা কাঠামো হিসেবে গড়ে উঠবে, যা সাবেক জেলা ও বিভাগীয় প্রশাসনের কার্যক্রমের বিপরীতে নির্বাহী দায়িত্ব পালন করবে। প্রতিটি প্রশাসনিক অঞ্চলের প্রধান হবেন যুগ্মসচিব পদমর্যাদার একজন আঞ্চলিক কমিশনার। একেকটি অঞ্চলের সব জেলা প্রশাসককে আঞ্চলিক কমিশনার অফিসের কাছে ন্যস্ত করা হবে এবং জেলা প্রশাসকরা আঞ্চলিক কমিশনারের কাছে রিপোর্ট করবেন।

প্রতিটি প্রশাসনিক অঞ্চলের প্রশাসনব্যবস্থা ভারসাম্যপূর্ণ ও উন্নয়নের জবাবদিহি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনিক অঞ্চলের নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের সমন্বয়ে একটি আঞ্চলিক সংসদীয় কাউন্সিল গঠিত হবে। যে অঞ্চলে যে রাজননৈতিক দলের আসন সংখ্যা বেশি, সে দল থেকে এক-তিন জনকে আঞ্চলিক সংসদীয় কাউন্সিলের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব অর্পণ করা হবে, যারা আঞ্চলিক সংসদীয় নেতা হিসেবে কাজ করবেন। জাতীয় সংসদের অধিবেশনের বিরতিকালে প্রত্যেক সংসদ সদস্য নিজ নিজ সংসদীয় এলাকার উন্নয়ন কার্যক্রম তদারক ও পরিদর্শন করবেন। প্রতিবার পরিদর্শনের শেষ পর্যায়ে আঞ্চলিক সংসদীয় কাউন্সিল ও আঞ্চলিক প্রশাসকরা এক বা দুই দিনের জন্য ত্রৈমাসিক আঞ্চলিক সংসদীয় সভা আহ্বান করবেন এবং প্রতিটি আঞ্চলিক সংসদীয় সভায় জেলা আঞ্চলিক প্রশাসক, প্রশাসকগণ এবং বিভিন্ন দপ্তরের প্রধানরা উপস্থিত থাকবেন। এ ছাড়া সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের ১৫-২০ জন পেশাজীবী প্রতিনিধি ওই সভায় সশরীরে কিংবা অনলাইনে যোগদান করে তাদের মতামত জানাবেন। এ সভায় সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের বিগত দিনের ত্রৈমাসিক কর্মপরিকল্পনা, চলমান উন্নয়ন কার্যক্রমের অগ্রগতি ও আর্থিক পর্যালোচনা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ সব সেবা নিয়ে আলোচনা এবং পরবর্তী তিন মাসের পরিকল্পনা উপস্থাপন করবেন। আশা করা যায়, এভাবে বাংলাদেশ একটি জবাবদিহিমূলক, গণমুখী ও কল্যাণ রাষ্ট্রের পথে এগিয়ে যাবে।

  • উন্নয়ন গবেষক
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : মোরছালীন বাবলা

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা