সম্পাদকীয়
প্রকাশ : ১৩ এপ্রিল ২০২৫ ১৭:২৭ পিএম
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে দেশে সামুদ্রিক তাপপ্রবাহ বাড়ছে। এতে সমুদ্রে ঘূর্ণিঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগও বৃদ্ধি পাচ্ছে। মানুষের জীবনযাত্রা দুঃসহ করে তুলেছে এই তাপপ্রবাহ। এতে আর্থিক ক্ষতির বিষয়টিও উঠে আসছে। চরম জীবিকা সংকটে পড়ছে উপকূলীয় বাসিন্দারা। জলবায়ু নিয়ন্ত্রণ, সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ এবং বিশ্বজুড়ে কোটি মানুষের খাদ্য ও কর্মসংস্থান নিশ্চিতকরণে মহাসাগর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ক্রমবর্ধমান সামুদ্রিক তাপমাত্রা এই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাকে হুমকির মুখে ফেলে দেয়। পরিসংখ্যান বলছে, গত দুই বছরে বিশ্বব্যাপী তীব্র সামুদ্রিক তাপমাত্রার ফলে ব্যাপক কোরাল ব্লিচিং, মৎস্য ও সামুদ্রিক খামার বন্ধ, মৃত তিমি ও ডলফিনের ভেসে আসার সংখ্যা বেড়েছে। এই ঘটনাগুলো স্থলভাগে তাপপ্রবাহ ও ভয়াবহ বন্যার মতো দুর্যোগকেও ত্বরান্বিত করেছে। জলবায়ু-সংক্রান্ত বৈশ্বিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘ন্যাচার ক্লাইমেট চেঞ্জ’-এ প্রকাশিত ‘ওশেন ইক্সট্রিমস এস এ স্ট্রেস টেস্ট ফর মেরিন ইকোসিস্টেম অ্যান্ড সোসাইটি’ শীর্ষক এক গবেষণায় সম্প্রতিs এসব তথ্য উঠে এসেছে। গবেষণায় আরও বলা হয়, ‘২০২৩ ও ২০২৪ সালের গ্রীষ্মে সামুদ্রিক তাপপ্রবাহ আগের যেকোনো বছরের তুলনায় ৩ দশমিক ৫ গুণ বেশি ছিল। এল নিনোর কারণে গত দুই বছরে জলবায়ু পরিবর্তন আরও তীব্র হয়েছে এবং সামুদ্রিক তাপপ্রবাহের একাধিক রেকর্ড গড়েছে।’ পরিসংখ্যান বলছে, গত ৩৪ বছরে বঙ্গোপসাগরে ৯০টি ঘূর্ণিঝড় উপকূলে আঘাত হেনেছে। এর মধ্যে ১৯৯০ থেকে ২০০০ পর্যন্ত ৩৩টি। সবচেয়ে বেশি ঘূর্ণিঝড়ের সংখ্যা ছিল ২০২১ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ৪ বছরে ১৩টি। অন্যদিকে, দেশের কমপক্ষে সাত জেলার ওপর দিয়ে তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। তাপপ্রবাহে বিরূপ প্রভাব পড়ছে সবজি চাষ থেকে ফসলের মাঠ পর্যন্ত। মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ জেলার চা-বাগানগুলো তীব্র তাপপ্রবাহে বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। বাগানে বৃষ্টির অভাবে পুড়ে মারা যাচ্ছে ছোট-বড় চা-গাছ। বিষয়টি চা-বাগান সংশ্লিষ্টদের ভাবিয়ে তুলেছে।
১২ এপ্রিল প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এ ‘সমুদ্রে তাপপ্রবাহের চাপ, আর্থিক ক্ষতিও বিপুল’ এবং ‘তাপপ্রবাহে কৃষিতে বিপর্যয়’ শীর্ষক দুটি আলাদা প্রতিবেদনে তাপপ্রবাহ নিয়ে উঠে এসেছে এসব তথ্য। প্রতিবেদনে, ‘অ্যানালাইসিস অব মেরিন হিটওয়েভস ওভার দ্য বে অব বেঙ্গল : ১৯৮২ থেকে ২০২১’ শীর্ষক ২০২৩ সালে প্রকাশিত গবেষণাটি তুলে ধরে বলা হয়েছে, এই সময়ে ভারত মহাসাগরে ১০৭টি সামুদ্রিক তাপপ্রবাহ (এমএইচডব্লিউ) হয়েছে। সেখানে বঙ্গোপসাগরের এমএইচডব্লিউ ঘটনার কারণ, প্রভাব এবং প্রবণতা অনুসন্ধান করা হয়।
বিশ্লেষণে দেখা যায়, আগস্ট ও নভেম্বরে এমএইচডব্লিউ সবচেয়ে বেশি ঘটেছিল এবং এপ্রিল-মে মাসে তা চরম আকার ধারণ করে। তাতে বলা হয়, বঙ্গোপসাগরে বছরে ৩টি সামুদ্রিক তাপপ্রবাহ হয়ে থাকে। বঙ্গোপসাগরে সবচেয়ে তীব্র তাপপ্রবাহের ঘটনাটি ঘটেছিল ২০১৬ সালে (৩১ মার্চ থেকে ৭ জুন ২০১৬)। তখন টানা ৬৯ দিন তাপপ্রবাহ অব্যাহত ছিল এবং সর্বোচ্চ তীব্রতা ছিল ৫ দশমিক ২৯ ডিগ্রি। আর দীর্ঘতম তাপপ্রবাহ স্থায়ী হয়েছিল ৯১ দিন (২০ জুন-১৮ সেপ্টেম্বর ২০২০)। এটির মান ছিল ১ দশমিক ৬২ থেকে ১ দশমিক শূন্য ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
২০২৩ সালে বাংলাদেশের ওপর আঘাত হানে প্রবল ঘূর্ণিঝড় মোখা ও ২০২৪ সালের ঘূর্ণিঝড় রেমাল। এই দুটি ঝড়ে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে কয়েক লাখ বাড়িঘর ধ্বংস হয়েছে। সরাসরি আক্রান্ত করেছে ৯০ লাখের বেশি মানুষকে। রেমালে প্রায় ৬ হাজার ৮৮০ কোটি টাকা মূল্যের সম্পদ নষ্ট হয়েছে। ৩৪ বছরে বঙ্গোপসাগরে ৯০টি ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হয়েছে ও উপকূলে আঘাত হেনেছে। এর মধ্যে ১৯৯০ থেকে ২০০০ পর্যন্ত ৩৩টি ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছে। এই সাড়ে তিন দশকে সর্বোচ্চ সংখ্যক ঘূর্ণিঝড় ছিল ১৯৯০ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত ৩৩টি ও কম সময়ে সবচেয়ে বেশি ঘূর্ণিঝড়ের সংখ্যা ছিল ২০২১ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ৪ বছরে ১৩টি।
২০২৩-২৪ সালে সামুদ্রিক তাপপ্রবাহের পূর্বাভাস পাওয়া সত্ত্বেও বেশিরভাগ দেশ আগাম ব্যবস্থা নিতে পারেনি। তাই ভবিষ্যতে প্রতিটি অঞ্চলে কার্যকর পূর্বাভাস ব্যবস্থা তৈরি এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সমন্বিত নীতিমালা প্রণয়ন জরুরি হয়ে পড়েছে। আমরা ভূপৃষ্ঠের তাপপ্রবাহের ঘোষণা ও সতর্কতার কথা জানি, কিন্তু সাগরের তাপপ্রবাহের বিষয়টি দেখা হয় না। তাই সমুদ্রে তাপপ্রবাহের অবজারভেশন জরুরি। এ থেকে পরিত্রাণের পথও খুঁজতে হবে। বিজ্ঞানীরা বলেছেন, সামুদ্রিক তাপপ্রবাহ সহনীয় রাখতে বাংলাদেশের মতো জলবায়ু ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোতে দ্রুত পরিবেশবান্ধব জ্বালানি ব্যবহারে জোর দিতে হবে। পাশাপাশি সমুদ্রের তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে বিপন্ন প্রাণী সংরক্ষণে গবেষণা ও সুরক্ষার উদ্যোগ আরও জোরদার করার বিষয়টিও তুলে ধরেছেন।
প্রাকৃতিক দুর্যোগের এই দেশে নতুন ‘উপদ্রব’ তাপপ্রবাহ। এই দুর্যোগ সমাজ, অর্থনীতি এবং মানুষের জীবন ও পরিবেশকে গভীরভাবে প্রভাবিত করছে। পরিবেশের ওপর যে প্রভাব পড়েছে তা মানবসৃষ্ট। নির্বিচারে বন উজাড়, গাছ কাটা, নদী খাল ভরাট ও দখল করার কারণে পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। এ-কথা সত্য যে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো চরম-ভাবাপন্ন আবহাওয়ার মুখোমুখি হচ্ছে বাংলাদেশের প্রকৃতি ও মানুষ। এ প্রাকৃতিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন কাজ। তাই এখনই যদি পরিবেশের দিকে নজর না দেই তা হলে আগামী বছরগুলোতে মানুষ ও অন্যান্য প্রাণী আরও গভীর সংকটে পড়বে। তাই সময় থাকতেই সতর্ক ও সচেতন হওয়া জরুরি।