পরিপ্রেক্ষিত
প্রজ্ঞা দাস
প্রকাশ : ১৩ এপ্রিল ২০২৫ ১৭:২৫ পিএম
ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে আমরা যেমন অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নের মুখ দেখছি, তেমন সমান্তরালে বৃদ্ধি পেয়েছে সাইবার অপরাধের জটিলতা এবং এর বিস্তৃতিও। বিশেষ করে মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস) প্লাটফর্মে ওয়ান-টাইম পাসওয়ার্ড (ওটিপি)-ভিত্তিক প্রতারণা এখন একটি জাতীয় সমস্যায় পরিণত হয়েছে। এ ধরনের অপরাধ শুধু অর্থনৈতিক ক্ষতি করছে না বরং সাধারণ মানুষের ডিজিটাল লেনদেনের প্রতি আস্থাও নষ্ট করছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত এক বছরে মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসের মাধ্যমে প্রতারণার শিকার হয়েছেন প্রায় ৫০ হাজার মানুষ, যার আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ৩০০ কোটি টাকার বেশি। বাংলাদেশ সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন বিভাগের তথ্যানুসারে, প্রতিদিন গড়ে ২০০ সাইবার অপরাধের ঘটনা রেকর্ড করা হয়, যার প্রায় ৬০ শতাংশই জড়িত এমএফএস ও ওটিপিভিত্তিক প্রতারণার সঙ্গে। এ প্রতারণাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে সাধারণ হলো ফিশিং আক্রমণ। অপরাধীরা ভুয়া এসএমএস, ইমেইল বা সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে ব্যবহারকারীদের ব্যক্তিগত তথ্য হাতিয়ে নেয়। এসব বার্তায় সাধারণত লেখা থাকে যে তাদের অ্যাকাউন্টে সমস্যা হয়েছে বা তারা কোনো পুরস্কার জিতেছেন এবং লিঙ্কে ক্লিক করে তথ্য হালনাগাদ করতে হবে। এ লিঙ্কে ক্লিক করলে ব্যবহারকারী একটি ভুয়া ওয়েবসাইটে প্রবেশ করেন, যেখানে ব্যবহারকারীর নাম, পাসওয়ার্ড, এমনকি ওটিপিও চুরি হয়ে যায়।
অন্যদিকে, ক্লোনড অ্যাপ্লিকেশন (যেমন হুবহু বিকাশের মতো দেখতে অ্যাপ যা গুগল প্লে স্টোরেও পাওয়া যায়) ইনস্টল করালে ব্যবহারকারীর সমস্ত তথ্য চুরি হয়ে যায়। অনেকে আবার ফেসবুকে বিকাশ/নগদ গ্রাহকসেবার নামে ভুয়া পেজ বানিয়ে বিপদে পড়া মানুষের কাছ থেকে ‘সাহায্য’ চেয়ে তথ্য আদায় করে নেয়। এ ছাড়া কল স্পুফিংয়ের মাধ্যমে অপরাধীরা গ্রাহককে ফোন করে বিভিন্নভাবে ওটিপি বা পিন নম্বর চেয়ে নেয়। অনেক সময় তারা গ্রাহককে ভয় দেখায় যে তাদের অ্যাকাউন্ট হ্যাক হয়েছে বা জরুরি ভিত্তিতে ট্রানজেকশন বাতিল করতে হবে। এ ধরনের সাইকোলজিক্যাল প্রেশারের কারণে অনেকেই বিভ্রান্ত হয়ে অপরাধীদের হাতে তথ্য তুলে দেন। এ সমস্যা বৃদ্ধির পেছনে একাধিক কারণ কাজ করছে। তবে প্রযুক্তিগত দুর্বলতা ও সচেতনতার অভাবই এ ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশে এখনও অনেক এমএফএস প্রোভাইডার পর্যাপ্ত বায়োমেট্রিক ভেরিফিকেশন ছাড়াই লেনদেন অনুমোদন করে। কিছু ক্ষেত্রে শুধু একটি ওটিপি দিয়েই বড় অঙ্কের টাকা ট্রান্সফার করা সম্ভব হচ্ছে, যা নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে যথেষ্ট নয়। পাশাপাশি আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতাও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে প্রবল। সাইবার অপরাধের তদন্ত প্রক্রিয়ায় অত্যন্ত ধীরগতি লক্ষ করা যায়।
অনেক ক্ষেত্রে প্রমাণ সংগ্রহ করতে গিয়ে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে বিভিন্ন প্রযুক্তিগত ও আইনি জটিলতার মুখোমুখি হতে হয়। এ ছাড়া অনেক স্ক্যামার সাধারণত বিদেশি ভিওআইপি কলিং সিস্টেম ব্যবহার করে অথবা বিদেশ থেকে তাদের কার্যক্রম অপারেট করে, যা তাদের ধরাকে আরও কঠিন করে তুলেছে। তবে সবকিছুর ঊর্ধ্বে কাজ করে সচেতনতার অভাব। অনেকেই এখনও জানেন না যে ওটিপি বা পিন কাউকে শেয়ার করা উচিত নয়। এ সমস্যা সমাধানের জন্য বহুমুখী পদক্ষেপ প্রয়োজন। এক্ষেত্রে এমএফএস প্রোভাইডারদের উচিত বায়োমেট্রিক ভেরিফিকেশন বাধ্যতামূলক করা। ওটিপির পাশাপাশি আঙুলের ছাপ বা ফেসিয়াল রিকগনিশন যুক্ত করা হলে নিরাপত্তা বহুলাংশে বাড়বে। সন্দেহমূলক নম্বরে ট্রানজেকশন ব্লক সিস্টেম চালু করা (এএল অ্যালগরিদম দ্বারা চিহ্নিত)। ‘আনডু’ ফিচারের বাস্তবায়ন করা যেখানে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ভুল ট্রানজেকশন ফিরিয়ে নেওয়া সম্ভব হয়। পাশাপাশি সরকারের উচিত আইনি ব্যবস্থা জোরদার করা এবং জাতীয় সাইবার সিকিউরিটি কাউন্সিল গঠনে উদ্যোগী হওয়া। সর্বোপরি জনসচেতনতা বৃদ্ধির বিকল্প নেই।
-শিক্ষার্থী