গাজায় গণহত্যা
হোসেন আবদুল মান্নান
প্রকাশ : ১৩ এপ্রিল ২০২৫ ১৭:২০ পিএম
হোসেন আবদুল মান্নান
ফিলিস্তিন উপত্যকার অবরুদ্ধ ভূখণ্ড গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর অব্যাহত বর্বরতা যেন অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। কেউ জানে না এমন নৃশংস শিশু হত্যাযজ্ঞ, ধ্বংসস্তূপ ও মৃত নগরীতে পরিণত হওয়ার পর জনপদটিতে বেঁচে থাকা অবশিষ্ট শিশুদের ভবিষ্যৎ কী হবে? চোখের জলে লেখা এমন হাজারো প্রশ্ন দুনিয়ার কোটি কোটি বিবেকবান ও সভ্য মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে।
গাজা ইসরায়েল, মিসর ও ভূমধ্যসাগর দ্বারা পরিবেষ্টিত ২৫ মাইল দীর্ঘ ও ১০ কিমি প্রশস্ত এক ছোট্ট ভূখণ্ড। প্রায় ২৩ লাখ মানুষের বসবাস উপযোগী একটা ঘনবসতিপূর্ণ উপত্যকা। যেখানে এমনিতেই মানুষগুলো সুবিধাবঞ্চিত, অপুষ্টি ও বেকারত্বে জর্জরিত হয়ে দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। তারা মূলত জাতিসংঘসহ বাইরের দুনিয়ার খাদ্য সহায়তার ওপর নির্ভরশীল। ইউনিসেফ বলছে, গত মাসের ২০ তারিখ থেকে প্রতিদিন গড়ে কমপক্ষে ১০০ জন শিশু নিহত হচ্ছে। অন্যদিকে সেখানে ১০ লাখের বেশি শিশু প্রয়োজনীয় খাদ্য সহায়তা না পেয়ে মানবেতরভাবে বেঁচে আছে। নিষ্পাপ শিশুগুলোর খাদ্য ও বাঁচার আকুতি পৃথিবীর সব মানবিক মানুষকে সাময়িক স্তব্ধতার মুখোমুখি করে দিয়েছে। একটি শিশুর চোখে শুধু আগামীর পৃথিবী। সে চেনে না জেরুজালেম, দেখে না ইহুদি, জানে না রাজনীতি। ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলছে, ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় ২০২৩ সালের অক্টোবর মাস থেকে গত ছয় মাসে সেখানে মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫০ হাজার ৬৯৫ জন।
এ সময়ে গাজায় শিশু নিহত হয়েছে কমপক্ষে ১২ হাজার ৬৬০ জন। এর মধ্যে ২৭৪টি নবজাতক ও ৮৭৪ জন শিশু, যাদের বয়স এক বছরেরও কম, যা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের চেয়ে ছয় গুণ বেশি। সেখানে শিশুমৃত্যুর সংখ্যা ছিল ৫৭৯ জন। গাজায় প্রতিদিন সেখানকার হাসপাতালগুলোতেও ভারী গোলাবারুদ দিয়ে আক্রমণ করা হচ্ছে। আহত নারী ও শিশুরা চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইসরায়েলি বাহিনীর আঘাতে হাসপাতালের স্থাপনা ও অবকাঠামোর নিচে চাপা পড়েছে। দেখা যায়, একটা বিশ্বস্ত কুকুর অবুঝ শিশুটিকে উদ্ধার করছে। যে করুণ দৃশ্য সামাজিকমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) বলছে, ২০২৫ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত ৬৫৪টি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে হামলা করলে সেখানকার প্রায় ১১শ স্বাস্থ্যকর্মী নিহত হন। শিশুদের শত শত স্কুল বন্ধ করে আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে কাজ করছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতে, ইসরায়েলের সৈন্যরা বাস্তুচ্যুত নারী-শিশুদের আশ্রয় দেওয়া স্কুল ও শিবিরগুলোকে আঘাত করায় এখন নিরাপদ আশ্রয় নেই বললেই চলে।
ঘোষিত যুদ্ধবিরতির মধ্যে ইসরায়েলের এমন নিষ্ঠুর হামলার সমালোচনা করে জাতিসংঘ। জাতিসংঘ বরাবরের মতো অসহায় হয়ে বলছে, ‘ফিলিস্তিনিদের রক্ষায় আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলুন।’ সংস্থাটির মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস নিজেই বলেছেন, ‘গাজায় খাবার নেই, ওষুধ নেই, আছে কেবল মৃত্যু।’ তিনি আরও বলেছেন, খাদ্য ও ওষুধের যানবাহন প্রবেশাধিকার হরণ করে নিয়েছে ইসরায়েল। এদের জন্য ত্রাণ সহায়তার ট্রাক আটকে ইসরায়েলি বাহিনী গাজাকে এক মৃত্যু উপত্যকায় পরিণত করেছে। তারা নারী-শিশুর জন্য সরবরাহকৃত পানি বন্ধ করে দিয়েছে।
তিনি ইসরায়েলকে হামাসের ওপর হামলা বন্ধের আহ্বান জানান। গত ৭ এপ্রিল তিনি গাজায় মানবিক বিপর্যয়ের চিত্র তুলে ধরে বলেছেন, বলেছেন, ইসরায়েলের হাতে জিম্মি পরিবারগুলো গাজায় পুনরায় ফিরে আসার স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। সেখানে এখন বিশ্বমানবতা ডুকরে কাঁদছে।
ইসরায়েলের সাম্প্রতিক হত্যাকাণ্ড ও পৈশাচিকতার প্রতিবাদে বিশ্বব্যাপী বিক্ষোভ অব্যাহত রয়েছে। খোদ যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসিতে ‘গ্লোবাল স্ট্রাইক ফর গাজা’ স্লোগান হচ্ছে।
যুক্তরাজ্যে বিক্ষোভ হচ্ছে। প্যারিস এবং বার্লিনে হাজার হাজার মানুষ এক কাতারে দাঁড়িয়ে। ‘গাজার শিশুরা মুক্তি পাক’।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে নির্বাচিত হয়ে হোয়াইট হাউসে বসার পরে তার নতুন করে চিন্তাভাবনা ও মন্তব্যের আকস্মিকতায় সারা দুনিয়ায় সমালোচনার ঝড় বয়ে যায়। মাতৃভূমির জন্য ফিলিস্তিনি জনগণের সংগ্রামের দীর্ঘ ইতিহাস, আত্মত্যাগ, শত বছর ধরে রক্তের অক্ষর দিয়ে আলপনা আঁকা তাদের ন্যায়সংগত দাবি যেন প্রেসিডেন্টের কাছে তুচ্ছ ও উপহাসের বিষয়। তিনি বলেছেন, গাজার মানুষকে জর্ডান ও মিসরে বিতাড়ন করে সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ বহাল করা হবে। এখন বলছেন, গাজা আবাসন ব্যবসার জন্য খুবই চমৎকার স্থান হবে। প্রয়োজনে ফিলিস্তিনের জন্য নতুন রাষ্ট্র তৈরি করে দেওয়া হবে ইত্যাদি ইত্যাদি, যা বহমান আগুনের লেলিহান শিখার ওপর ঘৃত বর্ষণ করার শামিল। তার এমন হালকা ও তাচ্ছিল্যপূর্ণ বক্তব্য হয়তো যৌক্তিক সমাধানের পরিবর্তে গাজায় চলমান শিশু ও নারী হত্যার নৃশংসতাকে আরও একধাপ এগিয়ে নিয়ে যাবে। ইসরায়েলি বাহিনীকে মনোবলে চাঙ্গা করবে, যা সারা পৃথিবীতে বসবাসকারী যুদ্ধ নয়, শান্তিপ্রিয় মুসলিম জনগোষ্ঠীসহ ও মানবিক সংস্থাগুলো নীরবে-নিভৃতে সহ্য করে যাবে এবং জাতিসংঘ যথারীতি অপারগতার সঙ্গে তার অশ্রুজলে ভাসা অনুকম্পার ললিত বাণী শুনিয়ে যাবে। তাতে কি ফিলিস্তিনি মায়ের কোলে বহন করা মৃত সন্তানের লাশের মিছিল বন্ধ হবে? ছেলের মৃতদেহের ওপর ঝরে পড়া মায়ের চোখের জল বন্ধ হবে কি?