× ই-পেপার প্রচ্ছদ সর্বশেষ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি শিক্ষা ধর্ম ফিচার ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

খাদ্যে বিষ

আমরা কি মরার আগে মরছি!

মীর আব্দুল আলীম

প্রকাশ : ১১ এপ্রিল ২০২৫ ১৬:৫৯ পিএম

মীর আব্দুল আলীম

মীর আব্দুল আলীম

এখন বিষ খেতে হয় না। খাবারে মেশানো থাকে। তা খেয়ে মানুষ মৃত্যুবরণ করে! যুগ পাল্টেছে আগে যেখানে খাবার ছিল পুষ্টির উৎস, এখন তা যেন নীরব ঘাতক। আমরা আর খাবার খাচ্ছি না, খাচ্ছি কারবাইড, ফরমালিন, সোডিয়াম সাইক্লামেট, বোরিক অ্যাসিড, ডাইক্লোরোডাইফ্লুরোমিথেন (যেটার নাম উচ্চারণেই মানুষ মরার উপক্রম হয়)। নাম শুনে মনে হয় কেমিস্ট্রির ল্যাব! অথচ এদের আমরা বলি ‘ভাত-মাছ-সবজি’। মাছভাতে বাঙালি এখন বিষভাতে বাঁচে!

এ দেশে কেউ ক্যানসারে, কেউ কিডনি রোগে, কেউবা ফুসফুসে আক্রান্ত। চাচা ক্যানসারে মারা গেছেন, ভাইও আক্রান্ত। পাশের বাসার শিশুটির ব্লাড ক্যানসার ধরা পড়েছে। চারপাশে যেন রোগের ছড়াছড়ি। অকালে হারিয়ে যাচ্ছে প্রিয়জনেরা। বিষ খেলে মানুষ মরবেই, এ তো জানা কথা। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে আজ আমরা প্রতিদিনই বিষ খাচ্ছি, খাবারের নামে!

একসময় মাছ মরার পর পচত, এখন পচে না। কারণ মাছটা মারা তো যায়নি, তাকে মেরে জ্যান্ত রাখা হয়েছে ফরমালিনে চুবিয়ে! চিংড়ি টকটকে লাল, কিন্তু আসলে সেটা রঙিন মৃত্যু। সবজিতে রঙ এত উজ্জ্বল যে প্যারিস ফ্যাশন উইকে পাঠালেও মানায়! আমরা খাচ্ছি ভাত, কিন্তু সে ভাতে আছে ‘পটাশিয়াম ব্রোমেটে’, রন্ধন তেলে আছে র‌্যানসিডিটি। বিজ্ঞান যেটাকে বলে অকসিডেশন, আমরা বলি ‘হালকা ঘ্রাণ আছে মনে হয়’। খাবারে গন্ধ থাকলেই যে ভালো কিছু, এটা তো আর সব সময় সত্যি না!

বাংলাদেশে এখন একটা নতুন বাজার তৈরি হয়েছে ‘অর্গানিক’ বাজার। দোকানপাটে লেখা ‘অর্গানিক আম’, ‘অর্গানিক চাল’, ‘অর্গানিক কুমড়া’। শুনলে বোঝা যায়, এ যেন বিদেশি রাজপুত্রের রাজকীয় ভোজ! কিন্তু সেই অর্গানিকের উৎস জানতে গেলে দেখা যায়, সবকিছুই গাজীপুর বা নবীনগরের কোনো এক ‘ব্যবসায়ী চাচার’ হোমিও ল্যাব থেকে আসা। ঢাকায় বসে আমরা এখন অর্গানিক রসগোল্লা খাচ্ছি, যাতে গ্লুকোজ সিরাপের বদলে দেওয়া হয়েছে ‘প্রাকৃতিক হাইড্রোজেনেটেড সুগার সাবস্টিটিউট’, যা শোনার পরই প্রেশার ১৫০ হয়ে যায়।

খাদ্যে ভেজালবিরোধী আইন আছে। এমনকি ১৯৫৯ সালের ‘খাদ্য নিরাপত্তা আইন’ এখনও বইয়ের পাতায় চমৎকারভাবে শোভা পাচ্ছে। খাদ্যে ভেজাল রোধে অনেক আইন রয়েছে, কিন্তু এর যথাযথ প্রয়োগ নেই। এর ব্যবহার অনেকটা সেই পুরোনো গ্রাম্য চৌকিদারের লাঠির মতো। শুধু ঝাড় দেওয়া যায়, পেটানো যায় না। ভেজাল দেওয়া বা ভেজাল খাদ্য ও পানীয় বিক্রির কারণে ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে কঠের শাস্তির বিধান রয়েছে। এ আইনের ২৫ (গ) ধারায় বলা হয়েছে, যদি কেউ কোনো খাদ্য বা পানীয় দ্রব্যে ভেজাল দিয়ে তা ভক্ষণ বা পান করার অযোগ্য করে ও তা খাদ্য, পানীয় হিসেবে বিক্রি করতে চায় বা তা খাদ্য বা পানীয় হিসেবে বিক্রি হবে বলে জানা সত্ত্বেও অনুরূপ ভেজাল দেয় অথবা কোনো দ্রব্য নষ্ট হয়েছে বা নষ্ট করা হয়েছে বা খাদ্য, পানীয় হিসেবে অযোগ্য হয়েছে জানা সত্ত্বেও বা তদ্রূপ বিশ্বাস করার কারণ থাকা সত্ত্বেও অনুরূপ কোনো দ্রব্য বিক্রি করে বা বিক্রির জন্য উপস্থিত করে; তবে সে ব্যক্তি মৃত্যুদণ্ড, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড অথবা ১৪ বছর পর্যন্ত সশ্রম কারাদণ্ডে এবং তদুপরি জরিমানাদণ্ডে দণ্ডনীয় হবে। চারদলীয় জোট সরকার ২০০৫ সালে অর্ধশত বছরের পুরোনো ১৯৫৯ সালের বিশুদ্ধ খাদ্য অধ্যাদেশে (পিএফও) বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংশোধন আনে। বিএসটিআই অধ্যাদেশ, ১৯৮৫ এবং এর অধীন প্রণীত বিধিমালায় খাদ্য ও কৃষিজাত পণ্যের প্রক্রিয়া ও পরীক্ষা পদ্ধতির জাতীয় মান প্রণয়ন এবং প্রণীত মানের ভিত্তিতে পণ্যসামগ্রীর গুণগত মান পরীক্ষা ও যাচাই করার বিধান রয়েছে।

পালনীয় বিধানাবলি ভঙ্গের জন্য চার বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড এবং ১ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানার ব্যবস্থা রয়েছে। খাদ্যে ভেজাল রোধ ও ভেজালকারীদের শাস্তি দেওয়ার বিধান রয়েছে সিটি করপোরেশন অধ্যাদেশগুলোয়। দেখা যাচ্ছে, দেশে খাদ্যদ্রব্যে ভেজালবিরোধী আইনের কমতি নেই। শাস্তির বিধানও রয়েছে এসব আইনে। স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন উঠতে পারেÑ শাস্তির বিধানসংবলিত এসব আইন বলবৎ থাকা সত্ত্বেও খাদ্যদ্রব্যে ভেজালের এত দৌরাত্ম্য কেন? কারাদণ্ডের বিধান থাকলেও এ পর্যন্ত তা প্রয়োগের কোনো নজির নেই। এটা আমাদের বাঙালি জাতির জন্য দুর্ভাগ্য। খাদ্যে ভেজাল রোধে অনেক আইন রয়েছে, কিন্তু এর যথাযথ প্রয়োগ নেই। মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর কোনো কিছুই খাদ্যে মিশ্রণ করা যাবে না, এটাই বিধান। কিন্তু অসাধু ব্যবসায়ীরা এ আইন মানছে না। এজন্য চলমান ভেজালবিরোধী আইন কঠের করা হচ্ছে। সেই সঙ্গে বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউটের জনবল ও ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে। এ দেশে খাদ্যে ভেজাল প্রতিরোধে ‘দি পিওর ফুড অর্ডিন্যান্স ১৯৫৯’ বর্তমান ব্যবস্থায় কার্যকর করা সম্ভব হচ্ছে না। এ আইন যখন হয়েছে তখন মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর অনেক রাসায়নিক দ্রব্য সৃষ্টিই হয়নি। আর খাদ্যে ভেজাল মেশানোর প্রবণতা সৃষ্টি হয়েছে আশির দশকের পর। ফলে জনস্বার্থে আইন সংশোধন না করে নতুন করে কঠের আইন তৈরি করতেই হবে। এতে খাদ্যে ভেজালকারীর বিরুদ্ধে সরাসরি ২০২ ধারা অনুসরণ করা দরকার। কারণ খাদ্যে ভেজাল মিশিয়ে মানুষ মারা এবং সরাসরি মানুষ মারাকে এ অপরাধের আওতায় আনা না হলে ভেজাল মেশানো প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে না। 

বাংলাদেশে খাদ্যনিরাপত্তা দেখার দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলোর হাতে যে পরিমাণ যন্ত্রপাতি আছে, তা দিয়ে তারা আসলে তেলাপোকার স্বাস্থ্য পরীক্ষা চালাতেও হিমশিম খায়। পরীক্ষাগার নেই, যন্ত্রপাতি নেই, লোকবল নেই অথচ দায়িত্ব বিশাল। ক্যাব (ভোক্তা অধিকার সংগঠন) মাঝে মাঝে রিপোর্ট দেয় ঢাকার ৭০% হোটেল-রেস্তোরাঁয় খাবারে ভেজাল! শুনে আমরা কাঁধ ঝাঁকি দিই, তারপর বাসার নিচের ওই হোটেলেই পরোটা-ভাজি খাই। কারণ খিদে আর অভ্যাস, দুইটা জিনিসই পেটের পক্ষে ভীষণ আপসকারী।

আজকাল শহর কিংবা গ্রামে বাচ্চাদের যে হারে অ্যাজমা, অ্যালার্জি, লিভার ডিসঅর্ডার হচ্ছে, তাতে ডাক্তাররা বলছেন, ‘ওদের শরীরে প্রাকৃতিক কিছু কম, কৃত্রিম জিনিস বেশি!’ শিশুর দুধে হাইড্রোজেনেটেড ফ্যাট, নুডলসে ক্ষতিকর প্রিজারভেটিভ, চিপসে সোডিয়াম গ্লুটামেট! বাচ্চারা খেলছে, খাচ্ছে, বড় হচ্ছে কিন্তু শরীর যেন তৈরি হচ্ছে ‘নরম পলিথিন দিয়ে’। শিশুকালেই গোটা দেহটায় যেন বিষের রাজত্ব।

সম্প্রতি এক লেখায় পড়লাম, ‘প্রতি জনে, প্রতি ক্ষণে, জেনে-শুনে করেছি বিষ পান।’ আরও এক লেখক লিখেছেন, ‘কত কিছু খাই, ভস্ম আর ছাই।’ জাতীয় দৈনিকে হেডলাইন ‘মাছের বাজারে মাছি নেই!’ এগুলো নিছক রসিকতা নয়, বাস্তবতা। আমাদের প্রতিদিনের খাদ্যে কোনো না কোনো মাত্রায় বিষ মেশানো হচ্ছে, এ আর অজানা কিছু নয়। আর এ বিষই আমাদের নিয়ে যাচ্ছে মৃত্যুর দিকে, ধীরে ধীরে নীরব ঘাতকের মতো।

খাদ্যে ভেজাল বন্ধ করতে হলে চাইলে : ১. কঠোর আইন ও তার কার্যকর প্রয়োগ ২. স্বতঃস্ফূর্ত গণসচেতনতা ভোক্তা আন্দোলন ৩. মিডিয়া নজরদারি, খাদ্য পরীক্ষার জন্য আধুনিক ল্যাব ও সক্ষম জনবল ৪. বিশেষ আদালত চালু করে দ্রুত বিচার ও শাস্তি নিশ্চিত করা।

খাবার নয়, আমরা জীবন চাই! আমরা চাই না পত্রিকার হেডলাইন হোক : দুধে ভেজাল, চিনিতে  ভেজাল, শাকসবজিসহ নানা নিত্যপণ্যে ভেজাল! এভাবে আর চলতে পারে না। জীবন বাঁচাতে হলে আমাদের সবাইকে ভেজালের বিরুদ্ধে একযোগে যুদ্ধ করতে হবে। ভেজালের বিরুদ্ধে আমাদের সোচ্চার হতে হবে, প্রতিরোধ গড়তে হবে, প্রয়োজনে আন্দোলনে যেতে হবে। এটা কেবল সরকারের দায়িত্ব নয়, এটা আমাদের সবার। 

  • সাংবাদিক ও মহাসচিব, কলামিস্ট ফোরাম অব বাংলাদেশ
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : মোরছালীন বাবলা

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা