সম্পাদকীয়
প্রকাশ : ১১ এপ্রিল ২০২৫ ১৬:০৬ পিএম
বৈশ্বিক মন্দা, আর্থিক খাতে সিদ্ধান্তহীনতা, ব্যাংকিং খাতে অনিয়ম-দুর্নীতি, সুশাসনের অভাবসহ নানা কারণে দেশের অর্থনীতি খুব একটা ভালো অবস্থায় নেই। এমন বাস্তবতা সামনে রেখে সরকারের দায়িত্ব নেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস। অর্থনীতি সচল রাখতে নানা উদ্যোগের পাশাপাশি তিনি আয়োজন করেন ‘বাংলাদেশ বিনিয়োগ সম্মেলন-২০২৫’। ৭ এপ্রিল শুরু হওয়া চার দিনের এ সম্মেলন শেষ হয় গতকাল। যুক্তরাষ্ট্র, চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়াসহ ৪০ দেশের ৬ শতাধিক বিনিয়োগকারী ও প্রতিনিধি এতে অংশ নেন। উন্নয়নশীল বিশ্বের সব দেশেরই বিনিয়োগ আকর্ষণের চেষ্টা করে থাকে। আমাদের অন্তর্বর্তী সরকারেরও লক্ষ্য বিদেশি বিনিয়োগ। কারণ, বিনিয়োগ থেকে আসে কর্মসংস্থান, বাড়ে রাজস্ব, কমে দারিদ্র্য।
বিনিয়োগের ক্ষেত্রে অন্যতম বাধা নীতির ধারাবাহিকতা ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা না থাকা। রয়েছে সরকারের বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে সমন্বয়হীনতাসহ আরও কিছু বিষয়ে চ্যালেঞ্জও। বুধবার ঢাকার ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে সম্মেলনের তৃতীয় দিনে প্যানেল আলোচনায় দেশিবিদেশি ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারীরা এমন অভিমতই দেন। এমন পরিস্থিতিতে বিনিয়োগনীতি ও কাঠামোগত পরিবর্তনের বিষয়টি জোরালোভাবে তুলে ধরেছেন তারা। আমরা মনে করি, বিনিয়োগের স্বার্থে শুধু নীতির পরিবর্তনই নয়, এ ক্ষেত্রে সরকারের দৃষ্টিভঙ্গিও বদলাতে হবে। উল্লেখ্য, স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উত্তরণ-পরবর্তীকালে দেশের বাণিজ্য ও বিনিয়োগকৌশল নিয়ে প্যানেল আলোচনাটির আয়োজক এফবিসিসিআই।
১০ এপ্রিল প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এ ‘বিদেশি বিনিয়োগ আনতে নীতি পরিবর্তনের তাগিদ’ শীর্ষক প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে, বাংলাদেশে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এখনও নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। বিনিয়োগের জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং নীতির ধারাবাহিকতার বিষয়টি উঠে আসে। এ প্রসঙ্গে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশির উদ্দিন বলেছেন, বাংলাদেশ একটি পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বিদ্যমান নীতিগুলো নিয়ে পর্যালোচনা করা হচ্ছে। বিনিয়োগসংক্রান্ত ঝুঁকি ও চ্যালেঞ্জগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে। এগুলোর সমাধানও করা হচ্ছে। তিনি আরও বলেছেন, বর্তমান সরকার অবকাঠামোতে বেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করছে। কারণ, বাংলাদেশ ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বের নবম ভোক্তা বাজার হতে যাচ্ছে। আমাদের শক্তিশালী জনবল আছে। বিনিয়োগের জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা জরুরি বলে মনে করেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন। তিনিও বিনিয়োগনীতির ধারাবাহিকতা চান। তিনি মনে করেন, প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার প্রয়োজন এবং নীতির নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর মধ্যেও সংস্কার প্রয়োজন।
এ কথা সত্য, স্বাধীনতার ৫৪ বছর পেরিয়ে গেলেও এখনও দেশে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরি করা যায়নি। অথচ মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, ভোগব্যয় বৃদ্ধি এবং অধিক হারে মধ্যবিত্তের সম্প্রসারণের পরিপ্রেক্ষিতে বিনিয়োগ বাংলাদেশের জন্য সম্ভাবনাময় বৃহৎ বাজার। আর্থিক খাতে শৃঙ্খলার অভাব, রাজনৈতিক অস্থিরতা, বিনিয়োগনীতির ধারাবাহিকতার অভাব, সময়ে সময়ে নীতির পরিবর্তন, বিনিয়োগে নিয়োজিত সংস্থাগুলোর সক্ষমতার অভাব, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এসব কারণে দেশি বিনিয়োগও সেভাবে সম্প্রসারিত করা যায়নি। অথচ অর্থনীতির সূত্র হলো, দেশি বিনিয়োগ বাড়লে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ে। কারণ, দেশি বিনিয়োগকারীদের হাত ধরেই বিদেশি বিনিয়োগের সম্ভাবনা তৈরি হয়। আসলে রাজনৈতিক বক্তব্যে বিদেশি বিনিয়োগের আকর্ষণীয় স্থান বাংলাদেশ বলা হলেও বিনিয়োগের পরিবেশের বিষয়টি কেবলই আলোচনায় সীমাবদ্ধ। বিদেশিদের আকর্ষণে নানামুখী নীতি প্রণয়ন হলেও এর ধারাবাহিকতা দৃশ্যমান নয়। এ কারণে আস্থা অর্জন থেকে বারবার ছিটকে পড়তে হয়েছে দেশকে। আবার বিনিয়োগ ধরে রাখতে সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে যে দীর্ঘসূত্রতা ও সমন্বয়হীনতা তাও দূর করা সম্ভব হয়নি। বিগত সরকারের সময়ে বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে যে উদ্যোগগুলো গ্রহণ করা হয়েছে, সেগুলোর কখনও কোনো কার্যকারিতা দেখা যায়নি।
ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, মালয়েশিয়ার অর্থনৈতিক উন্নয়নের মূলে ছিল ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিকস শিল্পে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়াসহ অন্যান্য দেশের বিনিয়োগ। জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও তাইওয়ানের বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো মালয়েশিয়ায় প্রচুর বিনিয়োগ করেছে। থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছে। যদি বাংলাদেশে এ ধরনের বৈদেশিক বিনিয়োগ বৃদ্ধি পায়, তবে নিঃসন্দেহে দেশের আর্থসামাজিক অবস্থার আরও উন্নতি ঘটবে। আমাদের প্রধান উপদেষ্টার লক্ষ্য হয়তো সেদিকেই। তার আগে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে চাইলে যেসব সমস্যা রয়েছে, তা সমাধান জরুরি। তার জন্য বিনিয়োগবান্ধব সংস্কৃতি গড়ে তোলার পাশাপাশি ব্যবসার জন্য অনুধাবনযোগ্য একটি স্থিতিশীল ও দুর্নীতিমুক্ত পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে। দেশের ভাবমূর্তিও একটি বড় বিষয়। আমাদের বিশ্লেষণ সুন্দর ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পরিবেশ, প্রশস্ত রাস্তা, বিদেশি নাগরিকের সঙ্গে ব্যবহার ও আচরণ, রাজনৈতিক পরিবেশ, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, যোগাযোগ ও সংযোগ (কানেকটিভিটি) ঘটানো ও রক্ষার ক্ষমতা, প্রাকৃতিক পরিবেশ, সম্পদের প্রাচুর্য, দক্ষ ও প্রশিক্ষিত জনবল, আমলাতান্ত্রিক জটিলতামুক্ত পরিবেশই বিনিয়োগ আকৃষ্ট করে।
পরিতাপের বিষয়, বাংলাদেশে কার্যকর বিনিয়োগ নীতিমালা নেই। অতীতে বিনিয়োগ আকর্ষণে যেসব উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তা নিয়েও নানা প্রশ্ন রয়েছে। এমনও দেখা গেছে, বিনিয়োগের চেয়ে সরকারকে ঋণের পেছনেই বেশি ছুটতে হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার বিদেশি বিনিয়োগ আনতে যে উদ্যোগ গ্রহণ করেছে তা সত্যিই প্রশংসার দাবি রাখে। এর ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে হবে নির্বাচিত সরকারকে। তবে যে সূচনা হলো, তা যেন কোনোভাবে ম্লান না হয়। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা নীতিমালা পরিবর্তনসহ সুরক্ষার যে দাবি তুলেছেন তা যেন দ্রুত ‘কার্যকরে’ পদক্ষেপ নেওয়া হয়। বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে দেশ নীতিগত ও পরিচালনগত দুর্বলতা কাটিয়ে উঠুক, এটাই প্রত্যাশা।