শিক্ষাব্যবস্থা
রহমান মৃধা
প্রকাশ : ১১ এপ্রিল ২০২৫ ১৬:০২ পিএম
বৈষম্যবিরোধী কোটা আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ছিল মেধার ভিত্তিতে নিয়োগপ্রক্রিয়া নিশ্চিত করা। তবে এ আন্দোলন কেবল কোটার দাবিতে সীমাবদ্ধ থাকেনি, পরিণত হয়েছিল শাসকের বিরুদ্ধে গণবিস্ফোরণে। সরকার পতনের পর দেশ নতুন দিগন্তের স্বপ্নে বিভোর হলো। সবাই একমত হয়েছিল, রাষ্ট্রের দুর্বল অবকাঠামো সংস্কার, দুর্নীতিগ্রস্ত প্রশাসনিক কাঠামো পরিবর্তন এবং কার্যকর ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা প্রয়োজন। সংস্কারের কিছু উদ্যোগ নেওয়া হলেও যে শিক্ষার জন্য এত আন্দোলন, আত্মত্যাগ তার উন্নতি নিয়ে কি কিছুই বলার নেই? বাস্তবতা হলো, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো এখন দখল আর লুটপাটের আখড়ায় পরিণত হয়েছে। এখান থেকেই দুর্নীতির গোড়াপত্তন হয়, এখান থেকেই অনিয়ম বিস্তার লাভ করে। মেধা ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গড়ার স্বপ্নে শিক্ষার্থীরা রক্ত ঝরিয়েছে, অথচ সেই স্বপ্ন কি নিছক প্রতারণায় পরিণত হয়নি? বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষা বোর্ড পর্যন্ত দুর্নীতির ভয়াবহতা সেটাই প্রমাণ করে।
শিক্ষা ক্ষেত্রে দুর্নীতি কতটা বিস্তৃত, তার প্রমাণ মিলছে প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে। এটি শুধু উদ্বেগজনক নয়, পুরো শিক্ষাব্যবস্থার অস্তিত্বই প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। দ্রুত, কার্যকর ও কঠোর ব্যবস্থা না নিলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ধ্বংসপ্রাপ্ত শিক্ষাব্যবস্থার শিকার হবে। তাই শিক্ষা ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে দুর্নীতি প্রতিরোধ অপরিহার্য। তবে এটি কোনো একক প্রচেষ্টায় সম্ভব নয়। সমাজে যদি সহমর্মিতা ও সহযোগিতার মনোভাব বাড়ত, তবে প্রকৃত পরিবর্তন আনা যেত। পরিবর্তন আনতে হলে কথার চেয়ে কার্যকর পদক্ষেপ গুরুত্বপূর্ণ। আমি বিশ্বাস করি, কর্মই মানুষের পরিচয়। কথার সঙ্গে কাজের মিল থাকলেই সমাজে পরিবর্তন সম্ভব। বর্তমান পরিস্থিতি বোঝার জন্য একটি বাস্তব উদাহরণ বিবেচনা করা যেতে পারে। যদিও এতে অনেক অপ্রিয় সত্য প্রকাশ পাবে, তবু এটি প্রয়োজনীয়। কারণ, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার গণ্ডির বাইরে গিয়ে যদি সামগ্রিক কাঠামোয় শিক্ষাব্যবস্থার দুর্নীতিগুলো বিশ্লেষণ করা হয়, তাহলে প্রকৃত চিত্র স্পষ্ট হবে। এটি আমাদের দেখাবে কীভাবে একটি দুর্নীতিগ্রস্ত সিস্টেমের বিরুদ্ধে লড়াই করা সম্ভব।
গত কয়েক মাসে দেশের বিভিন্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সভাপতি নিয়োগ নিয়ে সংঘটিত দুর্নীতি, রাজনৈতিক প্রভাব, প্রশাসনিক অনিয়ম ও প্রতারণার ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করলেই বোঝা যাবে শিক্ষা ক্ষেত্রে কতটা অব্যবস্থাপনা চলছে। স্পষ্ট হবে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় দুর্নীতির শেকড় কতটা গভীরে প্রোথিত।
শিক্ষা প্রশাসনের দুর্নীতি কোনো নিদিষ্ট স্কুলেই সীমাবদ্ধ নয়, এটি পুরো দেশের শিক্ষাব্যবস্থার এক ভয়াবহ ক্ষত, যা প্রতিনিয়ত বিস্তৃত হচ্ছে। এটি শিক্ষার স্বচ্ছতা ও যোগ্যতার বিপরীতে চরম বৈপরীত্য সৃষ্টি করেছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দুর্নীতির চক্র সভাপতি নিয়োগেই সীমাবদ্ধ নয়, এটি পুরো ব্যবস্থা গ্রাস করেছে। বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কর্মচারী নিয়োগে দীর্ঘদিন ধরে ঘুষ লেনদেন চলছে। সরকারি অনুদানের অর্থ উন্নয়ন ও সংস্কারের নামে লুটপাট করা হচ্ছে। পরিচালনা কমিটিতে অনুগতদের বসিয়ে ক্ষমতা কুক্ষিগত করা হচ্ছে।
শুধু প্রধান শিক্ষক ও রাজনৈতিক নেতাই নন, উপজেলা ও জেলা শিক্ষা অফিসাররাও এ দুর্নীতির কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছেন। তাদের সহযোগিতা ছাড়া এটি সম্ভব হতো না। নিয়ম অনুযায়ী স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় সভাপতি নির্বাচন হওয়ার কথা থাকলেও শিক্ষা অফিসাররা প্রধান শিক্ষকের ইচ্ছা অনুসারে সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। জনগণের অভিযোগ উপেক্ষা করা হচ্ছে। অভিভাবক ও স্থানীয়রা বারবার অনিয়মের অভিযোগ তুললেও শিক্ষা অফিসাররা দুর্নীতিগ্রস্ত সিন্ডিকেটের স্বার্থ রক্ষা করছেন। নীতিমালা লঙ্ঘন করে অযোগ্য প্রার্থীকে সভাপতি করা হয়েছে। এ অবস্থা রোধে দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। অন্যথায় শিক্ষাব্যবস্থা পুরোপুরি ধ্বংস হবে, যেখানে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম একটি শোষিত, অনৈতিক ও দুর্নীতিগ্রস্ত সমাজের শিকার হবে।
প্রশ্ন হলো, এখন তো দলনিরপেক্ষ অন্তবর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায়। তাহলে নিয়ন্ত্রণ কেন কোন কোন রাজনৈতিক দলের ক্ষমতার কাছে। রাজনৈতিক প্রভাবশালীরা কি সত্যিই এসব কর্মকাণ্ড মেনে নিয়েছেন, নাকি তারা শুধুই দলের নাম ব্যবহার করে ব্যক্তিস্বার্থ হাসিল করছে? এখানে প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তাও সমান দায়ী। তারা চাইলে এ দুর্নীতির সুযোগ দেওয়া সম্ভব হতো না। কিন্তু তারা ইচ্ছাকৃতভাবে সহায়তা করেছে।
অভিভাবক, শিক্ষক ও স্থানীয় জনগণ দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলে জেলা প্রশাসক (ডিসি) ও শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যানের কাছে লিখিত অভিযোগ দেওয়া হয়। অভিযোগের মূল বিষয় ছিল সভাপতি নিয়োগে স্বচ্ছতার অভাব, প্রধান শিক্ষক ও উপজেলা শিক্ষা অফিসারের দুর্নীতি, বিদ্যালয়ের তহবিল লুটপাট ও সন্ত্রাসীর ক্ষমতার অপব্যবহার।
এখন প্রশ্ন হলো, এ দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিভাবক, শিক্ষক ও জনগণের লড়াই কি থেমে যাবে, নাকি তারা সুবিচারের জন্য আবার সোচ্চার হবেন? যোগ্যতা ও স্বচ্ছতার ভিত্তিতে নিয়োগ নিশ্চিত করাই শিক্ষাখাতের টিকে থাকার একমাত্র উপায়। শিক্ষক ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের নিয়োগে ঘুষ, স্বজনপ্রীতি ও রাজনৈতিক প্রভাব বন্ধ করতে হবে। প্রত্যেক শিক্ষকের পেশাগত দক্ষতা মূল্যায়ন বাধ্যতামূলক করতে হবে, যাতে তারা যোগ্যতার ভিত্তিতে শিক্ষার্থীদের মানসম্মত শিক্ষা দিতে পারেন। শিক্ষকতার মর্যাদা ফিরিয়ে আনতে বেতনকাঠামো উন্নত এবং অযোগ্য শিক্ষকদের অপসারণ নিশ্চিত করতে হবে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর স্বায়ত্তশাসন ও জবাবদিহি নিশ্চিত করাও অপরিহার্য। প্রতিটি বিদ্যালয় ও কলেজের জন্য স্বতন্ত্র তদারকি কমিটি গঠন করতে হবে, যেখানে অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিত্ব থাকবে। বাজেট ব্যবস্থাপনার স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের অবহিত করা জরুরি। শিক্ষক ও প্রশাসনের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ তদন্তে নিরপেক্ষ কমিটি গঠন করতে হবে, যাতে ক্ষমতার অপব্যবহার রোধ করা যায়। শিক্ষার্থীদের সচেতন ও সক্রিয় ভূমিকা নিশ্চিত করাও জরুরি। তাদের অধিকার রক্ষায় ছাত্রসংগঠন ও অভিভাবকদের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে হবে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও সাধারণ মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে। শিক্ষার্থীদের মতামতের সুযোগ সৃষ্টি করে তাদের শিক্ষার মান ও দুর্নীতি নিয়ে সরাসরি যুক্ত করতে হবে।
শিক্ষা খাতের অনিয়ম রোধে প্রতিশ্রুতি যথেষ্ট নয়, প্রয়োজন কঠোর ও বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ। প্রথমত. শিক্ষা খাতে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে। দ্রুত বিচার নিশ্চিত করতে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করতে হবে। বিদ্যালয় পরিচালনা, শিক্ষক নিয়োগ ও প্রশাসনিক সিদ্ধান্তে দুর্নীতি প্রমাণিত হলে সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান করতে হবে। দ্বিতীয়ত. স্বচ্ছ ও মেধাভিত্তিক নিয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। নিয়োগপ্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক প্রভাব ও স্বজনপ্রীতি রোধে সরকারি ও বেসরকারি বিদ্যালয়ে পাবলিক পরীক্ষা চালু করতে হবে। প্রতিটি ধাপে ইলেকট্রনিক নজরদারি নিশ্চিত করতে হবে, যাতে অনিয়ম দ্রুত ধরা পড়ে। তৃতীয়ত. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আর্থিক ও প্রশাসনিক তদারকি বাড়াতে হবে। স্বাধীন নিরীক্ষা দল গঠন করে বাজেট, ব্যয় ও সিদ্ধান্ত তদন্ত করতে হবে। প্রধান শিক্ষক ও পরিচালনা কমিটির কার্যক্রম নিয়মিত মূল্যায়ন ও প্রয়োজনে অপসারণের বিধান রাখতে হবে। অনলাইন পোর্টালে বিদ্যালয়ের আয়ব্যয়ের হিসাব উন্মুক্ত করতে হবে। চতুর্থত. দুর্নীতির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে বিদ্যালয়ে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি বাড়াতে হবে। দুর্নীতির তথ্য সংগ্রহ ও প্রকাশে স্বাধীন গণমাধ্যম ও নাগরিক সংগঠনগুলোর ভূমিকা জোরদার করতে হবে।
বাংলাদেশের শিক্ষা খাতে দুর্নীতির বিস্তার জাতির ভবিষ্যৎ ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এখনই ব্যবস্থা না নিলে আগামী প্রজন্ম ভঙ্গুর ও অনৈতিক শিক্ষাব্যবস্থার শিকার হবে। ‘আম গাছের তলে আমই পড়ে’, দুর্নীতিগ্রস্ত শিক্ষাব্যবস্থায় দুর্নীতিমুক্ত প্রজন্ম গড়ে ওঠা অসম্ভব। তাই শিক্ষা খাতে শুদ্ধি অভিযান সময়ের দাবি; নয়তো পুরো জাতি একদিন ব্যর্থ রাষ্ট্রের পরিচয়ে বিশ্বদরবারে লজ্জিত হবে। এখনই রুখে দাঁড়ানোর সময়।