× ই-পেপার প্রচ্ছদ সর্বশেষ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি শিক্ষা ধর্ম ফিচার ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

যুক্তরাষ্ট্র

ট্রাম্পের শুল্কযুদ্ধ কি অপ্রত্যাশিত ছিল

নিরঞ্জন রায়

প্রকাশ : ১১ এপ্রিল ২০২৫ ১৫:৫৯ পিএম

নিরঞ্জন রায়

নিরঞ্জন রায়

বিশ্বে এখন উচ্চহারে শুল্ক আরোপের প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। শুরুটা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনান্ড ট্রাম্প করলেও এটি বাণিজ্য মহামারির মতো সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। বাদ যায়নি যুক্তরাষ্ট্রের নিকট প্রতিবেশী কানাডা থেকে শুরু করে দীর্ঘদিনের সামরিক মিত্রদেশ ইউরোপ এবং বাংলাদেশের মতো অতি সাধারণ দেশও। ফলে বিশ্বে শুল্ক নিয়ে উত্তেজনা এখন তুঙ্গে। একদিকে যুক্তরাষ্ট্র যেমন বিভিন্ন দেশের ওপর উচ্চহারে শুল্ক আরোপ করছে, অন্যদিকে তেমন প্রতিপক্ষ অনেক দেশও পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর উচ্চহারে শুল্ক আরোপ করতে শুরু করেছে। এ শুল্ক হারের মাত্রা ক্ষেত্রভেদে ২৫ থেকে ১০০% পর্যন্ত। এ মাত্রার শুল্ক আরোপ বিশ্ববাণিজ্যে এক ধরনের অচলাবস্থা তৈরি করে। বর্তমানে যে মাত্রার শুল্ক আরোপ এবং পাল্টা ব্যবস্থা গ্রহণের প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে তাতে সবাই, এমনকি বিশেষজ্ঞরাও এ অবস্থাকে শুল্কযুদ্ধ বলে অভিহিত করেছেন।

এতদিন এ শুল্কযুদ্ধ যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিবেশী দেশ এবং ইউরোপের মধ্যে উত্তাপ ছড়ালেও এখন সারা বিশ্বে এর প্রভাব ছড়িয়ে পড়েছে। এ প্রভাব থেকে বাদ যায়নি বাংলাদেশের রপ্তানি খাত, বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাত। এ কারণেই বাংলাদেশে বিষয়টি নিয়ে এখন বেশ শোরগোল পড়েছে এবং আলোচনাও হচ্ছে বিস্তর। যে যেভাবে পারছেন, সেভাবেই আলোচনা করছেন এবং নানানরকম পরামর্শও দিয়ে চলেছেন। আলোচনা এবং পরামর্শের পরিমাণ এত বেশি যে সরকার, নীতিনির্ধারক এবং রপ্তানিকারকদের একেবারে দিশাহারা অবস্থা। কোন পরামর্শ নিয়ে এগোতে পারলে ভালো ফল পাওয়া যাবে, তা নির্ধারণ করতেই নীতিনির্ধারক ও রপ্তানিকারকদের গলদঘর্ম অবস্থা। এ থেকে একটি বিষয় পরিষ্কার যে অনেকেই এখন বেশি সচেতন এবং বিশ্ববাণিজ্যের বিষয়গুলো নিয়ে ভাবছেন। ফলে এখান থেকে নিশ্চয়ই ভালো কিছু পদক্ষেপ গৃহীত হবে এবং আমাদের রপ্তানি খাত হয়তো এ সংকট সামলে নিতে পারবে। অবশ্য চিঠিপত্র চালাচালি বা আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করে কোনো লাভ হবে বলে মনে হয় না। এর মাধ্যমে হয়তো সাময়িক একটা সান্ত্বনা খোঁজার চেষ্টা হতে পারে, কিন্তু উচ্চ শুল্কের আসল সমস্যা সমাধানের সুযোগ একেবারেই নেই। বিশ্বের মহাক্ষমতাধর দেশ, যারা যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিবেশী এবং বন্ধুরাষ্ট্র, তারাই আলোচনার পথে এগোতে সাহস করেনি। কেননা তারা ভালো করেই জানে এতে কোনোরকম লাভ হবে না।

যা হোক, এখন প্রশ্ন হচ্ছেÑ বিশ্বে এ শুল্কযুদ্ধ কি আকস্মিক শুরু হয়েছে? যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনান্ড ট্রাম্প কি হঠাৎই এভাবে নির্বিচার উচ্চ শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন? এ শুল্কযুদ্ধ কি একেবারেই অপ্রত্যাশিত ছিল? অনেকে হয়তো তেমনটাই বলার চেষ্টা করছেন। কিন্তু আজকের শুল্কযুদ্ধের যে মাত্রা, তা আকস্মিকও ছিল না এবং একেবারে অপ্রত্যাশিতও নয়। যারা বিগত দুই যুগের বিশ্ববাণিজ্যের গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে খোঁজখবর রেখেছেন বা যারা একটু এর ভেতরে প্রবেশের চেষ্টা করেছেন, তারা কিছুটা হলেও আঁচ করতে পেরেছেন যে বিশ্ববাণিজ্যে একটা অস্থির পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। যে মাত্রার শুল্কযুদ্ধ শুরু হয়েছে, তেমনটা হয়তো অনেকেই ভাবেননি। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে একটা বাণিজ্যিক অস্থিরতা যে আসবে, তেমন ধারণা অনেকেরই ছিল।

গত মেয়াদে ট্রাম্প যখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন, তখনই তিনি এ উচ্চ শুল্কহারের বিষয়টি সামনে নিয়ে আসেন। তার সেই শাসনামলে তিনি মূলত চীন এবং হাতেগোনা দুয়েকটি দেশকে লক্ষ করে উচ্চ শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়েছিলেন। প্রথম মেয়াদে ট্রাম্প হয়তো অতটা রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারেননি। তা ছাড়া তিনি মূলত একজন ব্যবসায়ী। তৃণমূল থেকে উঠে আসা রাজনীতিবিদ নন। ফলে উচ্চ শুল্কহারের বিষয়ে ঘোষণা দিলেও সেভাবে অগ্রসর হতে পারেননি। চীনের বিরুদ্ধে উচ্চহারে শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়েও সেখান থেকে সরে আসতে হয়েছে। সে সময় তিনি উচ্চ শুল্কহার আরোপের সিদ্ধান্তের পাশাপাশি একটি স্লোগান নিয়ে এসেছিলেন, তা হচ্ছে ‘মেক আমেরিকা গ্রেট অ্যাগেইন’। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের এ স্লোগানকে মার্কিনিরা বলা চলে জাতীয় স্লোগান হিসেবে গ্রহণ করেছেন, যা তাকে পূর্ণমাত্রার শুল্কযুদ্ধ শুরু করতে উৎসাহিত করেছে এবং সাহস জুগিয়েছে।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প প্রথম মেয়াদে শুল্কযুদ্ধ সেভাবে শুরু করতে না পারলেও এ ব্যাপারে ভালো অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন। বিগত চার বছর হোয়াইট হাউসের বাইরে থাকায়, তিনি বিষয়টি নিয়ে বেশ কাজ করেছেন এবং নিজেকে প্রস্তুতও করেছেন। রীতিমতো হোমওয়ার্ক করে নিশ্চিত হয়েছেন যে বিশ্বের অনেক দেশ বাণিজ্যের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর যেভাবে নির্ভরশীল, তাতে এ শুল্কযুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের যত ক্ষতি হবে তার চেয়ে অনেক বেশি ক্ষতি হবে অন্যান্য দেশের। যেমন ইউরোপের বিভিন্ন দেশের ওপর উচ্চহারে শুল্ক আরোপ করায় যুক্তরাষ্ট্রের যদি ১০ শতাংশ ক্ষতি হয়, তাহলে ইউরোপের হবে ৩০ শতাংশ ক্ষতি। একই অবস্থা অন্যান্য দেশের বেলায়ও। যেমন বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের ওপর উচ্চহারে শুল্ক ধার্য করলে যুক্তরাষ্ট্রের খুব সামান্যই ক্ষতি হাবে। তাদের হয়তো বর্তমান বাজারমূল্য থেকে কিছুটা বেশি মূল্যে পোশাক কিনতে হবে। কিন্তু বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত এবং অর্থনীতির অপূরণীয় ক্ষতি হবে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তার অতীত অভিজ্ঞতা, নিজের প্রস্তুতি এবং এ লাভক্ষতির সমীকরণের ওপর ভিত্তি করেই এবার বিশ্বব্যাপী শুল্কযুদ্ধ শুরু করেছেন। যে কারণে প্রতিপক্ষ বিভিন্ন দেশের পাল্টা ব্যবস্থা গ্রহণের হুমকিতে ট্রাম্প মোটেই বিচলিত নন। উল্টো তিনি শুল্ক আরোপের হার আরও বাড়িয়ে কঠোর থেকে কঠোরতম করার সিদ্ধান্ত নিয়ে চলেছেন।

এ কথা অনস্বীকার্য যে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের এমন আচরণে অনেকেই হতাশ এবং ক্ষুব্ধ। এমনকি তার অনেক মিত্রও বেশ অসন্তুষ্ট। অনেকেই এ শুল্কযুদ্ধ শুরু করার জন্য ট্রাম্পকে দোষারোপও করছেন। কিন্তু যারা যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির বর্তমান অবস্থা বিশ্লেষণ করেন, তারা অবশ্য এতটা হতাশ নন। বরং প্রকারান্তরে তারা ট্রাম্পের যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি নিয়ে ভাবনা এবং একে সঠিক পথে রাখার চেষ্টাকে ভালো দৃষ্টিতেই দেখছেন, হোক সে শুল্কযুদ্ধ বা অন্য কোনো পদক্ষেপ। আমরা সবাই জানি যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের সবচেয়ে বৃহৎ অর্থনীতি, যার আকার প্রায় ২৯ ট্রিলিয়ন ডলার। এর কাছাকাছি কোনো দেশের অর্থনীতি নেই। যুক্তরাষ্ট্রের পরেই যে অর্থনীতি, তা হচ্ছে চীন, যার আকার ১৯ ট্রিলিয়ন ডলার। আপাতদৃষ্টে দেখলে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির চেয়ে চীনের অর্থনীতির আকার এখনও অনেক নিচেই মনে হবে। কিন্তু রাষ্ট্রীয় ঋণের বিষয়টি বিবেচনায় নিলে অবস্থা আর সে রকম থাকে না। যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় ঋণ হচ্ছে ৩৬ ট্রিলিয়ন ডলার, যা জিডিপির প্রায় ১২৫%। পক্ষান্তরে চীনের রাষ্ট্রীয় ঋণের পরিমাণ ১৭ ট্রিলিয়ন ডলার, যা জিডিপির ৮৫%। ফলে চীনের অর্থনীতি যুক্তরাষ্ট্রকে তো এখনই ধরে ফেলেছে। আগামীতে কী হতে পারে তা সবাই খুব সহজে আন্দাজ করতে পারে। এ বিষয়টি আমাদের মতো সাধারণ মানুষ যেহেতু বোঝে, তাই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও তার সহযোগীরা যে আরও ভালো জানেন এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবেন, এটাই স্বাভাবিক।

এখানেই শেষ নয়। দুই যুগ ধরে সস্তায় পণ্যসামগ্রী সংগ্রহের নামে সমস্ত ব্যবসাবাণিজ্য যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে, বিশেষ করে স্বল্পমূল্যের পণ্য উৎপন্ন হয় যেমন ভারত, চীন, বাংলাদেশ, ভিয়েতনামের মতো দেশে চলে গেছে। একইভাবে অল্প মূল্যে কাজ করিয়ে নেওয়ার সুযোগ পেয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অধিকাংশ চাকরি আউটসোর্সিংয়ের নামে চলে গেছে পৃথিবীর অন্যান্য দেশে, বিশেষ করে এশিয়ার অনেক দেশে। আজ থেকে প্রায় ১০-১৫ বছর আগে যুক্তরাষ্ট্র-কানাডার চাকরি ব্যাপকহারে আউটসোর্সিং হয়েছে চীন, ভারত, বাংলাদেশ, মালয়েশিয়া এবং ইন্দোনেশিয়ায়। যুক্তরাষ্ট্র-কানাডা থেকে কাজের এ রকম নির্বিচার আউটসোর্সিং দেখে একজন বিদগ্ধ বিশেষজ্ঞ আক্ষেপ করে বলেছিলেন, এমন দিন হয়তো বেশি দূরে নয় যখন মার্কিনিরা সন্তান জন্ম দিয়ে আউটসোর্সিং করে পাঠিয়ে দেবে ভারত, বাংলাদেশ বা এশিয়ার অন্য কোনো দেশের দম্পতির কাছে, যারা সন্তান লালনপালন করে বড় করে ফেরত পাঠিয়ে দেবে যুক্তরাষ্ট্র-কানাডার পিতা-মাতার কাছে। আউটসোর্সিংয়ের এ রকম রমরমা অবস্থা এবং এর কারণে যুক্তরাষ্ট্র-কানাডার মানুষের চাকরি হারানোর যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল, তা বন্ধের উদ্যোগ নিয়েছিলেন ট্রাম্প। সত্যি বলতে কি, গত মেয়াদে ট্রাম্প যদি আউটসোর্সিংয়ের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ না করতেন, তাহলে আমার চাকরিও এতদিন থাকত কি না সন্দেহ।

এ কথা ভাবার কোনো কারণ নেই যে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প হঠকারী সিদ্ধান্ত নিয়ে এ শুল্কযুদ্ধ শুরু করেছেন। এ রকম শুল্কযুদ্ধ অপ্রত্যাশিত ছিল না। বরং এ রকম কিছু একটা যে ঘটবে, সেটাই প্রত্যাশিত ছিল এবং হয়েছেও তাই। ট্রাম্প অনেক বুঝেসুজে এবং বিচার-বিশ্লেষণ করেই এ শুল্কযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্র কখনই না বুঝে এবং দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য নির্ধারণ না করে কোনো পদক্ষেপ নেয় না। সামরিক ক্ষেত্রে নিলেও নিতে পারে, কিন্তু অর্থনীতির ক্ষেত্রে তো মোটেই নয়, তা সে ট্রাম্প বা অন্য যে কেউ দেশটির প্রেসিডেন্ট পদে থাকুন না কেন। যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ধরন, প্রক্রিয়া এবং লক্ষ্য একই রকম। শুধু প্রয়োগের ধরন ভিন্ন, যা প্রেসিডেন্টের ব্যক্তিগত ক্যারিশমা এবং নেতৃত্বের কারণে ভিন্ন হয়ে থাকে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ক্ষেত্রেও তেমনটা ঘটছে, এই যা।

  • সার্টিফায়েড অ্যান্টি-মানি লন্ডারিং স্পেশালিস্ট ও ব্যাংকার, টরন্টো, কানাডা
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : মোরছালীন বাবলা

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা